বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:২০ অপরাহ্ন

বঙ্গবন্ধু, ইসলাম ও বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় : আমিনুল ইসলাম মিলন

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, জাতির জনক শেখ মজিবুর রহমান ছিলেন উদার চেতনার একজন খাঁটি মুসলাম। বংশ পরস্পর তিনি ছিলেন ধার্মিক পরিবারের সন্তান। ১৪৬৩ খৃঃ ইসলাম প্রচারের জন্য বাগদাদ থেকে বঙ্গদেশে আগত উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলিয়ে কামেল হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ) এর সফর সঙ্গী দরবেশ শেখ আউয়াল ছিলেন তাঁর ৭ম পূর্বপুরুষ। তার পিতা মরহুম শেখ লুৎফুর রহমান (মৃত্যু-১৯৭৪) এর সুখ্যাতি ছিল সুফী চরিত্রের একজন পরহেজগার মানুষ হিসাবে। জাতির জনক নিজেও ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ও ইসলামী তরিকা অনুযায়ী জীবন যাপনের অভ্যস্ত। পবিত্র ধর্ম ইসলামের উদার মানবিকতা, পরোপকরিতা, মানব-সেবা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো প্রভৃতি মানবিক গুনাবলি ছিল ছোটবেলা থেকেই অর্জিত তাঁর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

ধর্মকে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহারের তিনি ছিলেন ঘোরতর বিরোধী। বরং সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে সকল ধর্মেও মানুষের জন্য একটি শান্তির দেশ হিসেবে গড়ে তোলা ছিল তাঁর অঙ্গীকার। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভেশনে প্রদত্ত ভাষনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,‘আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমার সু®পষ্ট বক্তব্য,“আমরা লেবাস সর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রসুলে করিম (সঃ) এর ইসলাম, যে ইসলাম জগৎবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বার বার যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষন-বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে, আমাদের সংগ্রাম সেই সব মোনাফেকদের বিরুদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জনই মুসলামান, সে দেশে ইসলাম বিরোধী আইন পাশের কথা ভাবতে পারেন তারাই, যারা ইসলামকে ব্যবহার করে দুনিয়াবী ফায়দা লোটার কাজে”।

১৯৭০ পূর্ব বিশ্ব রাজনীতির আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে তিনি গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাংলাদেশ রাষ্ট পরিচালনার ৪-মূলনীতি হিসাবে ঘোষণা করলেও ধর্ম নিরপেক্ষতা যে ধর্মহীনতা নয় তা সুস্পষ্টভাবে বিভিন্ন সময় উল্লেখ করেছেন। ১৯৭২ সালের ৪ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের উপর এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাব সুলভ দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করেন, “ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার স্ব-স্ব অধিকার অব্যাহত থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মচর্চা বন্ধ করতে চাই না এবং তা করবও না। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ তাদের বাঁধা দিতে পারবে না। আমাদের আপত্তি হল এই যে, ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবেনা। যদি কেহ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে”।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এক শ্রেণীর ইসলামী রাজনৈতিক দল এখনও ধর্ম নিরপেক্ষতার অপব্যাখ্যা করে চলেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে ইসলামের খেদমতে গৃহীত কর্মসুচী প্রমান করে, ধর্মের প্রতি তাঁর অনুরাগ কত বেশী ছিল। বাংলাদেশের বিগত ৪৮ বছরের শাসনামল প্রমাণ করে ধর্ম নিরপেক্ষতার কারণে এদেশে ইসলাম বিপন্ন হয়নি। ধর্ম বিরোধী কোন আইন পাশ হয়নি। বরং বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছর এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনার আমলে এদেশে ইসলাম ধর্মের স্বপক্ষে ও ইসলামের কল্যাণে বহু গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। পূবেই বলেছি, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষনে বঙ্গবন্ধু কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন পাশের বিপক্ষে তাঁর অবস্থান সুষ্পষ্ট করেছিলেন। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি তাঁর ঘোষণার যথার্থ বাস্তবায়ন করেছেন। নি¤েœ তাঁর শাসনামলে ইসলামের খেদমতে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলঃ

বেতার ও টিভিতে কোরান তিলওয়াত প্রচারঃ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বেতার ও টিভিতে অত্যন্ত গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে কোরান তিলওয়াত ও তাফসীর প্রচার শুরু হয়। ফলে, বেতার ও টিভির অনুষ্ঠানের সূচনা ও সমাপ্তি কোরান তিলওয়াতের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত এ ব্যবস্থা আজও বাংলাদেশে চালু রয়েছে।

মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পূর্ণগঠন : ইসলামী আকিদা ভিত্তিক জীবন গঠন ও ইসলামী শিক্ষা স¤প্রসারনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পূর্ণগঠন করেন। পূর্বে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড স্বায়ত্বশাসিত ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডকে স্বায়ত্বশাসন প্রদান করে এর নাম রাখেন ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড’।

হজ্ব পালনে সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা : পাকিস্তান আমলে হজ্জ যাত্রীদের জন্য কোন সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা ছিলনা। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে হজ্জ যাত্রীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করেন।

ঈদে-মিলাদুন্নবী (সঃ), শব-ই বরাত উপলক্ষে সরকারি ছুটির ঘোষণা : ইসলামে ধর্মীয় দিবস যথাযথ মর্যাদার পালনের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাংলাদেশে ঈদে-মিলাদুন্নবী (সঃ), শব-ই কদর, শব-ই বরাত উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। উল্লেখিত দিনসমূহের পবিত্রতা রক্ষার জন্য সিনেমাহলে চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধ রাখার নির্দেশনা প্রদান করেন।

সীরাত মজলিশ প্রতিষ্ঠান : বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতার ঢাকায় সীরাত মজলিশ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। সীরাত মজলিশ ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে রবিউল-আউয়াল মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বৃহত্তর আঙ্গিকে ঈদে-মিরাদুন্নবী (সঃ) মাহফিল উদযাপনের কর্মসূচী গ্রহণ করে। সরকার প্রধান হিসাবে বঙ্গবন্ধু বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্বরে মাহফিলের শুভ উদ্বোধন করেন। আজ সারা বাংলাদেশে পবিত্র ঈদে-মিলাদুন্নবী (সঃ) উপলক্ষ্যে মহা জাঁক-জমকের সাথে যে ‘জশনে-জুলুশে ঈদে মিলাদুন্নবী (সঃ)’ পালন করা হয়-তাঁর পথিকৃৎ ছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং।

মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধকরণ ও শান্তির বিধান করা : ইসলামে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যবলাপ সম্পূর্নভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামের নামে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে অবাধে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ চলত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুই প্রথম আইন করে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে শাস্তির বিধান জারি করেন।

ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা নিষিদ্ধকরণ : পাকিস্তান আমলে ঢাকায় বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম ছিল রেসকোর্স ময়দান। সেখানে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার নামে চলত জুয়া ও বাজি ধরা প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বাজিতে হেরে সাধারণ মানুষ সর্বশান্ত হয়ে যেত। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা বন্ধ করেন এবং রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা : ইসলাম সর্ম্পকে গবেষণা, প্রচার-প্রসার এবং এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে ইসলামের আদর্শে জীবন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ ‘বায়তুল মোকারম সোসাইটি’ ও ‘ইসলামীক একাডেমী’ নামক তৎকালীন দুটি সংস্থার বিলোপ সাধন করেন প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামী ফাউন্ডেশন। যা এখন ইসলামের খেদমতে সরকারী অর্থে পরিচালিত অন্যতম একটি বৃহৎ সংস্থা হিসাবে স্বীকৃত।

বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে সরকারি জায়গা বরাদ্দ : তাবলীগ জামাতে যাতে বাংলাদেশে অবাধে ইসলামের দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে এ উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে সুবিশাল জায়গা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার এ স্থানটি বরাদ্দ করেছিলেন বলেই আজ বিশ্ব ইজতিমায় আগত লক্ষ লক্ষ মুসলমান এখানে সমাবেত হয়ে দাওয়াতি কাজ পরিচালনার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তাবরিগি ভাইরা বঙ্গবন্ধুর এ অবদানের স্বীকৃতি দিলে ইতিহাসের দায়বদ্ধতা মিটবে।

কাকরাইলের মারকাজ মসজিদ স¤প্রসারনের জন্য ভূমি বরাদ্দ : বর্তমানে কাকরাইলের যে মসজিদে কেন্দ্রীয়ভাবে তাবলিগ জামাতের মারকাজ অনুষ্ঠিত হয় এ মসজিদটি ছিল খুবই ছোট। বঙ্গবন্ধু কাকরাইলের তাবলিগ সরকারের জন্য আরো জমি বরাদ্দ করেন এবং মসজিদটি তাঁরই নির্দেশে স¤প্রসারিত হয়।

রাশিয়াতে প্রথম তাবলিগ জামাত প্রেরনের ব্যবস্থা : রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি কমিউনিষ্ট দেশ। সেদেশে বিদেশ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য কেউ অনুমতি পেতনা। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে রাশিয়া সহযোগিতা করায় সেদেশের নেতৃবৃন্দের সাথে বঙ্গবন্ধুর সুদৃঢ় বন্ধত্বের সূচনা হয়। বঙ্গবন্ধু এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়নের তাবলিগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে পূর্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে তাবলিগ জামাতের যে সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তার মূল ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আরব বিশ্বেও পক্ষ সমর্থন ও সাহায্য প্রেরণ: ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত আরব-ইসরাইল যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আরব পক্ষকে সমর্থন করেন এবং যুদ্ধে বাংলাদেশ তাঁর সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ অবদান রাখার চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আরব-ইসলাইল যুদ্ধে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থনে এক লাখ পাউন্ড চা, ২৮ সদস্যের একটি মেডিকেল টিম ও স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী প্রেরণ করেন।

ওআইসি সম্মেলনে যোগদান ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন: ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) অধিবেশনে যোগদান বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এ সম্মেলনে যোগদান করে বঙ্গবন্ধু ইসলাম ও বাংলাদেশ সম্পর্কে মুসলিম নেতৃবৃন্দের সামনে যে বক্তব্য তুলে ধরেন এতে আরব সহ মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় এবং মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সুদুঢ় বন্ধন গড়ে ওঠে।

মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক: দুঃখজনক হলেও একথা সত্যি যে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খুব অল্প সংখ্যক মুসলিম দেশ বাংলাদেশকে সমর্থন করে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ তৎকালীন ভূ-রাজনৈতিক কারণ এবং পাকিস্তান, সৌদি আরব, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মত শক্তিধর দেশের বিরোধিতার কারণে অনেক মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে সরাসরি সমর্থন করতে পারেনি। তবে ব্যতিক্রমও ছিল। কিন্তু দেশে স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন, তখনই দিনে দিনে অবস্থা পরিবর্তন ঘটতে থাকে। আফ্রিকার মুসলিম দেশ সেনেগাল শুধু বাংলাদেশর স্বাধীনতা যুদ্ধকেই সমর্থন করেনি বরং এটি ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকারী প্রথম মুসলিম দেশ। সেনেগালের প্রেসিডেন্ট সেংঘর বাংলাদেশের জন্য সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রতিবেশী দেশগুলো সফর করেন এবং তাদের প্রতি উদাত্ত আহŸান জানিয়েছিলেন। এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের সমর্থন করে। এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তারাই প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃাত দেয়। অন্যদিকে ইরাক, সিরিয়া, আলজেরিয় দক্ষিণ ইয়েমেন, মিশর আমাদের প্রতি সহানুভুতিশীল থাকলেও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে সময় নেয়। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের গুণে একে একে মুসলিম দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে থাকে। ১৯৭২ সালে ১ ফেব্রæয়ারি সেনেগাল, ২৪ ফেব্রæয়ারি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া, মার্চ মাসে গাম্বিয়া, ৬ এপ্রিল গ্যাবন, ২১ এপ্রিল সিয়েরা লিওন, ৮ জুলাই ইরাক, ৩১ জুলাই দক্ষিণ ইয়েমেন, ৫ আগষ্ট উগান্ডা, ১৯ আগষ্ট বুরকিনা ফাসো প্রভৃতি মুসলিম দেশ ১৯৭২ সালের মধ্যেই বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৩ সালে স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশগুলো হলো ১৮ ফেব্রæয়ারী আফগানিস্তান, ২৮ মার্চ লেবানন, ১৩ জুলাই আলজেরিয়া ও মরক্কো, ১৭ জুলাই তিউনেশিয়া ও মৌরিতানিয়া, ১৫ সেপ্টেম্বর মিশর ও সিরিয়া, ১৬ অক্টোবর জর্ডান, ৪ নভেম্বর কুয়েত ও উত্তর ইয়েমেন।

১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। একই তারিখে ইরান ও তুরাস্ক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। একই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারী নাইজেরিয়া, ৪ মার্চ কাতার, ১০ মার্চ সংযুক্ত আরব আমিরাব ও বাহরাইন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। খুবই কম সময়ের মধ্যে জাতির পিতা তিনটি মুসলিম দেশ অর্থাৎ সৌদি আরব, ওমান ও সুদান ছাড়া বিশ্বের সব মুসলিম দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক তথা কুটনৈতিক সর্ম্পক স্থাপন করে দিয়ে গেছেন। তবে ওই তিনটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থাপনের পথ সুগম করে গেলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তা তিনি করে যেতে পারেনি। তবে বঙ্গবন্ধুর তৈরি করা সেই মসৃণ পথে হেঁটেই বাংলাদেশের সঙ্গে মুসলিম দেশগুলো সহ পৃথিবীর সব দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আজকের এই শক্তিশালী বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে মুসলিম বিশ্বের অনেক নেতা যেমন বাংলাদেশ সফর করেন তেমনি বঙ্গবন্ধুও এ স্বল্প সময়ে বেশ ক’টি মুসলিম দেশ সফর করে সফরকারী দেশগুলোর সম্পর্ক উন্নয়নের সূচনা করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে এক সংক্ষিপ্ত সফরে মালয়েশিয়া যান। ঐ সফরে দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব, পাস্পারিক সমঝোতা ও সহযোগিতার দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়, যা আজো চলমান। বঙ্গবন্ধুর ঐ সফরকে সম্মান জানিয়ে পরের বছর ৩ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার রাজা আব্দুল হালিম মোয়াজ্জেম শাহ বাংলাদেশ সফর করেন। সফরকালে দু’দেশের মধ্যে একটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষারিত হয়। ১৯৭৩ সালের ৫ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত ৪র্থ ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যোগদান করেন। ১৯৭৪ সারের ৩ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু ৪ দিনের এক রাষ্ট্রীয় সফর ইরাক যান। ইরাক সফর শেষে বঙ্গবন্ধু কুয়েতও সফর করেন। ১৯৭৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু এক রাষ্ট্রীয় সফরে সংযুক্ত আরব আমিরাত যান।

অন্যদিকে এ স্বল্প সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগন বাংলাদেশ সফর করেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী মিশরে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এক রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফর করেন ১৯৭৪ সালের ২৭ থেকে ২৯ জুন। অন্যদিকে একই বছরের ৮ মার্চ আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিন বাংলাদেশ সফর করেন। আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিন বাংলাদেশ সফরে এলে তাকে উষ্ণ সম্বর্ধনা দেয়া হয়। বুমেদিন বঙ্গবন্ধুকে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেন এবং আফ্রো-এরাবিয়ান কালচার অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর মুখের ও মাথায় অনেকগুলো চুমো দেন। পরের দিন দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় সচিত্র সে সংবাদ ছাপা হয়- নীচে লেখা কবি নির্মুলেন্দু গুনের ছড়া-বুমেদিন-বুমেদিন-বেশী করে চুমো দিন।

কৃতজ্ঞা স্বীকার : নোয়াখালী জেলা প্রশাসন। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে নোয়াখালী জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত জš§শতবার্ষিকী স্মারক ‘চিরঞ্জীব শেখ মুজিব’ এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিলো। লেখাটির গুরুত্ব বিরেচনায় আমরা লেখাটি পূর্ণ মুদ্রন করলাম- সম্পাদক
লেখক : আমিনুল ইসলাম মিলন


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: