বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১৮ অপরাহ্ন

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, মুজিববর্ষ এবং মে দিবস- মো. আকতারুল ইসলাম

এই তো, আমাদের বাবা-চাচাদের আমলেই পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আমদানি করা পুরাতন পোশাকের বাজারের নাম দেওয়া হতো নিক্সন মার্কেট, কার্টার মার্কেট। সেখান থেকে দু’একবছর পরা যায় বেছে বেছে এমন শার্ট, প্যান্ট কিনে অধিকাংশ লোকই দর্জিকে দিয়ে ফিটিং করে পরতেন। গ্রামের একজন শ্রমজীবী মানুষ সারাদিন শ্রম দিয়ে এক-দেড় সের চাল কিনে বাড়ি যেতেন। একটা মানুষ এক-দেড় হাজার টাকায় গেরস্তের বাড়িতে সারা বছর শ্রম দিতেন। কাজের মহিলাদের কোনো পারিশ্রমিক ছিল না, সন্ধ্যায় রান্না করা সামান্য ভাত কিংবা একপোয়া চাল পেলেই অনেক। লেখা-পড়ার কোনো বালায় নেই অনেক মা-বাবা শিশু সন্তানকে কাজে পাঠিয়ে দিতেন। উপজেলা পর্যায়ে হয়তো দু’একটা রাস্তা পাকা ছিল আর গ্রাম পর্যায়ে কোনো কাঁচা রাস্তাই ছিল না। আউশ-আমন ধানের দিকে তাকিয়ে থাকতো সবাই। আর আজ! পরিবেশবান্ধব শীর্ষ দশে থাকা বিশ্বের ২৭টি পোশাক কারখানার ১৪টিই বাংলাদেশের। সারা বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৪০/৪২লাখ লোকের। এখন নিরাপদ কর্মক্ষেত্র এবং উন্নয়নে বিশ্বে রোল মডেল। ধান, আলু, মাছ, সবজিসহ অনেক খাদ্যশস্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত বাংলাদেশ। গ্রাম পর্যন্ত সকল রাস্তা পাকা হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষগুলো ভ্যান, ভুটভুটি, অটোরিকশা চালিয়ে জীবনমান উন্নয়ন করছে। কোটি খানেক রেমিট্যান্স যোদ্ধা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিনা পয়সা নয় টাকা দিয়েও গৃহকর্মী পাওয়া কঠিন। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে শিশুশ্রমমুক্ত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ ঘোষণার মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি প্রত্যয়ী ও মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। আজ ভার্চুয়াল লিডার্স অন ক্লাইমেট সামিট শীর্ষক জলবায়ু সম্মলেনে ৪০ জন বিশ্ব নেতার অংশ গ্রহণে আমাদের প্রধানমন্ত্রী পরার্মশ উপস্থাপন করছেন। এসবই আমাদের মহান স্বাধীনতার ৫০ বছরের অর্জন।

এসকল গর্ব করার মতো অর্জনকে সামনে রেখে এবছর উদযাপিত হচ্ছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। বছরটি আবার স্বাধীনতার রুপকার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীও। যিনি আজীবন শোষিত, নিপিড়িত মানুষের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। তাইতো এবছর মে দিবসের প্রতিপাদ্য নির্বাচন করা হয়েছে “মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষ মুজিববর্ষে গড়বো দেশ”। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন,“বিশ্ব আজ দুইভাগে বিভক্ত, এক দিকে শোষক, আর অন্য দিকে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে”| তিনি জানতেন শোষিত নিপিড়িত মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে সমাজে সাম্যতা আসবে না। মহান স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষে সেই শ্রমজীবী, শোষিত মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর আজীবন ত্যাগ আর সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে এ প্রতিপাদ্য নির্বাচন যথার্থ হয়েছে।

১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের মর্যাদা, শ্রমের মূল্য এবং দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে শ্রমিকেরা যে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তাদের সে আত্মত্যাগের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তাদের ন্যায্য অধিকার, পেশাগত নিরাপত্তা ও সুস্থতা নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প নেই। গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের পরেই ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর সদস্যপদ লাভ করে। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের ২২ জুন আইএলসি সম্মেলনে ৬টি কোর-কনভেনশনসহ ২৯টি কনভেনশন অনুসমর্থন করে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে পহেলা মে’কে মে দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং আত্মত্যাগ প্রমাণ করে ১ মে যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের রক্ত দেওয়ার ইতিহাস থেকে বাংলার শ্রমিকরা আত্মত্যাগের দীক্ষা গ্রহণ করেছে।

-২-

শ্রমিক উৎপাদনের অপরিহার্য উপাদান। দেশের সম্ভাবনা এবং শ্রমজীবী মানুষের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির স্বার্থে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ কে ২০১৮ সালে যুগোপযোগী করে মোট ৮৫ ধারা, উপ-ধারায় সংশোধন করা হয়েছে। প্রতিটি কারখানায় তাদের অধিকার আদায়ে তারা যাতে সচেষ্ট থাকে, তারা যাতে অধিকার বঞ্চিত না হয় সেজন্য ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন সহজতর করা হয়েছে। আগে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে যেখানে ৩০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন প্রয়োজন হতো এখন ২০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থনে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন দেয়া হয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ঘোষিত ৩৮ ঝুকিপূর্ণ সেক্টরের মধ্যে ইতোমধ্যে ৮টি সেক্টরকে শিশুশ্রমমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এবছরই আরো কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ সেক্টরকে শিশুশ্রমমুক্ত ঘোষণা করা হবে। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে শিশুশ্রমমুক্ত ঘোষণার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।

শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় প্রতিটি কারখানাকে শ্রম পরিদর্শনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে। সব কারখানায় সেইফটি কমিটি গঠন এবং যে কোনো প্রকার বিরোধ নিষ্পত্তিতে সামাজিক সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে। সব শিল্পসেক্টরে শ্রমিক-মালিক, সরকার ত্রিপক্ষীয় কমিটি কাজ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর বিবেচনায় ২০১৭ সালে শুধু গার্মেন্টস শিল্পের জন্য আলাদা ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠিত হয়েছে। সুস্থ কর্মপরিবেশে কাজ করা শ্রমিকদের অধিকার। শ্রমিকের পেশাগত রোগের চিকিৎসা, শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণা ও প্রশিক্ষণের জন্য রাজশাহীতে ১৯ বিঘা জমির ওপর ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি ইনষ্ট্রিটিউট নির্মাণ করা হচ্ছে।

প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য সরকার শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল গঠন করেছে। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলে, কোনো শ্রমিক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে কিংবা তাদের সন্তানের উচ্চশিক্ষা, নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন সহায়তা এ তহবিল থেকে প্রদান করা হয়। সরকার শুধু গার্মেন্টস শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য কেন্দ্রীয় তহবিল নামে ভিন্ন একটি তহবিল গঠন করেছে। গার্মেন্টসকর্মীদের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা, মাতৃত্বকালীন সহায়তা, তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় সহায়তা এমন কি তাদের বিমার দাবিও এ তহবিল থেকে পরিশোধ করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে কলকারখানায় উৎপাদন ব্যবস্থা ঠিক রেখে সরকার সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। গত বছর করোনা মহামারির শুরুতেই শ্রম মন্ত্রণালয় সারা দেশে মাঠ পর্যায়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, মালিক এবং শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ২৩টি বিশেষ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করে। এ বছর করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার লক্ষ্যে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চত করে উৎপাদন সচল রাখতে কমিটিগুলো সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দুটি অধিদপ্তরের চিকিৎসক দিয়ে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে।

মালিক-শ্রমিক সকলের সহযোগিতায় এ দুর্যোগ মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। রুপকল্প-২০৪১ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতের বিকল্প নেই। দেশের এ সুবিশাল শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের যথাযোগ্য মর্যাদা, সম্মান, ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতকরণ, শোভন কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শিশুশ্রম নিরসন, ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ, শ্রমিক-মালিক সকলে মিলে মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়াই হোক এবারের মে দিবসের অঙ্গীকার।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: