মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৩৩ অপরাহ্ন

শিরোনাম

সাময়িক অনুভূতিতে অসামান্য মা; প্রাসঙ্গিকতায় একুশ – মিতা সাহা

মাকে নিয়ে কোনদিন কোন কথা লিখতে হবে, মা একদিন স্মৃতি হয়ে যাবে! ভুলক্রমে ভাবতেও পারিনি। জানি মৃত্যু অনিবার্য তবু প্রিয় মানুষের মৃত্যুর কথা কেউ বোধহয় ভুল করেও ভাবতে পারে না। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। মায়ের মুখে শুনেছে আমার জন্মের সময় মা নাকি খুব কষ্ট পেয়েছে, রাতের পর রাত ঘুমাতে পারেনি। সবার খুব আদরের ছিলাম বিধায় একটু কান্না করলেও মাকে অনেক বকা শুনতে হত। মায়ের মুখে শুনেছি ছোটবেলা থেকেই আমি নাকি খুব পরিষ্কার-পরিপাটি ছিলাম আর শান্ত হলেও একটু রাগী স্বভাবের। আমাদের ঘর ছিল মাটির, যেদিন মা ঘর লেপত সেদিন আমি নাকি বিছানা থেকে পা নামাতাম না, প্রতিদিনই সন্ধ্যা হলে ধূপ-প্রদীপ দিলে কান্না জুড়িয়ে দিতাম, রাতে শোয়ার সময় মশারি টাঙালে ঘুমাতে চাইতাম না, একবার যদি মা আমাকে খাইয়ে দিত, কারো ঘরে কেউ যদি খাবার দিলেও খেতাম না।তার জন্য আমাকে সবার অনেক কটু কথা শুনতে হতো। সময়ের আবর্তনে যখন ধীরে-ধীরে বড় হচ্ছি তখন থেকেই মায়ের দুঃখটা বোঝার চেষ্টা করতাম। আমার মনে পড়ে আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন দুপুর বেলা মা পাশের বাড়ীর ঢেঁকীতে চালের গুড়া করতে গিয়েছিল, এ সুযোগে আমি স্কুল থেকে এসেই রান্নাঘর গুছিয়ে পৌষ সংক্রান্তির পিঠা বানানোর আয়োজন করে রেখেছিলাম। মা তো এসে খুব অবাক হয়ে বললেন ‘যাক এবার আমার দুঃখ দূর হলো’!! আসলে এভাবেই মায়ের গৃহস্থালি কাজে সহযোগিতা করতাম যাতে মায়ের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়। প্রতিদিন সকালবেলা আমি চাইতাম সকলের ঘুম থেকে ওঠার আগে সব কাজ করে ফেলার। আমার কাজ শেষ হওয়ার আগে মা যদি উঠে যেত আমি খুব রেগে যেতাম। রাতে ঘুমানোর সময় মা যদি চুমু না দিত শান্তিতে মনে ঘুমাতে পারতাম না।আমার একটা ছোট ভাই ও একটা বোন আছে। আমি প্রায়শই মাকে বলতাম তুমি ওদেরকে বেশি ভালোবাসো! মা বলতো তুই এখন বুঝবি না, তুই আমার প্রথম সন্তান, প্রথম অনুভূতি তোর প্রতি ভালোবাসাটা সবার থেকে আলাদা। আমার বিয়ে নিয়ে মা অনেক চিন্তা করত। কিন্তু যখন আমার বিয়ে ঠিক হলো, মা-ই বেশি মন খারাপ করেছে। আমার বরকে মা অনেক ভালোবাসতো, আমার বরও তাই। আমার বরকে আদর করে ডাকত জামাই বাবাজী। একসময় আমিও দুই কন্যা সন্তানের মা হলাম। ভালোবাসার প্রশ্নে মা আমাকে সবসময় বলতেন, ‘তোর দুইটা আংগুল কাটতো! বলতো কোনটাতে বেশি ব্যথা? একদিন মা, আমাকে অভিমান নিয়ে ফোন করে বলল, মায়ের কথা তো মনে পড়েনা! মাকে দেখতেও ইচ্ছে করে না! আমি মাকে দুষ্টামি করে বলেছিলাম, আমার তো এখন মা লাগেনা, আমার তো দুইটা মা আছে। মা হাসলো তবে ঐদিন একটু কষ্ট পেয়েছে। মা একদমই নির্ভেজাল ছিলেন। সমালোচনা করা মোটেই পছন্দ করতেন না। মা আমাদের অনেক বিশ্বাস করতো। শাসন করেনি, শুধুই ভালোবেসেছে। কোনো অন্যায় কাজ করার পূর্বে আমাদের মায়ের সেই বিশ্বাস এর কথা স্মরণে আসত। বাবাকে মা অনেক ভালো বাসতো। সবসময় বলতো বাবার মনে কষ্ট দিসনা। মায়ের প্রচন্ড ধৈর্য শক্তি ছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সহ্য করেছেন অনেক কিছু। মা সবসময় বলতেন ধৈর্য ধর, দেখবে শেষপ্রাতে অবশ্যই কিছুনা কিছু পাবেই। মা মিষ্টি জাতীয় খাবার খুব পছন্দ করতো। বিশেষ করে রসমালাই। যখনই বাড়ীতে আসার আগে জিজ্ঞেস করতাম তোমার জন্য খাওয়ার কি আনবো? মা একবাক্যে বলত রসমালাই এর কথা। আহা! বুকটা ফেটে যাচ্ছে! আর কোনোদিন মা আমাকে একথা বলবেনা!! মায়ের সাথে যখনই থাকতাম প্রতি খাবারের পর উনি যতবার পান খেত, আমাকেও একখিলি করে দিত। পান খেতে খেতে কত গল্প করতাম। এখন আর গল্প করার জন্য সবাই আছে, শুধু আমার মা নেই। বাচ্চারা আমার মাকে খুবই পছন্দ করতো। মা ও বাচ্চাদের সাথে খুব সহজে মিশে যেত। মা সবসময় খাবার পরিবেশন বেশি করে খাবার দিত। বাবা বিরক্ত হয়ে বলতো ভাত বেশি খেলে মানুষ কি বেশিদিন বাঁচে? মা হাসতো… শীত আসলে কোন রাতে নিজ হাতে ভাত খাইনি। লেপের নিচে বসে থাকতাম, আর মা আমাদের তিন ভাই-বোন কে নিজ হাত দিয়ে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিত।আরও অনেক অনেক স্তৃতি আছে যা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখলেও শেষ হবে। সবার কাছে সবার মা-ই সেরা। তবে আমার মায়ের মধ্যে যে গুনগুলো আছে তা হয়তো এই বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকটাই দূর্লভ। এই দূর্লভ একটা মা হারানো সন্তানের একটা অনুভূতির আবেদনের ছিটেফোঁটা কালি-কলম-কাগজে লৈখিক প্রকাশ মাত্র। ভেতরে গভীর ক্ষত, বাহিরে উপশম। বছর ঘুরে ২১ ফেব্রæয়ারি আজ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালেও কোনো মা তার সন্তানকে হারিয়েছে, বোন হারিয়েছে তার ভাইকে। ঐ যে মাতৃভাষা…! মা থাকেই… আমরা আমাদের শব্দচয়নে, শ্রবণ প্রবেশে, আবেগে, শক্তিতে, সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামে, মহাবিজয়ে প্রাণশক্তিতে, কোন না কোনভাবে মাকেই বন্দনা করি। মাতৃভাষায় মা’কে আবারও মনে পড়ল। মায়ের জন্য আত্মদানও যেখানে নূন্যতম, সেখানে শ্রদ্ধা জানানো ধৃষ্টতার চরমরূপ। তবে বলতেই পারি আমি তোমায় ভালোবাসি মা।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: