বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৫৭ পূর্বাহ্ন

সিঙ্গাপুর বিডি চ্যামের সভাপতি টরিক, সম্পাদক আসাদ

নিউজ ডেস্ক :: কোভিড মহামারিকে পেছনে ফেলে বিশ্ব যখন মোটামুটিভাবে একটা স্বস্তির শ্বাস নিতে শুরু করেছে ঠিক তখনই নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে মাঙ্কিপক্স। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে এটা নিয়ে তাদের উৎকণ্ঠা এবং সতর্কতা জারি করেছে। এই উৎকণ্ঠা এবং সতর্কতা জারির পেছনে বড় কারণ হচ্ছে, প্রতিনিয়ত বিশ্বব্যাপী মানুষের অবাধ যাতায়াত। ফলে এটা যদি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তা নতুন করে একটা মানবিক সংকট তৈরি করতে পারে। সংক্রামক রোগের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, শুরুতেই সতর্ক না হলে তা এক দেশ থেকে আরেক দেশে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। দগদগে কোভিড যাতনা আমাদের সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, মাঙ্কিপক্স কি কোভিডের মতো এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে? বা কোভিডের মতো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে? অবস্থাদৃষ্টে এবং ইতিহাসের নিরিখে অন্তত আমার কাছে তেমন মনে হচ্ছে না। কারণ কোভিড অনেক মানুষের দেহে মৃদু লক্ষণ আকারে দেখা দিয়েছে। এমনকি অনেকের দেহে টেস্টে ভাইরাসের উপস্থিতি মিলেছে ঠিকই কিন্তু বাহ্যিক কোনো লক্ষণ প্রকাশিত হয়নি। ফলে এসব মানুষেরা অবাধে কোভিড ভাইরাস ছড়াতে পেরেছে। কিন্তু মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রে লক্ষণ অপ্রকাশিত থাকে না।

মাঙ্কিপক্স নিয়ে সতর্কতা জরুরি ঠিকই; তবে আপাতদৃষ্টিতে আতঙ্কিত হওয়ারও কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। বরং বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের কঠোরভাবে মনিটরিং করা এবং দেশবাসীকে এ সম্পর্কিত তথ্য মিডিয়ার মাধ্যমে অবহিত করে তাদের সচেতন করাটাই আমাদের প্রধানতম কাজ হওয়া উচিত

জ্বর, মাথা ব্যথা, গা ব্যথা, দুর্বলতা এগুলো তো থাকবেই। সেই সাথে দেহে গোটা গোটা উঠবে, যা পানি ভর্তি থাকে। পরে পুঁজ হয়। লসিকাগ্রন্থি ফুলে যায়। দু-চার সপ্তাহে সেরেও যায়। ধরে নিন চিকেনপক্স হলে যেমন হয় তেমন। যদিও এটি চিকেনপক্সের সমগোত্রীয় ভাইরাস নয়। বরং বিশ্ব থেকে নির্মূল হয়ে যাওয়া স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের মতো মাঙ্কিপক্সও পক্স ভাইরাস। ফলে এটা পরিষ্কার যে, মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হলে এর লক্ষণ প্রকাশিত হবেই। লুকানোর সুযোগ নেই।

এবার আসুন একটু ইতিহাসের দিকে তাকাই। ইতিহাস বলছে এ রোগটি মধ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে বিভিন্ন সময়ে দেখা দিয়েছে। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে (১৯৭০ সালে) কঙ্গোতে ৯ বছর বয়সী একটা বাচ্চার শরীরে প্রথম এ রোগটি ধরা পড়ে। তবে কখনই প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হয়নি।২০১৭ সালে নাইজেরিয়ায় ৫০০ ব্যক্তি (এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ সংখ্যক) এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে সন্দেহ করা হয়। তবে ২০০ এর অধিক একদম নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত হয়। মৃত্যুর হার ছিল ৩ শতাংশের মতো।

আফ্রিকার বাইরে ২০০৩ সালে আমেরিকায় ৭০ ব্যক্তির দেহে এ ভাইরাস শনাক্ত হয়। যদিও এর উৎস ছিল গাম্বিয়া থেকে নিয়ে আসা ইঁদুর এবং কাঠবিড়ালির মতো প্রাণীর সংস্পর্শে আসা কুকুর। পরে কুকুর থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। এছাড়া ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২১ সালে যথাক্রমে ইসরায়েল, সিঙ্গাপুর এবং আমেরিকায় এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়।

এছাড়াও ২০১৮, ২০১৯, ২০২১ এবং চলতি বছরের ১৩ মে থেকে এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি ব্রিটেনে শনাক্ত হয়েছে। তবে এবার উদ্বেগটা দেখা দিয়েছে এজন্য যে, ব্রিটেনে মাঙ্কিপক্সে প্রথম শনাক্তকৃত ব্যক্তির সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকার কোনো দেশ ভ্রমণের ইতিহাস নেই এবং দিন দিন ইউরোপের দেশসমূহে তা ছড়িয়ে পড়ছে।

মাঙ্কিপক্স মূলত আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসপ্রশ্বাস, হাঁচিকাশি, ব্যবহৃত জামাকাপড়, বিছানা, লালা, থুতু, রক্তের মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এজন্য আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা ঘরে রাখতে হবে। মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির যারা সেবা করবেন তাদের অবশ্যই হাত ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে অথবা স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্র ডিটারজেন্টে ভিজিয়ে রেখে পরিষ্কার করতে হবে। তবে, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম যেমন- বয়স্ক, ক্যানসার ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, কেমোথেরাপি নিচ্ছেন অথবা স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ খাচ্ছেন তারা আক্রান্ত ব্যক্তির দেখাশোনা করতে পারবেন না। এ রোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। ফলে দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।

শেষ কথা হচ্ছে, রোগটি অল্প কয়েকদিন আগেই যেহেতু শনাক্ত হয়েছে, কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ফলে আমাদেরও সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে যারা বিদেশ থেকে আসছেন তাদের কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। এর মধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও সব বিমানবন্দর এবং স্থলসীমান্তে এমন নির্দেশনা দিয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। এটি মোকাবিলার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদান এবং এ সংক্রান্ত গাইডলাইন নিয়ে সামনে এগোতে হবে।

তবে, এটা বলা যায় যে, মাঙ্কিপক্স নিয়ে সতর্কতা জরুরি ঠিকই; তবে আপাতদৃষ্টিতে আতঙ্কিত হওয়ারও কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। বরং বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের কঠোরভাবে মনিটরিং করা এবং দেশবাসীকে এ সম্পর্কিত তথ্য মিডিয়ার মাধ্যমে অবহিত করে তাদের সচেতন করাটাই আমাদের প্রধানতম কাজ হওয়া উচিত।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ
এনাম মেডিকেল কলেজ, সাভার।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: