বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৫৮ অপরাহ্ন

পদ্মাসেতু: দিনবদলের স্বর্ণসেতু – মুস্তাফা মাসুদ

বর্ষায় দুকূলপ্লাবী ঢেউ থৈথৈ পদ্মায় নৌকা ভাসানো মাঝির চোখে পদ্মা একদা কূলহীন-কিনারাহীন, ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ অথৈ বিস্ময়ভরা ভয়ের নদী ছিলো। তাই ‘পদ্মা নদী পাড়ি’ দিতে যাওয়া উদ্বেগাকুল মাঝিরা ‘মওলাজীর নাম লইয়া’ নৌকা ভাসাতেন। ঝড়-তুফানে প্রমত্ত পদ্মায় নৌকা-লঞ্চডুবি, প্রাণহানি আর স্বজন হারানোর হাহাকারে আকাশ-বাতাস ভারী হওয়ার ঘটনা একসময় ছিলো সাংবাৎসরিক- নিকট-অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। পদ্মার এপার-ওপার পারাপারে যে ঝক্কি, যে অসহনীয় কষ্ট-ভোগান্তি- ভুক্তভোগী মাত্রই তা জানেন। সড়ক পথে রাজধানীর সাথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার লক্ষ লক্ষ মানুষের যোগাযোগের করিডোর হলো পদ্মা নদী। একদিকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া, অন্যদিকে মাওয়ার শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি। নদী পারাপারের প্রধান মাধ্যম ফেরি ও লঞ্চ; তবে যাত্রী ও পণ্যবাহী যান চলাচলের জন্য ফেরিই একমাত্র অবলম্বন, এটি সবচেয়ে নিরাপদ বাহনও বটে। অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় নদীর পাড়ে। মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরত্ব তখন মনে হয় যোজন যোজন দূরের; যেন ‘কূল কিনারা নাই’। ভেবে দেখুন- নদীতীরে বাসের মধ্যে যাত্রীরা অসহায়ভাবে ফেরির জন্য প্রহর গুনছেন, অ্যাম্বুলেন্সে ধুঁকছেন অসুস্থ মরণাপন্ন রোগী, ট্রাকে নষ্ট হচ্ছে পচনশীল শাকসবজি-ফলমূল; তবুও কিছু করার নেই ফেরির জন্য অসহায়ভাবে অপেক্ষা করা ছাড়া। এখন সেই দুঃস্বপ্ন-দুঃসময়ের অবসান ঘটাতে আসছে স্বপ্নের পদ্মাসেতু- আগামী ২৫ জুন ২০২২ যার ওপর দিয়ে যানবাহন (আপাতত ট্রেন ব্যতীত) চলাচল উদ্বোধন করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা; যাঁর হিমাদ্রিঅটল সংকল্প, সদিচ্ছা, সাহস আর প্রজ্ঞাপূর্ণ দূরদর্শিতার ফলে ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’- ঝড়-তুফানে মানুষের বুক কাঁপানো পদ্মানদী আজ মানুষের জ্ঞান, অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও পারঙ্গমতার কাছে পরাভূত- তার ঢেউ-উত্তাল অশান্ত বুকের ওপর আজ সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বাঙালির স্বপ্নের পদ্মা সেতু; হাজার দুঃখ-রজনীর নিকষ অন্ধকার ভেদ করে প্রোজ্জ্বল সূর্যের প্রখর রশ্মির মতো বাঙালির আনন্দ-আপ্লুত হৃদয়ের গহিন ভেতর পর্যন্ত আলো ছড়াচ্ছে- সে-আলো স্বস্তির, সম্ভাবনার, জাতীয় উন্নয়ন-অগ্রগতির, প্রবৃদ্ধির আর শ্লাঘাপূর্ণ সক্ষমতার।

মাওয়া-জাজিরা সংযোগকারী ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পদ্মা সেতু আজ স্বর্ণোজ্জ্বল বাস্তবতা; দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া সংযোগকারী দ্বিতীয় পদ্মা সেতু আগামীর। আমরা আশা করব: সেই সেতুটিও অদূর-ভবিষ্যতে বাস্তব রূপ পাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই হাতে- তাঁর বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত আর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে।

আজকের পদ্মা সেতু কেবল নদীর দু’পাড় সংযোগকারী একটি নিরেট-নিষ্প্রাণ অবকাঠামো নয়; কোটি মানুষের আশা-প্রত্যাশা, স্বপ্ন আর আত্মউজ্জীবনের, আত্মপ্রত্যয়ের গৌরবময় প্রতিভাসও। বিশ্ব ব্যাংকের মতো বিশ্ব-অর্থনৈতিক মোড়ল কোনো কারণ ছাড়াই জাতির আশা-আকাক্ষা ও মান-মর্যাদার প্রতীক সুবিশাল পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় অকস্মাৎ, তাড়াহুড়ো করে, অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায়। দেশিবিদেশি কুচক্রী মহল তখন গোঁফে তা দিয়ে বাঙালির অসহায় পরাজয় আর অপমানের দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় ছিলো। কিন্তু তারা গুরুতর ভুল করেছিলো- বাংলার স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারী বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা যে মতলবি গোষ্ঠীর চক্রান্ত আর অসৎ উদ্দেশ্যের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ না করে পিতার মতোই অনড়-অনমনীয় ভূমিকা গ্রহণ করবেন; আশাহত বাঙালি জাতিকে আশ্বস্ত করে শোনাবেন সেই অমর আশ্বাসবাণী- নিজস্ব অর্থায়নেই নির্মিত হবে পদ্মা সেতু- এ কথা তারা ধারণাও করতে পারেনি। এখন তাদেরই গাত্রদাহ, মনোবেদনা, অনুশোচনা ও জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সময় এসেছে। এজন্যই পদ্মা সেতু শুধু ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকার একটি ভৌত মেগা প্রকল্পই নয়; দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের সম্মান-গৌরব আর মর্যাদারও প্রতীক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমনটি বলেছেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সারাবিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে জাতির সক্ষমতার আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে। [সূত্র: ৩০ মে সেনাসদরদপ্তরের মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে ‘আর্মি সিলেকশন বোর্ড-২০২২’ এর বৈঠকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের অংশ]

পদ্মা সেতু প্রকল্পের সাথে নানাভাবে সরাসরি সম্পৃক্ত- এই মহাপ্রকল্পের কনসালট্যান্ট স্বনামধন্য প্রকৌশলী অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০ ডিসেম্বর ২০১৭ দৈনিক প্রথম আলোর বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘একটি সেতু বদলে দেবে দেশ’ প্রবন্ধে বলেন: ‘এই সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে।…দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবন পাল্টে যাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল কৃষিতে উন্নত।… তাদের কৃষিপণ্য খুব সহজে ঢাকায় চলে আসবে। মংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগর চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।… এই সেতু হলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ উঠে আসবে। কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্য- সব ক্ষেত্রেই এই সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে পদ্মার দুই পাড়ে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের মতো শহর গড়ে তোলার কথাবার্তা হচ্ছে। নদীর দুই তীরে আসলেই আধুনিক নগর গড়ে তোলা সম্ভব।… এই সেতুকে ঘিরে পর্যটনে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। অনেক আধুনিক মানের হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠবে। এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ২০৩৫-৪০ সালে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সে ক্ষেত্রেও এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, স্বপ্নের এই সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।’

পদ্মা সেতু চালু হলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়ার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তার পরিসংখ্যান উঠে এসেছে দেশি-বিদেশি জরিপে। সরকারের সম্ভাব্যতা জরিপে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতুর কারণে দেশের জিডিপি ১ থেকে ১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এতে ওই অঞ্চলের মানুষের আয় বাড়বে ১.৪ শতাংশ এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে ৭ লাখ ৪৩ হাজার। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি- জাইকার সমীক্ষায়ও জিডিপির হার ১.২ শতাংশ বাড়বে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় এই বৃদ্ধির হার ১ শতাংশ বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার একপঞ্চমাংশ বা কমপক্ষে তিনকোটি মানুষ সরাসরি এই সেতুর মাধ্যমে উপকৃত হবে।

এতক্ষণের আলোচনার বিষয়গুলোকে নিম্নোক্তভাবে সংক্ষেপায়ন করা যায় একনজরে বোঝার জন্য- পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলেমিটার। দেশের বৃহত্তম সেতু। নির্মাণ খরচ ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সরাসরি নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপিত হবে রাজধানী ঢাকার সাথে, রাস্তার দূরত্বও অনেকটা কমে যাবে এবং মানুষের ফেরি পারাপারজনিত ভোগান্তির অবসান হবে। উল্লিখিত অঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি মানুষ পদ্মা সেতুর প্রভাবে উপকৃত হবে। ব্যবসায়-বাণিজের ক্ষেত্রে নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। কৃষি ও শিল্পপণ্য পরিবহন এবং লাভজনক বিপণনের পথ প্রশস্ত হবে- বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার সাথে সহজ যোগাযোগের কারণে এসব পণ্য বিপণনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হবে। সেতুকে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠবে- নতুন নতুন হোটেল-মোটেল ও আকর্ষণীয় রিসোর্ট গড়ে উঠবে। এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নতুন নতুন বহু ব্যবসায়, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা ইত্যাদি গড়ে ওঠার ফলে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বার্ষিক জিডিপির হার ১ থেকে ১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে; কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ বলছেন, এই বৃদ্ধি ৩ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে অভাবনীয় বিপ্লব সাধিত হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সাথে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বাড়বে; ওই অঞ্চলে অবস্থিত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা-চট্টগ্রামের বড়ো প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগী হয়ে উঠবে। এতে পণ্যের সার্বিক মান বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের ব্যবসায়িক ক্ষেত্রও বিস্তৃত হবে এবং পদ্মা সেতুর ফলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর মংলার গতিশীলতা বাড়বে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে তাদের পণ্য পরিবহন করে মংলা বন্দর দিয়ে রফতানি ও আমদানি করতে উৎসাহিত হবেন।

পরিশেষে বলব: ‘পদ্মা রে তোর তুফান দেইখা’ আমরা আর ডরাবো না। তোর বুকের ওপর আমরা এখন গড়ে তুলেছি পদ্মা সেতু- আমাদের দিনবদলের স্বর্ণসেতু। জয়তু পদ্মা সেতু! আমাদের গর্ব-অহংকার, মর্যাদা আর উন্নয়নের প্রতীক হয়ে তুমি দাঁড়িয়ে থাকো নির্বিঘ্ন, নিরাপদে- অনেক, অনেক কাল!


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: