বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১:২৯ পূর্বাহ্ন

স্মার্ট বাংলাদেশ – তাসনিম রিদওয়ান

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে ‘রূপকল্প -২০২১’ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন, যার মূল শিরোনাম ছিল ” ডিজিটাল বাংলাদেশ “। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার ও বিকাশের ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়ে ২০২১ সালের মধ্যেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা করে ‘ ভিশন -২০২১’ বা ‘ রূপকল্প -২০২১’ বাস্তবায়নের ঘোষণা করা হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ বির্নিমানের চার স্তম্ভ যথা- কানেক্টিভিটি, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, ই- গভর্নেন্স এবং আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি প্রমোশনের আলোকে বিগত ১৩ বছরে নানা উদ্যোগ ও উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন হওয়ায় দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব প্রসার ঘটেছে।

আজ থেকে ১৩ বছর আগে এই কঠিন কাজটি হাতে নিয়েছিলেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নের রোডম্যাপ ঘোষণা করে ছিলেন। তারপর থেকেই ধারাবাহিক ভাবে ডিজিটাল শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ এখনো ‘ফাইভ জি’ চালুর বিষয় চিন্তাও করেনি।অথচ বাংলাদেশে ইতিমধ্যে ‘ফাইভ জি’ চালু হয়েছে। ২০২৩ সালে আসছে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল।সরকার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট উচ্চগতির ডেটা দিচ্ছে যার মাধ্যমে প্রযুক্তির প্রসার ঘটছে।আগামীর পৃথিবী হবে ডেটা নির্ভর। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকবে। ডেটার চাহিদা পূরনে ইকো সিস্টেম দাঁড় করাতে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক জনগণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে এবং গ্রাহক সাচ্ছন্দ্যে তা গ্রহণ করছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটকে সাশ্রয়ী ও জনবান্ধব করার জন্য ইতিমধ্যে সরকার ‘একদেশ একরেট’ প্যকেজ চালু করেছে।

২০১৮ সালের ১২ মে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ব স্যাটেলাইটের এলিট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সুবিধা এখন দেশবাসী পাচ্ছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম জন্ম থেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত ধরে গড়ে উঠেছে। তাদের কাছে তথ্য প্রযুক্তি খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। অথচ বিষয়টি আজ থেকে এক যুগ আগেও স্বপ্নের মতো ছিলো।

বৈশ্বিক করোনা অতিমারির সময়ে সব কিছু যখন বন্ধ ছিল তখন তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে ব্যবসা বানিজ্য, অফিস আদালত, শিক্ষাসহ অতি প্রয়োজনীয় ও জরুরি সেবা সচল রাখা হয়েছিল। করোনা অতিমারি মোকাবিলায় দেশীয় আইটি প্রকৌশলীদের দ্বারা তৈরি ‘ সুরক্ষা ‘ অ্যাপস চালু করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে ভ্যাকসিন নিবন্ধন, ভ্যাকসিনের তথ্য সংকলন,ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট ইস্যু ইত্যাদি কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের দেশের আইটি প্রকৌশলীরা এ কাজের মাধ্যমে তাদের দক্ষতাই শুধু প্রমান করেননি, এর মাধ্যমে দেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা, দেশপ্রেম এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়েছে। দেশবাসী তাদের এ পরিশ্রমকে কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহন করেছে। করোনাকালীন corona.gov.bd ওয়েব পোর্টালে ৩ কোটি ৭৫ লক্ষেরও অধিকবার তথ্য ও সেবার জন্য নাগরিকগন যুক্ত হয়েছেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যাকে মেশিন ইন্টেলিজেন্সও বলা হয়। কম্পিউটার সায়েন্সের উৎকৃষ্টতম উদাহরণ হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি প্রধানত যে চারটি কাজ করে তা হলো কথা শুনে চিনতে পারা,নতুন জিনিস শেখা, পরিকল্পনা করা এবং সমস্যার সমাধান করা।আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স স্মার্টফোনে ব্যবহার হচ্ছে সুন্দর সেলফি তুলতে, গ্রাহকের অভ্যাস ও প্রয়োজনীয়তা মনে রেখে কাস্টমাইজড সেবা প্রদান করা,ভয়েস শুনে বিভিন্ন সেবা প্রদান ইত্যাদি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়ে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।গত বছর বিজয় দিবসে সিটি ব্যাংক বিকাশে’ র সাথে যৌথভাবে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে। এ ঋণ প্রদানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিকাশ হিসাবধারী বিকাশ অ্যাপ ব্যবহার করে ঋণের জন্য আবেদন করলে সিটি ব্যাংক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে স্বংক্রীয়ভাবে ঋণ মঞ্জুর করে দিবে।এখানে কোন মানুষের সাহায্য লাগবে না।আবেদন করার সাথে সাথে লোন পাওয়া যাচ্ছে। কোন জামানত ও কাগজপত্র লাগছে না।

ব্যাংকের কোন ঋণ প্রসেসিং ফিও নেই।বিকাশ একাউন্ট ব্যালেন্স থেকে মাসিক ভিত্তিতে ঋণ আদায় করা হয়ে থাকে। ইন্টারেস্ট রেটও সহনীয়। ৩৬৫ দিন ২৪ ঘন্টা এ সুবিধা গ্রাহকরা পাচ্ছেন।ব্যাংকিং খাতে এটা একটা যুগান্তকারী কার্যক্রম। এছাড়াও গার্মেন্টস কারখানায় রোবটের ব্যবহার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। ওয়াল্টন কারখানায় ফ্রিজের কম্প্রেসার অ্যাসেম্বেল করতে ব্যবহার করা হচ্ছে রোবোটিক প্রযুক্তি।আইসিডিডিআরবি ‘কারা’ নামে টেলি অপথালমোলজি প্রযুক্তি দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যান্সি শনাক্তের একটি আধুনিক পদ্ধতি চালু করেছে। ‘বন্ডস্টাইন ‘ সফলভাবে মেডিক্যালের প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানোর জন্য আই ও টি ডিভাইসের মাধ্যমে স্মার্ট ট্রাকিং ব্যবহার করে আসছে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মানুষকে ১ শত বছর সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এখনকার প্রজন্ম আগের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত ও সচেতন হচ্ছে। আমাদের শিশু কিশোররা জন্ম থেকেই টেকনোলজির দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। অফুরন্ত সম্ভাবনা নিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বিশ্ববাসীর দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে বাংলাদেশ ইতিবাচকভাবে এ চ্যলেঞ্জ মোকাবিলা করে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বে নিজেকে পরিচিত করতে সক্ষম হবে এটাই প্রত্যাশা।

বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি এবং উদ্ভাবনী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠায় স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১ ভিশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ গঠিত হয়েছে। সরকারের পরবর্তী ভিশন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১’ বাস্তবায়নে ১৪টি কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।আর এসব সিদ্ধান্ত এসেছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’-এর তৃতীয় সভায় । ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১’ এর আওতায় প্রধান অঙ্গ হবে স্মার্ট শিক্ষা, স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট কৃষি , স্মার্ট বাণিজ্য, স্মার্ট পরিবহন ইত্যাদি।অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গড়ে তোলা এবং পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসতে ডিজিটাল ইনক্লুশন ফর ভারনারেবল এক্সেপশন (ডাইভ) উদ্যোগের আওতায় আত্মকর্মসংস্থানভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ।স্মার্ট ও সবত্র বিরাজমান সরকার গড়ে তুলেতে ডিজিটাল লিডারশিপ অ্যাকাডেমি স্থাপন। এটি বাস্তবায়ন করবে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ । শিক্ষার্থীদের অনলাইন কার্যক্রম নিশ্চিতে ‘ওয়ান স্টুডেন্ট, ওয়ান ল্যাপটপ, ওয়ান ড্রিম’ এর আওতায় শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।

যা বাস্তবায়ন করবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ।কুটির, ছোট, মাঝারি ব্যবসাগুলোর জিডিপিতে অবদান বাড়াতে এন্টারপ্রাইজভিত্তিক ব্যবসাগুলোকে বিনিয়োগ উপযোগী স্টার্টআপ হিসেবে প্রস্তুত করা। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে রয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ।অন্টারনেটিভ স্কুল ফর স্টার্টআপ এডুকেটরস অব টুমোরো (এসেট) প্রতিষ্ঠা।এটি বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এটি বাস্তবায়ন করবে।বাংলাদেশ নলেজ ডেভেলপমেন্ট পার্ক নির্মাণ ও পরিচালনা। এটি বাস্তবায়নে থাকছে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ।সেন্টার ফর লার্নিং ইনোভেশন অ্যান্ড ক্রিয়েশন অব নলেজ (ক্লিক) স্থাপন। বাস্তবায়নে থাকছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল।এজেন্সি ফর নলেজ অন অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড স্পেস হরাইজন (আকাশ) প্রতিষ্ঠা। বাস্তবায়নে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ।সেলফ অ্যামপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড এন্টরপ্রেইনরশিপ ডেভেলপমেন্ট (সিড) প্লাটফর্ম স্থাপন। এটি বাস্তবায়ন করবে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ।কটেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড লিংকেজ ল্যাব (সেল) স্থাপন। তথ্যপ্রযুক্তি অধিদপ্তর এটি বাস্তবায়ন করবে।সার্ভিস এগ্রিগ্রেটর ট্রেইনিং (স্যাট) মডেলে সরকারি সেবা ও অবকাঠামো নির্ভর উদ্যোক্তা তৈরি করা। বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ।

সকল ডিজিটাল সেবাকে কেন্দ্রিয়ভাবে সমন্বিত ক্লাউডে নিয়ে আসা। এটি বাস্তবায়নে থাকবে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।ডেটা নিরাপত্তা আইন, ডিজিটাল সার্ভিস আইন, শেখ হাসিনা ইন্সটিটিউট অব ফন্ট্রিয়ার টেকনোলজি (শিফট) আইন, ইনোভেশন ডিজাইন অ্যান্ড এন্টারপ্রেনিওরশিপ অ্যাকাডেমি (আইডিয়া) আইন, এজেন্সি ফর নলেজ অন অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড স্পেস হরাইজন (আকাশ) আইন, ডিজিটাল লিডারশিপ অ্যাকাডেমি আইন ও জাতীয় স্টার্টআপ পলিসি প্রণয়ন। এ বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ।

আমাদের শিশু কিশোররা জন্ম থেকেই টেকনোলজির দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। ২০৪১ এর বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ।ক্ষুধা দারিদ্র মুক্ত বৈসম্যহীন উন্নত বাংলাদেশ,যেখানে বসবাস করবে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: