বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৪৫ পূর্বাহ্ন

পান চাষের ইতিকথা – মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন মুরাদ

পান বাঙ্গালীর সংস্কৃতির সাথে ওতপরিতভাবে মিশে আছে। বাড়িতে অতিথি আসবে আর সেখানে পান থাকবে না, সেটা ভাবাও যায়না। এক কথায় পান ছাড়া অতিথি আপ্যায়ন অসম্পুর্ন থেকে যায়। পান চাষ প্রথম কবে কোথায় শুরু হয়েছে তাহা সঠিক ভাবে যানা না গেলেও , এই উপমহাদেশের প্রচীন জমিদার গন তাদের পানশালায় আয়েশ করে পানের আসর বসাত আর পানের সাথে ব্যবহার করতো একধরনের সুগন্ধি মসল্লা । এই মসল্লার প্রচলন ওলন্দাজ বনিকেরাই প্রথম শুরু করেছিল বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে এখন পানের ব্যবহার শুধু যে পানশালার মধ্যে সিমাবদ্ধ রয়েছে তাহা কিন্তু নয়। এর ব্যবহার পৃথিবী ব্যাপি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কারণ পান শুধু যে ললনাদের ঠোটই রাঙ্গায় না, এর বহুবিধ ব্যবহারে পান চাষিদের কদর বেড়েছে, বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই কমবেশী পানের চাষ হয়ে থাকে। কিন্তু খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, ঝিনাইদাহ, চুয়াডাংগা, কুষ্ঠিয়া,ভেরামারা, বরিশাল ও পিরোজপরে ব্যাপক চাষাবাদ হয়ে থাকে। পান চাষের জন্য বেলে ও দোয়াশ মাটিই উৎকৃষ্ট।

পান চাষের জন্য প্রথমেই মাটি তৈরী করতে হয়। মাটি তৈরী করার সময় পরিমান মত সার ও পানি নিস্কাশনের জন্য নালা তৈরী করতে হয়। অপেক্ষাকৃত উচুস্থানে যেখানে বৃষ্ঠি ও বন্যার পানি দ্বাড়ায় না বা নালা দিয়ে পানি নিস্কাশনের ব্যাবস্থা আছে সেখানেই পানের বরজের জন্য উৎকৃষ্ট স্থান। মাটিতে পরিমানমত খইল, ঝঝচ, গটচ ও ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়, জমিতে যাতে পানি জমতে না পারে তার জন্য প্রতি ৬০ সেন্টিমিটার পরপর ২০ সেন্টিমিটার চওড়া নালা খনন করতে হবে এবং ঐ নালার মাটি তুলে উচুস্থানে পান বপন করতে হয়। এক্ষেত্রে ২৫/৩০ সেন্টিমিটার আয়তনের চাড়া রোপন করতে হবে। চারা রোপনের ক্ষেত্রে কমপক্ষে চাড়ার ২টি গীটা মাটির ভীতর গেড়ে দিতে হবে। বর্ষা মৌসূমের শুরুতেই চাড়া রোপনের উৎকুষ্ট সময়। রোপনের ১ সপ্তাহের মধ্যেই দিনে ২ বার পানি সেচের ব্যাবস্থা করতে হবে। পানের চাড়া বড় হলে অর্থাৎ কোর ছারলে বুঝতে হবে চাড়া মাঠিতে শিকর গজিয়ে শক্ত হয়েছে। এ অবস্থায় পানি সেচ ব্যাবস্থ অব্যহত রাখতে হবে। চাড়া রোপনের সাথে সাথে পানকে অতিরিক্ত কুয়াশা, তাপ , বৃষ্ঠি ও বাতাষ থেকে রক্ষা করার জন্য বরজের চারিপাশে পাঠকাঠি, খেজুরের বাইল ও ছন জাতীয় উদ্ভিদ দ্বারা বেড়ার ব্যাবস্থা করতে হবে। উপরে খেজুরের বাইল বা ছন দ্বারা ছাউনির ব্যবস্থা করতে হবে।এতে পান গাছ অতিরিক্ত শীত তাপ ও চোরের উপদ্রপ থেকে সুরক্ষিত থাকবে।

পান একটু বড় হলে এক ধরনের ছত্রাকের আক্রমন দেখাদেয়। এ ছত্রাক দমনে ডায়োথিন গ-৪৫ প্রয়োগ করা যেতে পারে। পান যেহেতু সরাসরি কাচা চিবিয়ে থেতে হয় তাই কোন ক্ষেত্রেই পানের পাতায় অতি বিষাক্ত কীট নাশক প্রয়োগ করা যাবেনা।পানের লতা বড় হতে হতে ছাদ পর্যন্ত উঠে গেলে সেখানে থেকে পানের লতা নিচে নামিয়ে মাটির সাথে ঘুড়িয়ে বেধে দিতে হবে।সেক্ষেত্রে নিচের পান গুলো ভেঙ্গে বাজার জাত করা যেতে পারে। এই ভাবেই চলে পানের পরিচর্যা। একজন কৃষক ইচ্ছা করলে প্রতি সপ্তাহে পান ছেটে বাজার জাত করতে পারেন। তবে ছাদ থেকে নামিয়ে যে সকল লতা মাটির সাথে পেচিয়ে দেওয়া হয় তা পুররায় মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। পান সংগ্রহের সময় তিনটি পর্যায়ে পানকে ভাগ করে বাজার জাত করা হয়। যেমন বলি , মাঝারি ও চাপিল পান।

১৯২ বিরায় ১ গাদি ও ৭২ টি পানে ১ বিরা হিসাবে ধরা হয়। ১ পোন ১৫০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি করা হয়। সে হিসাবে ১ বছরে ১ বিঘায় আয় করা যায় , ১ লক্ষ থেকে দেড় লক্ষ টাকা। বর্তমানে কুষ্ঠিয়া দিনাজপুর সহ বাংলাদেশের কয়েকটি স্থানে পরীক্ষা মুলক ভাবে হাইব্রিড পান চাষ শুরু করা হয়। ভারত থেকে এই হাইব্রিড পানের চাড়া ক্রয় করে আনতে হয়। সেক্ষেত্রে একটি চাড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা দাম পড়ে। ২.৫ হাত পরপর এ চাড়া রোপন করতে হয়। এবং ছত্রাক নাশক ঔষধ দিয়ে চাড়াগুলো শোধন করে নিতে হয়। এতে রোগ বালাই কম হয়। আকারে পান অনেক বড় হয়। সুতরাং বাজারে এসব পানের দাম বেশী পাওয়া যায়। এই পানে সেচ ও কিটনাশক প্রয়োগ বেশি পনিমানে করতে হয় ফলে চাষে খরচের পরিমাণ বেশি হয়। এছাড়াও দেশী পানের স্বাদের সাথে এটা কুলিয়া উঠতে পারেনা বলে কৃষকগন হাইব্রিড পান চাষে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেনা বলে যানাগেছে। পান দিয়ে ভেষজ মেডিসিন তৈরী করা হয।পানের রসে হজম শক্তি বৃদ্বি পায়। গলা ব্যাথা ও কোষ্ঠ কাঠিন্য দুর হয় । ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে থাকে বলে কাচা পানের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলীয় জেলা গুলোতে পান চাষের ব্যাপক প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে কৃষি গবেষনা কেন্দ্র গুলো এক ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। তারা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাধ্যমে পান ও সুপারী চাষে কৃষকদের পরামর্শ ও উন্নতজাতের চাড়া প্রদান করে প্রয়োজনীয় ঔষধ পত্র কীটনাশক ও সার প্রদান করে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় অনেক কৃষক সফলতা পেয়েছেন বলে কৃষকদের সাথে আলোচলা করে যানা গেছে।

পান চাষিরা পানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে হতাশায় জর্জরিত। একশ্রেনীর মধ্যোসত্যভোগী, দালাল, ও ফরিয়াদের কারণে কৃষকগন ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই সকল দালাল গন পাইকারদের সাথে যোগসাযোগের মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে আড়ৎ থেকে কম দামে অথবা বাকীতে কৃষকদের কাছ থেকে পান ক্রয় করেন পরে তারা উচ্চমুল্যে পাইকারদের কাছে পান বিক্রি করে থাকেন। অনেক সময় ঐ সকল ফরিয়ারা কৃষকদের বাকিটাকাও বছরের পর বছর পরিশোধ করেন না। ফলে পান চাষিরা পান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। বাহিরের দেশগুলোতে পান চাষিদের উৎসাহ প্রদানের জন্য ব্যাংক লোনও প্রনোদনার ব্যাবস্থা থাকলেও বাংলাদেশের পান চাষিরা ন্যায্য মুল্য পাচ্ছেনা। এছাড়াও নির্মান স্বামগ্রীর যেমন বাশ, ঝাটি, পাটখড়ি.উলু পলিথিন প্রভৃতির দাম বেড়ে যাওয়ার কারনে পান চাষিয়া পান চাষে নিরুৎসাহিত হয়ে পরছে।
এ ক্ষেত্রে এই অর্থকরী ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি রাখার বৃহত্তম স্বার্থে পান চাষিদের বিনা সুদে লোন প্রদান করা , প্রশিক্ষনের ব্যাবস্থা করা ও পান বিক্রির ক্ষেত্রে মধ্যোসত্যভোগী ফরিয়াদের উৎপাত বন্ধ করা সহ নির্মান সামগ্রী যেমন বাশ, পাঠখড়ি, যাহা সহজেই পচনশীল এই সমস্ত সামগ্রী দীর্ঘ মেয়াদী ব্যবাহারের জন্য ট্রিটমেন্ট প্লান সিস্টেম চালু করা দরকার। তাহলে পান চাষিয়া তাদের ক্ষতি কুলিয়ে উঠে নিজেরা যেমন লাভবান হতে পারবে তেমনি বাংলাদেশ সরকারের পান সম্পদ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ সুগম হবে।

মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন মুরাদ


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: