২০১৯ সালের কোভিড অতিমারির কারণে দেশে দেশে যে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হয় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে। এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু। বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনীতিতে এর যে নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল তন্মধ্যে অন্যতম ছিল বৈদেশিক মুদ্রার সন্তোষজনক রিজার্ভ এর পরিমাণ কমে যাওয়া। কারণ ছিল আশানুরূপ রেমিট্যান্স না আসা, রপ্তানি আয় কমে যাওয়া এবং ডলারের চাহিদা হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়া। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে এই ডলার সংকট হ্রাস পেলেও তা সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত না হওয়ায় সরকার প্রচলিত পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) বা ভৌগোলিক নির্দেশনামূলক পণ্য তদ্রূপ অপ্রচলিত রপ্তানি পণ্য।
কোনো দেশের জি আই পণ্য দেশটির সাদৃশ্যহীন গুণাবলী সম্পন্ন যথা জলবায়ু, মাটি, সংস্কৃতি, সামাজিক প্রথা, উৎপাদনের বিশেষ প্রক্রিয়া ও দক্ষতা এমনকি বংশ পরম্পরায়া পেশাগত ঐতিহ্যের সমাহার যা স্থানীয় অধিবাসী এবং পণ্যটির মধ্য এক গভীর যোগসূত্র স্থাপন করে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে জি আই পণ্য মেধাসম্পদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এটি কোনো দেশের মূল্য সংযোজন প্রক্রিয়ার অংশ।এভাবে ট্রেডমার্কস এর মত জি আই ও একটি ব্রান্ড। যা কোনো ক্রেতার সুনির্দিষ্ট চাহিদা বা স্বাদ পূরণ করার ক্ষেত্রে একটি উপযোগী পণ্য হিসেবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠে।
উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় আন্তর্জাতিক বাজারে এমনকি স্থানীয় বাজারেও ইলিশ মাছ বেচাকেনা হয় । তবে পদ্মার ইলিশ এর যে স্বাদ তা বাংলাদেশের ইলিশ। বিশেষ এই প্রজাতির মাছের উৎপাদন পদ্মা অববাহিকায় মিঠা পানিতে। এক্ষেত্রে বাংলাদশের ইলিশ নামকরণ হলেই শুধু ভোক্তাগণ এই সুস্বাদু মাছ খেতে সমর্থ হন। এশীয় দেশসমূহের জন্য বাণিজ্যভিত্তিক এই বাস্তবতা সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকর ছিলনা। তবে সাম্প্রতিক কালে এই ভৌগোলিক নির্দেশনা পণ্যে সমূহের সুরক্ষায় স্থানীয়ভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এখন পর্যন্ত ভারতে কৃষি, খাদ্য, অলংকার আসবাবপত্র শাখার ২ শতাধিক পণ্য নিবন্ধিত হয়েছে জি আই পণ্য হিসেবে, যেখানে বাংলাদশে এই সংখ্যা মাত্র ১১ টি।
তবে একটি গবেষণায় দেখা যায় খাদ্য সামগ্রী, হস্তশিল্প, তাঁতবস্ত্র সম্পর্কিত দেশের প্রায় ৭৩ টি পণ্যই নিজস্বতা থাকায় তা নিবন্ধনের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নিবন্ধিত জি আই পণ্য হচ্ছে জামদানি, ইলিশ, ক্ষীরশাপাতি আম, বিজয় পুরের সাদা মাটি, দিনাজপুরের কাটারি ভোগ চাউল, কালিজিরা, রংপুরের শতরঞ্জি, রাজশাহী সিল্ক, মসলিন ও ফজলি আম। ২০১৬ সালে জামদানি শাড়ি প্রথম এই স্বীকৃতি পায়। সবশেষ ২০২২ সালে এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাগদা চিংড়ি এবং ফজলি আম।
মেধাসম্পদের আওতাভুক্ত হওয়ায় জি আই পণ্য কতিপয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন এবং নির্দেশনার আওতায় চিহ্নিত হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ হচ্ছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, ট্রিপস এবং উইপোভুক্ত কতিপয় চুক্তি। এভাবে জি আই পণ্যের ক্ষেত্রে যে কোনো জটিলতা বা মালিকানা নির্ধারণে আন্তর্জাতিক সংস্থা বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরুপ বাসমতী চাউলের মালিকানা নিয়ে ভারত পাকিস্তানের স্বত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ত বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের উইপো (WIPO)। উইপোর নিয়ম মেনে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) এই মেধাস্বত্ত স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে।
কোনো পণ্য জি আই স্বীকৃতি পেলে বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। এ পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। কিন্তু, বাংলাদেশি পণ্যগুলোর এখনও কোনো বড়ো সাফল্য বা এ সকল পণ্যের রপ্তানি বাড়েনি। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন জি আই স্বীকৃতি পাওয়ার পর এসব পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে চেষ্টা চলছে।এখনও অর্থনীতিতে বড়ো অবদান না রাখলেও এগুলো নিয়ে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করনে অর্থনীতিবিদরা। স্বীকৃতি পাওয়ার পর এসব পণ্য উৎপাদনের সুযোগ সুবিধা বাড়ানোরও পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি এসকল পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের পরিচয় তুলে ধরবে বলেও মনে করেন তারা।
এটি স্বীকার্য যে বাংলাদেশ জি আই অ্যাক্ট এবং জি আই বিধিমালা জারির পর বহু পুরোনো ও নিজস্ব পণ্যগুলি সুরক্ষার সুযোগ অবারিত হয়েছে। নিজ দেশের পাশাপাশি অন্য কোনো দেশের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার শর্তে সে দেশেও রপ্তানির সুযোগ ঘটে। তবে একটি দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় জি আই অ্যাক্ট ২০১৩ জারি করা একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র। কেননা শুধু জি আই অ্যাক্ট জারির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী পণ্যটির সুরক্ষা সম্ভব নয় এর জন্য সম্ভাব্য সকল পণ্য চিহ্নিত করে জি আই ভুক্ত করতে হবে। এজন্য বহুল প্রচার ও গবেষণার মাধ্যমে জি আই নিবন্ধনের গুরুত্ব প্রদানে সংশ্লিষ্ট মহলকে সচেতন করতে হবে।
দ্বীতিয়তঃ জি আই পণ্যের কার্যকর বিপণনে একক বা যৌথ উৎপাদনের উভয় ক্ষেত্রেই মার্কেট শেয়ারের জন্য বিপণন পরিকল্পনা অপরিহার্য । জি আই পদ্ধতির অনুসরণে আন্তর্জাতিক বাজার বাস্তবতা, সমন্বয়, এবং ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে যথার্থ বিপণন পরিকল্পনা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। তন্মধ্যে পণ্য পৃথকীকরণ, ভোক্তা আচরণ, ভ্যালু চেইন, সমন্বিত বাজার ব্যবস্থা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। নতুন যে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই এসকল বাজার প্রভাবকারী উপাদানসমূহের পর্যালোচনা অত্যাবশ্যক।
তৃতীয়তঃ জি আই পণ্য উৎপাদকগণ মধ্যস্বত্বভোগিদের নেতিবাচক আচরণের স্বীকার। সরবরাহ চেনের এই চ্যালেঞ্জ থেকে তাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী পণ্যের মর্যাদা রক্ষা ও উৎপাদক শ্রেণিকে উৎসাহিত করার জন্য সমগ্র জি আই পদ্ধতির পক্ষে কার্যকর ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা জরুরি। এভাবে দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের জি আই পণ্য বিপণনের জন্য এ খাতের সার্বিক পর্যালোচনাভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণের বিকল্প নেই।
যেহেতু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় জি আই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া গিয়েছে সে কারনে রপ্তানিপণ্যের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে সরকারের রপ্তানি আয় বৃদ্ধির অংশ হিসেবে এ সকল পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট মহলকে এগিয়ে আসতে হবে।