শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১১:২৮ অপরাহ্ন

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কেটে রেস্টুরেন্ট

নিউজ ডেস্ক :: হাজারো সবুজ বৃক্ষের সুশীতল ছায়াঘেরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রাজধানী ঢাকার একটি সুপরিসর প্রাকৃতিক এলাকা। বাংলাদেশ ও বাঙালির উত্থান এবং ধারাবাহিকতার কালসাক্ষীও এই নগর উদ্যান। ১৬১০ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই উদ্যান গড়ে ওঠে। প্রায় দুই কোটি মানুষের এই মহানগরের অন্যতম ফুসফুস এ উদ্যানের বৃক্ষরাজি। নগরী থেকে বিলুপ্ত বিভিন্ন গুল্ম, ফার্ন, ছত্রাক, লাইকেন, অণুজীব, পাখি, বেজি, কাঠবিড়ালি, সাপ, বাদুড়, প্রজাপতি, মৌমাছি, কেঁচোসহ নানা প্রাণীর আবাসস্থলও এটি।

সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবার শতাধিক গাছ কেটে নির্মাণ করা হচ্ছে সাতটি রেস্টুরেন্টসহ জনসাধারণের চলাচলের জন্য ‘ওয়াকওয়ে’। গত কয়েক দিনে উদ্যানের ৩৮টি গাছ কাটা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় লাল ‘ক্রস’ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে আরও কমপক্ষে ৪০টি গাছ। কয়েক দিন ধরেই এর প্রতিবাদ জানিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন দেশের পরিবেশবাদী, মুক্তবুদ্ধিজন, শিল্পী-সাহিত্যিক, সংস্কৃতিজন, সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্টসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। উদ্যান এলাকাকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত না করে আগামী বর্ষায় এখানে আরও ১০ হাজার নতুন বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় বৃক্ষ লাগানোর দাবি জানিয়েছেন তারা।

গত কয়েক মাসেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কাটা হয়েছে মাঝারি আকৃতির প্রায় অর্ধশত গাছ। তবে করোনা সংক্রমণজনিত পরিস্থিতিতে চলমান লকডাউনে নগরবাসীকে অন্ধকারে রেখে এবার বড় বড় গাছ কাটা হচ্ছে। আর এ কর্মযজ্ঞ চলছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ ও সংরক্ষণ প্রকল্পের (তৃতীয় পর্যায়) আওতায়, যা বাস্তবায়ন করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। অথচ উদ্যানের গাছগুলো বাঁচাতেই ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’ নির্মাণ করা হয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ চত্বরের ভূগর্ভে। প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ এটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।মহানগরী ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আগে রমনা রেসকোর্স নামে পরিচিত ছিল। ডাকা হতো রমনা জিমখানা নামেও। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্থানটির নামকরণ করেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ বাঙালির জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই ডাক দিয়েছিলেন বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তি-সংগ্রামের। ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর এ উদ্যানেই আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ১৯৯৯ সালে এখানে নির্মাণ করা হয় ‘শিখা চিরন্তন’।

গাছ কাটার প্রতিবাদে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গতকাল বিকেলে সমাবেশ করেছেন বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে কবি, চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পীসহ সর্বস্তরের জনগণ। বক্তারা বলছেন, বিশাল বিশাল গাছ কেটে ফেলায় এখনকার পাখি ও প্রাণীগুলো আজ বিপন্ন। নগরবাসীও উদ্বিগ্ন। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) একটি প্রতিনিধি দলও গতকাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পরিদর্শন করেছে।

গাছ কাটার বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি হবে আন্তর্জাতিক মানের। বিদেশিরাও এখানে ঘুরতে আসবেন। এ জন্য কিছু স্থাপনা নির্মাণের প্রয়োজনে গাছ কাটা হচ্ছে।’ মন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকেও গাছ কাটার বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কিছু গাছ কাটা হচ্ছে। তবে এরই মধ্যে উদ্যানে এক হাজার গাছ লাগানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা কোনোমতেই সমর্থন করা যায় না। কেননা, ঢাকা শহর এমনিতেই গাছশূন্য হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে আমরা ওসমানী উদ্যানের গাছগুলো রক্ষা করেছিলাম। সেখানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা হবে- এটা ভাবা যায় না। এমন হলে নগরবাসী যাবে কোথায়?’ তিনি বলেন, ‘মানুষ বিশ্রাম নিতে, একটু স্বস্তির জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যায়, বিভিন্ন পার্কে যায়। দিনে দিনে সেই উদ্যানগুলো, পার্কগুলো নষ্ট করা হচ্ছে। ওসমানী উদ্যান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কোনোটিই এখন আর আগের মতো নেই। নানাভাবে এগুলোর ক্ষতি করা হয়েছে। নগরবাসীর বিচরণের উন্মুক্ত জায়গাগুলো নষ্টের এই অপতৎপরতা বন্ধ করা দরকার।’

এ প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক ও নিসর্গপ্রেমী বিপ্রদাশ বড়ূয়া বলেন, ‘কোনোভাবেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা যাবে না। উদ্যানের খোলা মাঠ, বৃক্ষরাজি, জলাধার যেটা যেমন আছে, তেমন রেখেই যা কিছু করার করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গাছ না কেটেই ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। প্রকল্প-সংশ্নিষ্টরা চাইলে গাছগুলো রেখেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনাগুলো নির্মাণ করতে পারেন।’

সরেজমিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে দেখা যায়, করোনার কারণে উদ্যানে বাইরের মানুষজনের চলাচল নেই। কারণ, সব ফটকেই তালা দেওয়া রয়েছে। নির্মাণ প্রকল্প-সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। অবশ্য ভাসমান কিছু মানুষ উদ্যানের বিভিন্ন জায়গায় শুয়ে আছেন। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে উদ্যান নতুন করে সবুজ হয়ে উঠেছে। উদ্যানে দেখা মেলে নানা পাখি ও কাঠবিড়ালির। একটু ভেতরের দিকে যেতেই নজরে আসে কেটে রাখা অনেক গাছের গুঁড়ি ও ডালপালা। চোখে পড়ে লাল ‘ক্রস’ দিয়ে চিহ্নিত করা অসংখ্য গাছ। বিভিন্ন স্থানে মাটিতে পড়ে রয়েছে সবুজ ডালপালা, পাতাসহ কেটে ফেলা গাছ। কোনো কোনো জায়গায় আধুনিক মেশিন (করাত) দিয়ে বড় বড় গাছ কাটা হচ্ছে। কোনো কোনো জায়গায় কুড়াল দিয়েও গাছ কাটছেন শ্রমিকরা। কতগুলো গাছ কাটা হয়েছে বা হবে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন স্থানের কেটে নেওয়া গাছের গুঁড়ি গুনে দেখা যায়, গত কয়েক দিনে কমপক্ষে ৩৮টি গাছ কাটা হয়েছে। উদ্যানের বিভিন্ন স্থানে, এমনকি খোলা মাঠেও মাটি কেটে রাস্তা (ওয়াকওয়ে) নির্মাণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় রড, সিমেন্ট ও বালু মজুদ রেখে পিলার নির্মাণ ও ঢালাইয়ের কাজ চলছে। উদ্যানে বড় করে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে’।

উদ্যানে নির্মাণ-সংশ্নিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে আলাপে জানা যায়, স্থাপত্য অধিদপ্তর থেকে নির্মাণকাজের জন্য তাদের যে নকশা দেওয়া হয়েছে, সেটি অনুযায়ী উদ্যানের মধ্যে সাতটি রেস্টুরেন্ট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। টিএসসি, রমনা কালীমন্দির, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন ও শিশুপার্কসংলগ্ন প্রবেশদ্বারের পাশে রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের কাজ এরই মধ্যে অনেকটাই এগিয়েছে। এই রেস্টুরেন্টগুলোতে আসার জন্য ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজও সম্প্রতি শুরু হয়েছে। পার্কের বিভিন্ন স্পটে ব্যায়াম করার জন্যও স্থাপনা নির্মিত হবে। আর এসব কাজের জন্য গাছগুলো কাটা হচ্ছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গগনচুম্বী গগনশিরীষ, সেগুন, মেহগনিসহ শতাধিক গাছ এরই মধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি শতবর্ষী গাছও রয়েছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৮ জুলাই স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থান, বধ্যভূমিসহ সংশ্নিষ্ট ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। রায়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণস্থলসহ ১০টি স্থান সংরক্ষণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ওই রায়ের ধারাবাহিকতায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে এ কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা সংরক্ষণের বিষয়ে হাইকোর্টে রিটকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, শুধু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা নির্মাণের জন্য প্রয়োজনে গাছ কাটা যাবে। কিন্তু রায়ের নির্দেশনার বাইরে গিয়ে কতিপয় ব্যক্তির ব্যবসায়িক স্বার্থে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ব্যবহার করা হচ্ছে, গাছ কেটে রেস্টুরেন্ট বানানো হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আদালত অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হবে।’

জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী শামিম আখতার বলেন, গাছ কাটার জন্য সরকারের নিয়ম রয়েছে। এখানে তার বাইরে কিছু করা হচ্ছে না।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক ঢাকার বিরল ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সবুজ অঞ্চল। এ অঞ্চলে গাছ কেটে রেস্টুরেন্ট ও স্থাপনা নির্মাণ ভয়ংকর রকমের অপরাধ। তিনি বলেন, যারা ঢালাওভাবে গাছ কেটে স্থাপনা নির্মাণ করে, তাদের কঠোরভাবে অনুশাসনে আনা প্রয়োজন। সৌন্দর্যবর্ধন বৃক্ষরোপণের মধ্যে নিহিত; নিধনের মধ্যে নয়।

গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, কাটা গাছগুলো দেখলে বুঝতে পারবেন, কী অন্যায় হয়ে গেছে। আমরা সেখানে প্রতিবাদ করলেও তারা তাদের কাজ বন্ধ করেনি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, স্বাধীনতা প্রকল্পের দুটি পর্যায়ে ১৯৯৮ সাল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গ্লাস টাওয়ার, শিখা চিরন্তন, স্বাধীনতা জাদুঘর, ফোয়ারা, জলাধার ও উন্মুক্ত মঞ্চ এরই মধ্যে তৈরি করা হয়েছে। এবার প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য শিশুপার্ক ভেঙে নতুন করে সাজানো হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ স্থান, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণস্থলসহ ১০টি স্থাপনা হচ্ছে। পাশাপাশি নির্মাণ হচ্ছে থিম পার্ক, ৫৭০টি গাড়ি রাখার ভূগর্ভস্থ পার্কিং, লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো, ফোয়ারাসহ অনেক কিছু। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জায়গায় নির্মিত শাহবাগ থানা এবং শিশু একাডেমিও স্থানান্তরের কার্যক্রম চলছে। এ জন্য চলতি অর্থবছরে প্রকল্পের তৃতীয় ধাপের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: