শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১০ অপরাহ্ন

টিকেট নোয়াখালীর নামতে হবে মাইজদী-মাহবুবুর রহমান তুহিন

সমুদ্রস্নাত নোয়াখালী এ পলল ভূমির এক সমৃদ্ধ জনপদ। অসংখ্য জ্ঞানী, গুনী এ পূণ্যভূমিতে জন্মগ্রহণ করে এ মাটিকে ধন্য করেছেন। অপরিসীম সাহস আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার জন্য এ জেলার মানুষ সর্বত্র সুপরিচিত। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস আর ভাঙনের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকা মানুষগুলো যেখানে যায় সেখানকার ড্রাইভিং সিটে বসে যায়। এখানাকার অধিবাসীরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বহু শিল্প-কারখানা স্থাপন করেছে। এগুলো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশাল অবদান রাখছে। এ জন্য নোয়াখালীকে রয়েল ড্রিস্ট্রক্ট বলা হয়ে থাকে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল নোয়াখালী আসলে আপনি নোয়াখালী পাবেন না।

জেলার নামেই বাংলাদেশের জেলা শহরগুলোর নাম। নোয়াখালীই একমাত্র জেলা, যার জেলা শহরের নাম জেলার নামে নয়। এ জেলা শহরের নাম মাইজদী।

অন্তরালে নোয়াখালী :

নোয়াখালী জেলার পত্তন হয় ১৮২১ সালে। ব্রিটিশ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ১৮২২ সালে নোয়াখালীর জন্যে একটি জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের পদ সৃষ্টি করে। একজন স্বতন্ত্র কালেকটর নিযুক্ত হয় ১৮৩০ সালে। জেলা হিসেবে নোয়াখালী পূর্ণ মর্যাদা লাভ করে ১৮৭৬ সালে। ঐ বছরেই নোয়াখালীতে একজন সেশন জজ ও সিভিল জজ নিয়োগ করা হয় এবং প্রথম পৌরসভা গঠিত হয়। সুধারাম মজুমদার নামে এক ব্যক্তির দানকৃত স্থানে শহরটি স্থাপিত হয়েছিল বলে প্রথম থেকেই এই শহর সুধারাম নামে পরিচিতি লাভ করে। নোয়খালী শহর গড়ে উঠেছিলো সোনাপুর থেকে দক্ষিণদিকে। শ্রী জীতেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত তাঁর নোয়াখালীর স্মৃতিকথায় জানান, ‘নোয়াখালী শহরের পূর্বাংশকে যেমন কালিতারা বলা হইতো সে রকম শহরের পশ্চিমাংশকে পশ্চিমপাড়া ও উত্তরাংশকে মন্তিয়ার ঘোনা এবং দক্ষিণাংশকে বড় দীঘির পাড় বলা হইত।‍‍’

১৯২২ থেকে ১৯৩২ এবং ১৯৪৮ থেকে পর্যায়ক্রমে মোট চারদফা ভাঙনের পর নোয়াখালী শহরটি হারিয়ে যায় ভূ-পৃষ্ঠ থেকে। নোয়খালী শহর নদীগর্ভে বিলুপ্তির কাজটি ত্বরান্বিত করে নোয়াখালী খাল। সাগরের প্রবল জোয়ার এই খালটির মধ্যদিয়ে এসে জেলার তীরবর্তী এলাকায় প্রচন্ডভাবে আঘাত হানতো। নদীর ভাঙন যখন নোয়াখালী শহরকে গ্রাস করতে উদ্যত ঠিক সে সময়ে দীর্ঘ প্রবাস জীবনযাপনের পর সুধারামে ফিরে এসেছিলেন খ্যাতনামা প্রকৌশলী ওবায়দুল্লাহ। নদীর ভাঙন থেকে নোয়াখালী শহরকে রক্ষার জন্য তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে দেন দরবার শুরু করেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার বাঁধ দিয়ে শহর রক্ষা করা সম্ভব নয় বলে অভিমত প্রদান করলে প্রকৌশলী ওবায়দুল্লাহ নিজ উদ্যোগে ও অর্থব্যয়ে কয়েক হাজার শ্রমিকের সাহায্যে মন্তিয়ার ঘোনার মুখে একটা বিরাট বাঁধ নির্মাণ করেন। ওবায়দুল্লাহর মৃত্যুর পর নানা কারণে সেই বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে অচিরেই শহরটি মেঘনায় বিলীন হয়ে যায়। নদী ভাঙনের পর সোনাপুর থেকে দত্তের হাট পর্যন্ত পুরনো শহর তথা পৌরএলাকার ভগ্নাংশটুকুই অবশিষ্ট থাকে। কালিতারা বাজারের কাছে মিউনিসিপ্যালিটির যে শেষ লাইটপোস্ট ছিলো, ঠিক ওখানে গিয়েই নদীর ভাঙনটা বন্ধ হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন উপকূল হিসেবে সোনাপুর রক্ষা পেলো। আর মূল শহরটা শুধু পৌরসভা সীমারেখা বরাবর বিলুপ্ত হয়ে যায়।

নোয়াখালী শহর নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার ঘটনা অবলম্বন করে পল্লী-কবি শহরের আরাধ্যা দেবী বিদ্যেশ্বরীকে উদ্দেশ্য করে গান রচনা করলেন-

‘নোয়াখালী খালি করে কি দোষে বিদ্যেশ্বরী,

যেতেছ বসতি ছাড়ি।

মাগো গেল লোকের ঘরবাড়ি;

আদালত গিয়েছ, কালেক্টরী ফৌজদারী;

নদীতে সব গেল পড়ি।‌‌’

মাইজীতে বসতি :

পুরনো শহর নদী গর্ভে বিলুপ্ত হওয়ার পর ১৯৫০ সালে জেলার সদর দপ্তর অস্থায়ীভাবে মাইজদীতে স্থানান্তর করা হয়। ক্রমান্বয়ে এখানে বসতি ও জনপদ গড়ে ওঠে। ১৯৫৩ সালে শহরের পুরনো এলাকা কালিতারা, সোনাপুর ও মাইজদীসহ কাদির হানিফ ইউনিয়নের কয়েকটি মৌজা নিয়ে গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে নোয়াখালী পৌর এলাকা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সুদীর্ঘ প্রায় একযুগ পর্যন্ত মাইজদীকে নোয়াখালী জেলার সদর দপ্তর হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি বিতর্কিত অবস্থায় ছিলো। অবশেষে ১৯৬২ সালে মাইজদীকে নোয়াখালী জেলার স্থায়ী সদর দপ্তর হিসাবে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

পঞ্চাশের দশকে মূল নোয়াখালী মেঘনা আর সাগরে বিলিন হয়ে গেলে ব্রিটিশদের পরিকলপনায় নতুন করে এ শহরের পত্তন হয়। নোয়াখালী শহর যখন ভেঙ্গে যাচ্ছিলো তখন মাইজদী মৌজায় ধান ক্ষেত আর খোলা প্রান্তরে পুরাতন শহরের ভাঙ্গা অফিস আদালত গুলো এখানে এনে স্থাপন করা হয়। শহরের প্রাণ কেন্দ্রে প্রায় ষোলো একর জুড়ে কাটা হয় এক বিশাল দীঘি। লোক মুখে প্রচলিত হয় বড় দীঘি নামে। সে দীঘির চতুর্দিকে চক্রাকারে বানানো হয় ইট সুরকীর রাস্তা। সে রাস্তাকে ঘিরে বাংলো প্যাটার্নে তৈরী হয় সরকারি সব দপ্তর। এই দীঘিটি ব্যবহৃত হতো মূলত: শহরে জলাধার হিসেবে, দীঘিতে পাম্প লাগিয়ে বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালত এবং আবাসিক এলাকায় পানি-সরবরাহ করা হতো। পাশাপাশি দীঘিটি ছিলো নতুন গড়ে ওঠা শহুরেদের একমাত্র চিত্তাকর্ষণের স্থান।

মাইজদী না নোয়াখালী :

প্রফেসর প্রদীপ কান্তি মজুমদার। ছিলেন নোয়াখালি কলেজের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান। তিনি কমলাপুর থেকে নোয়াখালী আসার জন্য টিকিট নেন। কিন্তু টিকেটে নোয়াখালীর নাম ছিল না। লেখা ছিল ঢাকা-সোনাপুর। কাউন্টারে বিষয়টি জানাতেই বলা হল, ওটাই ঠিক আছে সোনাপুর মানে নোয়াখালী। তিনি কিছুটা দ্বিধা নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর পাশের যাত্রীর সাথে আলাপচারিতায় জানলেন ‘নোয়াখালী যেতে হলে, সোনাপুর না, নামতে হবে মাইজদী। চৌমুহনী পার হওয়ার পর অন্য এক যাত্রীর বলল তার বাসা মাইজদী স্টেশনের পাশে। কিন্তু এ ট্রেন মাইজদী স্টেশন থামবে না। তখন তিনি অসহায়ের মত জানালেন তিনিও মাইজদী যাবেন, ট্রেন না থামলে কি হবে? তখন যাত্রী জানালো তাঁকে নামতে হবে মাইজদী কোর্ট। তিনি আরেকবার বিড়ম্বনায় পড়লেন। অবশেষে তিনি মাইজদী কোর্টে নামলেন। রিক্সাওয়ালাকে বললেন, নোয়াখালী কলেজে যাবো। রিক্সাওয়ালা বলল, কোন কলেজ, নতুন কলেজ না পুরাতন কলেজ? তিনি পড়লেন আরেক ফ্যাশাদে। বললেন, যেখানে অনেক ছাত্র-ছাত্রী সেখানে যাও। রিক্সাওয়ালা বললেন, বুঝেছি নতুন কলেজ। অবশেষে তিনি নোয়াখালী কলেজে আসতে পারলেন।

আমার আরেক উকিল বন্ধু ঢাকায় আমাকে তার কার্ড দিয়েছিলেন। কার্ড আমি টেবিলের গ্লাসের নিচে রেখে দিলাম। আরেক দিন লালমনিরহাট থেকে এক ভদ্রলোক আসলেন আমার রুমে। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে ভদ্রলোক আমাকে বললেন, আচ্ছা আপনার এখানে একটা ভিজিটিং কার্ড দেখছি আহসান হাবিব, হাইকোর্ট, জজ কোর্ট, মাইজদী কোর্ট, নোয়াখালী। হাইকোর্ট, জজ কোর্টতো চিনি। কিন্তু মাইজদী কোর্টটা কী? আমি বললাম মাইজদী কোর্ট সবাই চেনে না। যারা চেনে তারাই কামিয়াব হয়।

আমার এক বন্ধু বছর কয়েক আগে মাইজদী এসেছিলেন। যিনি একজন আবহাওয়াবিদ। তখন দেশজুড়ে চৈত্রের তীব্রদাহ। দিন দুই পর ও আমাকে জানালো সারা দেশের গড় তাপমাত্রার চেয়ে নোয়াখালীর তাপমাত্রা কম। তার কথার সত্যতা যাচাই করতে আমরা শহরের কোর্ট স্টেশনস্থ আবহাওয়া অফিসে গিয়ে সত্যিই জানলাম সারা দেশের তুলনায় মাইজদীর তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলিসয়াস কম। এর কারণ হিসেবে আমরা আবিঙ্কর করলাম মাইজদী শহর নানা রকম গাছ গাছালিতে পরিপূর্ণ। গাছগুলো একদিকে এলাকাকে ছায়া দিচ্ছে এবং গাছের শেকড় মাটির গভীর পর্যন্ত পানি ধারণ করকে ভূ-ভাগকে শীতল রাখছে। এ ছাড়া শহরে অসংখ্য ছোট-বড় পুকুর রয়েছে এ পুকুরগুলো তাপ শোষণ করছে যা শহরের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করছে। এ ছাড়া শহর কিংবা শহরতলীতে ভারী কোন শিল্প কারখানা না থাকায় শহরের বাতাসও বিশুদ্ধ। অন্যদিকে মাইজদীর সবচেয়ে আলোকিত দিক হলো এখানে রাজনৈতিক সহিংসতা নেই। রাজনৈতিক নেতাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের পাশাপাশি শহরে রাজনৈতিক দলগুলোর সহবস্থান রয়েছে। এক কথায় বসবাসের জন্য মাইজদী একটি আদর্শস্থান বলা চলে।

নোয়াখালী রয়েল ডিস্ট্রিক্ট নামে পরিচিত হলেও মাইজদী এখনো এক রাস্তার টিনের ঘরের শহর বলা হয়; যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। মাইজদীর খুব কাছেই জেলার এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র চৌমুহনী। তাই মাইজদীতে পাইকারী ব্যবসা কিংবা বড় আড়ত সেভাবে গড়ে ওঠেনি। নোয়াখালী শহর ভেঙে গেলে ব্যবসায়ীরা অধিগ্রহণকৃত ভূমিতে অস্থায়ীভাবে টিন শেডের স্থাপনা তৈরি করেছিলেন এখনো সেই ব্যবসায়ীরা ভূমির স্থায়ী মালিকানা পাননি। স্থায়ী মালিকানা না থাকার দরুন এখানে (আবদুল মালেক উকিল সড়কের দুই পার্শ্বে) বহুতল কোন ভবন নির্মাণ করা যাচ্ছে না যার ফলে শহরের প্রধান সড়কটি দৃষ্টি নন্দন হয়ে উঠছে না। বর্তমান সরকারের মাননীয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের আন্তরিকতায় নোয়াখালীর প্রধান সড়ক ফোর লেনের কাজ শুরু হলোও কাজের গতি মন্থর। ফোর লেন বাস্তবায়িত হলে শহরের চেহারা পাল্টে যাবে বলে মাইজদীবাসী স্বপ্ন দেখছে। (ক্রমশ:)

তথ্য সূত্র : উইকিপিডিয়া

লেখক : নোয়াখালীর ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ক গবেষক

mrtuhin78@gmail.com


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: