শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:১২ অপরাহ্ন

আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ – খোন্দকার মাহ্‌ফুজুল হক

দীর্ঘদিনের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন। ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন। অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার বিষয়গুলো সময় সাপেক্ষ হলেও তা অর্জন অসম্ভব নয়। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর যে বিষয়টি প্রয়োজন তা হলো আত্মনির্ভরশীলতা, যা সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশ অর্জনের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। আত্মনির্ভরশীল দেশ গড়ার আহ্বান জানিয়ে পথ চলা শুরু করেছিলেন তিনি। সে পথ চলা সময়ের বন্ধুর পথ মাড়িয়ে এখন গন্তব্যে পৌঁছা সময় মাত্র।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সল্পোন্নত দেশের তালিকায় স্থান পায়। উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্ভুক্ত হতে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এবং ২০২১ সালে আবারো নির্ধারিত তিনটি শর্তই পূরণ করে। ফলে জাতিসংঘের নিয়মের আলোকে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। এ ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ অর্থনীতিতে বিশ্বের ২৯তম এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ২৩তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। ২০২৬ সালেই বাংলাদেশ ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ এবং ২০৪১ সালেই উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করবে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদণ্ডের চেয়েও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন অনেক বেশি। বর্তমানে মাথাপিছু আয় প্রায় ২ হাজার ৭৬৫ মার্কিন ডলার । মানব সম্পদ অর্জনে বাংলাদেশের সূচক ৭২ দশমিক ৯। যেখানে জাতিসংঘের দেয়া স্টান্ডার্ড হলো ৬৬। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক জাতিসংঘের মানদন্ডে ৩২ ভাগ বা এর কম হলেও বাংলাদেশের অর্জিত সূচক হলো ২৪ দশমিক ৮।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। সময়ের পথ ধরে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট পাস হয়েছে, যেখানে দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

অবকাঠামগত উন্নয়নে বাংলাদেশ আত্মনির্ভরশীলতার পরিচয় দিয়েছে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতু নির্মাণের ফলে বাংলাদেশ তার বৃহৎ অবকাঠামো উন্নয়নের সক্ষমতার প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি মেট্রোরেল, করোনা মহামারি মোকাবেলা, সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সেতু-কালভার্ট নির্মাণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, কয়লা ভিত্তিক থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, সমুদ্র বন্দর ও গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ ও নির্মাণ, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ, পার্বত্য অঞ্চলে হাজার কিলোমিটারের সড়ক নির্মাণ, নিজস্ব অর্থায়নে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ প্রকল্পগুলোসহ চলমান অন্যান্য মেগা প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের সক্ষমতা ও আত্মনির্ভরশীলতার প্রমাণ বহন করছে।

আত্মনির্ভরশীল জাতি হল আত্মনির্ভরশীল রাষ্ট্র। এরই আলোকে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপগুলো হলো; প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্রঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র দূরীকরণ, বৃক্ষরোপণ ও সামাজিক বনায়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমানো, দারিদ্র্য হ্রাসকরণ, শিক্ষা সুবিধা প্রদান, নারীর ক্ষমতায়ন, মানুষের শৌচাগার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান, শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম এবং করোনা মহামারী রোধে দেশব্যাপী টিকাদান ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি অন্যতম। বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতার উল্লেখযোগ্য একটি দিকের অর্জন হলো কৃষি খাত ও তার ব্যবস্থাপনা। একটি জনবহুল দেশে সীমিত কৃষিযোগ্য ভূমির সতর্ক ও যৌক্তিক ব্যবহারের ফলে কৃষি পণ্যের আমদানি নির্ভরতা এখন অনেকাংশেই কমে গিয়েছে।  দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারাই হলো এর একটি ইতিবাচক দিক। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন বাংলাদেশ কৃষিপণ্য রপ্তানি করছে এবং এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে।

দেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে ডিজিটাল সেবা দোরগোড়ায় প্রদানের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে ৮ হাজার ২৮০ টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ‘ডিজিটাল সেন্টার’। ডিজিটাল সেবার সংখ্যা দুই হাজার একশোটির ও বেশি। প্রতিমাসে ৬০ লাখ মানুষ ডিজিটাল সেবা গ্রহণ করে। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার পোর্টালের সমন্বয়ে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ওয়েব পোর্টালের সেবার আওতায় আনা হয়েছে দেশের আপামর জনগণকে। ১৮ কোটি ৪০ লক্ষ ১ হাজার মোবাইল গ্রাহক এবং ৯ কোটি ৯৪ লক্ষ ৮হাজার ইন্টারনেট গ্রাহকের বিশাল বহর নিয়ে এখন বাংলাদেশে চলছে টেলিযোগাযোগ কার্যক্রম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তিমিশন ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের সৃষ্টিশীল কর্মের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হচ্ছে। ক্রীড়া, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তিসহ অন্যান্য সকল সেক্টরে বাংলাদেশ এখন উজ্জ্বল ভূমিকা রাখছে।

সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি দুর্নীতি দমনে বাংলাদেশ কার্যকর ভূমিকা রেখে চলছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, নারীশিক্ষা, চাকরিজীবীদের বেতন ভাতা শতভাগ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা, বিনামূল্যে বই বিতরণ, বয়স্ক, অসহায়, বিধবা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদান, আশ্রয়ণ প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পসহ বিভিন্ন সেক্টরের সামগ্রিক উন্নয়নসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলছে। রাজস্ব ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক এবং জনশক্তি রপ্তানি। সর্বপ্রথম ব্যক্তি মালিকানায় তা শুরু হলেও সরকারের আগ্রহে এই দুই খাত এখন যথেষ্ট গতি অর্জন করেছে। এর মাধ্যমে দেশের বেকার সমস্যারও অনেকটা সমাধান হয়েছে। রপ্তানিযোগ্য অনেক পণ্য এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হওয়ায় জাতিসংঘ এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার ২০২১ বাংলাদেশ অর্জন করেছে। বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। সাক্ষরতার হার ৪৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭৫ দশমিক ২ ভাগে উন্নীত হয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য এবং অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়েছে, তা মোকাবেলায় সতর্ক এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে তার ক্ষতি অনেকটাই কাটিয়ে ওঠে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ । আমাদের মাটি উর্বর। তাই আমদানি নির্ভরতা কমাতে প্রতি ইঞ্চি জমি পতিত না রেখে তা কাজে লাগিয়ে সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাংলাদেশ সক্ষম হয়েছে।

১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৮৮ ডলার, যা ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। বর্তমানে সে আয় দাঁড়িয়েছে ২৭৬৫ ডলারে। এক সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি পুরোটাই ছিল কৃষি নির্ভর। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে শিল্পনির্ভরতার দিকে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বিশ্বে বাংলাদেশ এখন পঞ্চম। ১০০ টি অর্থনৈতিক জোন সৃষ্টি এবং শিল্পসিটি গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে পৃথিবীর অন্তত ২০টি দেশের বিনিয়োগ রয়েছে এবং আরো অনেকগুলো দেশ বিনিয়োগে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসছে। জাহাজ,ওষুধ এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যোগ হয়েছে। বাংলাদেশের আইটি শিল্প সুনাম অর্জন করছে পৃথিবীজুড়ে। বাংলাদেশে মানুষের বর্তমান গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ বছর, যা ভারতে ৬৯ দশমিক চার এবং পাকিস্তানের ৬৭ দশমিক ১ বছর। মানবসম্পদ উন্নয়নসহ আরো অনেক সূচকে ভারত, পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশের ভিত্তি ধরা হয়েছে চারটি। ‘স্মার্ট সিটিজেন’ অর্থাৎ আমাদের প্রত্যেক সিটিজেন প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবে। ‘স্মার্ট ইকোনমি’ অর্থাৎ ইকোনমির সব কার্যক্রমে আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করবো। ‘স্মার্ট গভর্নমেন্ট’ যেটা ইতোমধ্যে আমরা অনেকটা করে ফেলেছি এবং অবশিষ্টটাও করে ফেলব এবং ‘স্মার্ট সোসাইটি’ অর্থাৎ আমাদের সমাজটাই হবে স্মার্ট সোসাইটি।

ক্ষুদ্র আয়তনের এ দেশের বিশাল জনশক্তিকে বিভিন্ন সময় অনেকে বোঝা উল্লেখ করলেও বাংলাদেশ তার জনশক্তিকে এখন সম্পদে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে। বিশাল জনশক্তি এখন বাংলাদেশের জনসম্পদে পরিণত হওয়ায় বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে আত্মনির্ভরশীল জাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। জনশক্তিকে নিজ দেশের জনশ্রমে পরিণত করার পর উদ্বৃত্ত জনশক্তি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কার্যক্রমে বাংলাদেশ প্রেরণ করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তারা নিজেদেরকে কর্মের হাতিয়ারে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছে। পৃথিবীর ১৫৭ টি দেশে ৮৬ লক্ষের অধিক জনশক্তি আজ তাদের শ্রমের মাধ্যমে বিশাল প্রবাসী আয় বাংলাদেশে প্রেরণ করছে। সে আয় যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে। পাশাপাশি জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বিশ্বের ৩৯ টি দেশে ৬৪ টি শান্তি মিশনে খ্যাতি ও সফলতার সাথে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে বাংলাদেশ এখন আত্মনির্ভরশীল সমৃদ্ধি ও উন্নয়নশীল দেশের প্রতীক। শামিল হয়েছে আজ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে বর্তমান পর্যন্ত এ বন্ধুর পথ পরিক্রমায় অনেক প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে বাংলাদেশকে অগ্রসর হতে হয়েছে। এ যাত্রা অব্যাহত রাখার প্রত্যয়ই হলো এখন সময়ের অঙ্গীকার।

লেখক: সহকারী তথ্য অফিসার তথ্য অধিদফতর, ঢাকা।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: