শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,
ভয় করি না’ক, ধারি না’ক ধার, মনে আছে মোর বল,
বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।
যায় যাবে প্রাণ তাহে,
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে।
এখনও এ কবিতা আমাদের মানসপটে জাগ্রত। শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়ে এত হৃদয়গ্রাহী ও অনবদ্য কবিতা বাংলা সাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছে। বহুল পঠিত এ কবিতা এখনও পাঠকনন্দিত ও প্রাসঙ্গিক।
শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘একদিন তরুণ বয়সে, স্বপ্নতাড়িতের মতন এসে যোগ দিয়েছিলাম শিক্ষকতায়। প্রতিটা শিরা-ধমনিকে সেদিন যা কামড়ে ধরেছিলো তা এক উদ্ধাররহিত স্বপ্ন-সমৃদ্ধ মানুষ গড়ে তোলায় অংশ নেবার স্বপ্ন-সেইসব মানুষ যারা একদিন জাতির জীবনে পালাবদল ঘটাব।’
শিক্ষক কী করেন?
একজন শিক্ষক তার স্বপ্ন-সাধ-আকাঙ্ক্ষা তার ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক’ গ্রন্থে বলেন, ‘আমি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলাম। সাহিত্যের স্বপ্ন ও সৗন্দর্য আজীবন আমার চেতনা-জগতে যে-হীরের দীপ্তি ছড়িয়েছে আমি সেই উজ্জ্বলতাকে ছাত্রদের ভেতর ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছি। তাদের সেই আনন্দে উজ্জীবিত করতে চেয়েছি। পরীক্ষায় ছাত্রদের বেশি নম্বর পাওয়াবার জন্যে পরিশ্রম করে জীবন নিঃশেষ করাকে আমার কাছে দুর্লভ মানব জন্মের অপচয় বলেই মনে হয়েছে। জীবন কত দীপান্বিত ও জ্যোতির্ময় তা একজন ছাত্র সবচেয়ে ভালো করে জানতে পারে তার জীবনের দীপান্বিত শিক্ষকদের কাছ থেকে। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন কিংবা চারপাশের বড় বা সাধারণ মানুষ – কেউই এ ব্যাপারে শিক্ষকের সমকক্ষ নন। জীবনের সামনে দীর্ঘদিন অবিচলভাবে দাড়িয়ে শিক্ষক ছাত্রদেরকে জীবনের মহিমান্বিত রূপটি চিনিয়ে যেতে থাকেন
বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দকে শ্রদ্ধা, আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। শিক্ষকগণ মানুষ গড়ার কারিগর। জাতির চালিকাশক্তি। আলোকবর্তিকা। শিক্ষক শিক্ষার্থীকে জ্ঞান, সমাজকে আলো, দেশকে দেন সমৃদ্ধি। শিক্ষক আমাদের বাতিঘর। শিক্ষক হচ্ছে সেই প্রদীপ যে প্রদীপ অসংখ্য প্রদীপকে প্রজ্জ্বলিত করে, অথচ নিজের ঔজ্জ্বল্য এতটুকু ম্লান হয় না তাতে। বাবা-মায়ের পরে শিক্ষকগণই হচ্ছেন একমাত্র নিঃস্বার্থ গুনীজন, যারা চান তাদের শিক্ষার্থীগণ তাদের চেয়েও সফলতা অর্জন করুন। আমাদের মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানবজাতির শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।
একজন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। তিনি যে পড়ুয়াকে শেখাবেন, তাই নয়। তিনি তাকে জীবনে চলার পথে পরামর্শ দেবেন, ব্যর্থতায় পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দেবেন, সাফল্যের দিনে নতুন লক্ষ্য স্থির করে দেবেন। তিনি তাকে শুধু সফল নয়, একজন ভাল মানুষ হতে শেখাবেন। মানুষ মনে করে সমাজের একজন দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হলেন শিক্ষক। কারণ তাঁদের আন্তিরক প্রয়াস পৃথিবীর ভাগ্যকে প্রভাবিত করে। তাই আমার বলতে ইচ্ছে করে।
চোখেতে দিয়েছ স্বপ্ন হাজার
বুকে জাগিয়েছ আশা,
তুমি শিক্ষক, তুমি মহান
আলোর পথের দিশা।
শিক্ষার লক্ষ্য-
শিক্ষা চেতনাকে শাণিত করে, বুদ্ধিকে প্রখর করে, বিবেককে জাগ্রত করে। শিক্ষা আত্মিক মুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটায়। শিক্ষা মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টির দুয়ার খুলে দেয়। এ দুয়ার আমাদের জ্ঞানের পথ দেখায়। আমরা জানি জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব। তাই মুক্তির বিশাল ভূবনে নিজেকে আবিস্কার করতে হলে একটি জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের বিকল্প নেই। শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হয়েই সেই জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ নির্মাণ সম্ভব।
শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতি যে সম্ভব নয়, তা অনুধাবন করেছিলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেটা তাঁর শিক্ষাদর্শনে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে শিক্ষকদের উদ্দেশে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আগামী প্রজন্মের ভাগ্য শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করছে। শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ব্যত্যয় ঘটলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হবে’।
তাই লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সদ্য স্বাধীন দেশকে তাঁর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’য় বিনির্মাণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ১৯৭২ সালে সংবিধানে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার অঙ্গীকার সন্নিবেশ করেন।
প্রাথমিক শিক্ষার সোপান-
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এবং ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭২৪ জন শিক্ষককের চাকুরি সরকারিকরণের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির সোপান রচনা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রাথমিক শিক্ষাকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্টার্ড ও কমিউনিটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণসহ প্রধান শিক্ষকের পদকে দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা প্রদান এবং সহকারী শিক্ষকদের বেতনস্কেল একধাপ উন্নীকরণসহ ১ লাখ ৫ হাজার ৬১৬জন শিক্ষকের চাকুরি সরকারিকরণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এটি সর্বজন স্বীকৃত আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
সরকারের পদক্ষেপ-
বর্তমান সরকার শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা ও গুনগত মান বৃদ্ধি এবং মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারি প্রাথিমক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কল্যাণে অতিসম্প্রতি শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট বিল জাতীয় সংসদে পাশ হয়েছে। শিক্ষকদের হয়রানি, দুশ্চিন্তা ও ঝামেলা থেকে পরিত্রান দিতে অনলাইনে শিক্ষক বদলি চালু হয়েছে। পরিমার্জিত পাঠ্যক্রমের সাথে শিক্ষকদের খাপ খাইয়ে নিতে প্রশিক্ষণের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। শিক্ষক ঘাটতি দূর করতে চলতি বছরের শুরুতে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে ৩৭ হাজর ৫ শত ৭৪ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে; যা স্বাধীনতার পর সর্বোচ্চ। আরও নতুন শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিক্ষকদের ম্যাথ অলিম্পিয়াডের মাস্টার ট্রেইনারের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বৃটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে ইংরেজী বিষয়ে মাস্টার ট্রেইনার হিসাবে গড়ে তোলার কাজ চলমান আছে। প্রতিটি বিষয়ের মাস্টার ট্রেইনারদের দ্বারা পর্যায়ক্রমে প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষককে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার এবং প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লবের এ সময়ে শিক্ষায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সহজে, সুন্দর ও কার্যকরভাবে পাঠদান করতে শিক্ষকদের দ্বারাই বিভিন্ন বিষয়ে কন্টেন্ট ডেভেলপ করা হয়। প্রযুক্তির সাবীল ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ, মাল্টি মিডিয়া সরবরাহ করা হয়েছে। ইন্টারনেট সংযোগ ও ওয়াই-ফাই সংযোগ প্রদান করা হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হচ্ছে। যাতে শিক্ষকগণ এসব ল্যাব ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিক্ষা প্রদান করতে পারেন।
প্রতিষ্ঠার প্রায় চারদশক পর অতিসম্প্রতি জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) আইন 2023 অনুমোদিত হয়েছে। এ আইন পাশের ফলে একটি আধুনিক, যুযোপযোগী প্রশিক্ষণ একাডেমি হিসেবে নেপের বিকশিত হবার দুয়ার উন্মুক্ত হবে। এ প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা পদায়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও কারিকুলাম উন্নয়নেও এ প্রতিষ্ঠান কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা পরিচালনা, গবেষণা জার্নাাল প্রকাশের পাশাপাশি নেপ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মেলন ও কর্মশালার আয়োজন করতে পারবে। এ আইনের আওতায় নেপের আঞ্চলিক কার্যালয়ে স্থাপনের মাধ্যমে নেপ আরও ছড়িয়ে দেবার পথ উন্মুক্ত হবে।
আগামীর পথ..
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার পুরোনো ধারার শিক্ষার খোলনলচে পাল্টে এমন এক নতুন শিক্ষার বীজ বপনের কাজে হাত দিয়েছে, যা শিক্ষার্থীর মস্তিস্ক ও পিঠ থেকে মুখস্থবিদ্যার বোঝা ঝেড়ে ফলে তাদের কৌতুহল, জিজ্ঞাসা, অনুসন্ধান, গবেষণা ও ভাবনার শক্তিকে জাগাবে ও নেতৃত্বের গুনাবলী তৈরিতে উপযোগী করে তুলবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্মিলনে শ্রেণিকক্ষেই প্রতিটি জিজ্ঞাসা ও জানার মাধ্যমে শিশুর ভাব-ভাবনার উত্তরণে সরকার গুরুত্বারোপ করেছে। এর ফলে বয়সোচিত যোগ্যতা এবং সরাসরি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিশু তার জানার পরিধি বাড়াবে, আপন ভূবন সাজাবে। সে নিজেই নানা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে, তা মোকাবেলা করে অভীষ্ট গন্তব্য পৌঁছাবে। স্কুল শিশুদের ভীতির নয় প্রীতির জায়গা হবে। সমম্বরে শিশুরা বলবে-
আমাদের স্কুল/
আনন্দের এক রঙিন ফুল
সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দের প্রতি নিবেদন
আপনারা শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এ জন্য আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপণ করছি। আপনারা নীতি ও আদর্শবোধ শেখানোর মাধ্যমে প্রতিটি শিশুকে দেশ গড়ার কারিগর হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। তাদের মাঝে দেশপ্রেম, কর্তব্যবোধ জাগ্রত করে নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতার অনুশীলনের মাধ্যমে তাদেরকে আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক হিসেব গড়ে উঠবার প্রেরণা আপনারাই যোগাতে পারেন। এ জন্য আপনাদের উদ্যোগী ও নিবেদিত হতে হবে। প্রতিটি শিশুর পাঠ্য বইয়ের যথার্থ অনুশীলনের মাধ্যমে জ্ঞানের অন্বেষণ ও মানবিক মূল্যবোধের উন্মেষ ও বিকাশে আপনারাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আমরা আপনাদের পাশে আছে সবাই। দেশ ও জাতি আপনাদের অবদান চিরদিন স্মরণ করবে।
শেষের কথা
শিক্ষক দিবসের এ দিনে আমরা শিক্ষকদের অবদানকে স্মরণ ও মূল্যায়ন করবো। এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য- ‘কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার জন্য শিক্ষক: শিক্ষক স্বল্পতা পূরণ বৈশ্বিক অপরিহার্যতা’- এটি শুধু চার দেয়ালের মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে অনুধাবন, উপলদ্ধি ও আত্মস্থ করবো। আমাদের জাতিসত্ত্বার জাগরণ ও প্রতিটি অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে শিক্ষকদের বিশাল-বিরাট ও ব্যাপক। এ ভূমিকা পর্যালোচনা করে ২০৪১ এর স্মার্ট বাংলাদেশে শিক্ষকের ভূমিকা কী হতে পারে আসুন সে রূপরেখা নির্নয় করি।
লেখক : মাহবুবুর রহমান তুহিন, সিনিয়র তথ্য অফিসার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।