বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:১৬ পূর্বাহ্ন

কৃষিজমি রক্ষায় আসছে সমন্বিত উদ্যোগ

নিউজ ডেস্ক :: এক ফসলি, দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমি চিহ্নিত করবে সরকার। এরপর তা রক্ষায় কৃষি, ভূমি ও শিল্প মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে মূলত কৃষি মন্ত্রণালয় এ উদ্যোগ নিয়েছে।

এ বিষয়ে একটি খসড়া প্রস্তাবনা তৈরির জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিটের প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে।

আমি যদি জানতে পারি কোনটি এক ফসলি জমি, কোনটি দুই ফসলি জমি, কোনটি তিন ফসলি জমি- তাহলে ব্যবস্থাপনাটা সহজ হবে। তিন ফসলি জমি রক্ষা সহজ হবে, দুই ফসলি জমি তিন ফসলি করা, এক ফসলি জমি দুই ফসলি বা তিন ফসলি করার পরিকল্পনা করা হবে।

এক ফসলি, দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমি চিহ্নিত করে তা রক্ষায় সমন্বিত প্রস্তাবনা তৈরির জন্য গত ২১ মার্চ সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। ওই সভায় ভূমি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় বিএআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যানকে প্রধান করে খসড়া প্রস্তাবনা তৈরি করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে গত ৬ জুন ওই কমিটি প্রথম সভা করে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক হিসাব থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের বর্তমান আয়তন এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৬৯ দশমিক এক বর্গকিলোমিটার। দেশে বর্তমানে এক ফসলি জমি ১৭ লাখ ৭০ হাজার ৭৮২ হেক্টর, দুই ফসলি ৪৪ লাখ ৩৪ হাজার ৫০৫ সেক্টর, তিন ফসলি ২৬ লাখ ৬৪ হাজার ৮৪৪ হেক্টর, চার জমি এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৭৪ হেক্টর ও পাঁচ ফসলি ৯০০ হেক্টর। নিট ফসলি জমি ৯০ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৮ হেক্টর, মোট ফসলি জমি এক কোটি ৯২ লাখ ২৯ হাজার ১৩ হেক্টর। বর্তমানে ফসলের নিবিড়তা ২১৩ শতাংশ এবং জমি ব্যবহারের ঘনত্ব ৬১ শতাংশ।

কৃষিজমি কমে গেলে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে। এজন্য কৃষিজমি রক্ষায় আন্তঃমন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমরা কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে একটি প্রস্তাব তৈরি করছি। কাজটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

বিএআরসি’র এক কর্মকর্তা জানান, প্রতি বছর আমাদের ফসলি জমির শতকরা শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে। কৃষক বছর বছর বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করে, যাতে ক্রপ প্যাটার্ন পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে এক ফসলি, দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমিও পরিবর্তন হচ্ছে। আগামী দিনের খাদ্য চাহিদা নিশ্চিতে এক, দুই ও তিন ফসলি জমি চিহ্নিত করে তা রক্ষা করতে হবে।

ভূমি, কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত প্রস্তাবনা তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে বলে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ অনুবিভাগ) মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে আমরা নির্দেশনা পেয়েছি, আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে। এ কাজটি করতে গেলে, ক্রপ জোন ও ল্যান্ড জোন করতে হবে। সেটার জন্যই আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি নগরায়ন ও শিল্পায়নের জন্য জমি চলে যাচ্ছে। সরকারকে জমি অধিগ্রহণ করতে হচ্ছে। আমরা যদি এক ফসলি, দুই ফলসি ও তিন ফসলি জমি ক্যাটাগরাইজ করতে পারি, তাহলে তিন ফসলি জমিটা আমরা অবশ্যই রক্ষা করবো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে।’

‘২০৪১ সালে বাংলাদেশ যখন উন্নত দেশ হবে তখন আমার শিল্পায়নের দরকার হবে। অনেক কারণে জমির প্রয়োজন হবে। আমি যদি জানতে পারি কোনটি এক ফসলি জমি, কোনটি দুই ফসলি, কোনটি তিন ফসলি জমি- তাহলে ব্যবস্থাপনাটা সহজ হবে। তিন ফসলি জমি রক্ষা সহজ হবে, দুই ফসলি জমি তিন ফসলি করা, এক ফসলি জমি দুই ফসলি বা তিন ফসলি করার পরিকল্পনা করা হবে। প্রয়োজনে যদি আমাদের জমি নিতেই হয় সেক্ষেত্রে এক ফসলি জমিটাতে দু-ফসলি বা তিন ফসলি করা যাচ্ছে না, সেটাকে আমি নিতে পারবো। এই জমি আমি উন্নয়নকাজে ব্যবহারের বিষয়ে চিন্তা করবো। তিন ফসলি জমিতে কোনোভাবেই আমরা শিল্পায়নের জন্য বিবেচনায় নেব না।’

অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘আমাদের টার্গেট হচ্ছে সীমিত জমিতে সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করা। জমির ক্যাটাগরাইজ না করে আমি সেটা করতে পারব না। মিউটেশনের ক্ষেত্রে, জমি বেচা-বিক্রির ক্ষেত্রে, জমি অন্য কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন শর্তারোপ করব।’

এ বিষয়ে খসড়া প্রস্তাবনা তৈরির জন্য বিএআরসিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জানিয়ে হাসানুজ্জামান কল্লোল বলেন, ‘তাদের সুপারিশ নিয়ে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা হবে। ভূমি মন্ত্রণালয় থাকবে, শিল্প মন্ত্রণালয় আমাদের সঙ্গে থাকবে।’

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে। এসডিজি-২০৩০ অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। জাত দিয়ে ফলন বাড়ানো যায়, কিন্তু জমিও তো প্রয়োজন হবে। কৃষিজমি কমে গেলে খাদ্যনিরাত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। এজন্য কৃষিজমি রক্ষায় আন্তঃমন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমরা কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে একটি প্রস্তাব তৈরি করছি। কাজটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে।’

এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন বিএআরসির সদস্য পরিচালক (শস্য বিভাগ) মো. আজিজ জিলানী চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি মিটিং হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রথমে আমাদের এক ফসলি, দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমি চিহ্নিত করতে হবে। কৃষিজমি যদি বেহাত হয়ে যায়, খাদ্যনিরাপত্তা না থাকে তাহলে সেটা কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়। কৃষিজমি রক্ষায় কী পদক্ষেপ নেয়া যায় সে বিষয়ে প্রস্তাবনা তৈরি করব। সেই প্রস্তাবনা নিয়ে তিনটি মন্ত্রণালয় মিলে আলোচনা করে তা চূড়ান্ত করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘সরকার জমি অধিগ্রহণ করে, সেখানে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি এক ফসলি জমিতে মাছের চাষ করতে গেল বা অন্য কাজে ব্যবহার করলো, এখন তো আইনতগতভাবে তাকে বাধা দেয়া যাবে না। এটা তো তার ব্যক্তিগত জমি।’

‘মাঠ পর্যায়ে কাজ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। তাদের উপজেলাভিত্তিক কৃষিজমি চিহ্নিত করে তালিকা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। ওই তালিকার ভিত্তিতে কোন জমি কীভাবে রক্ষা করা যায় সে বিষয়ে প্রস্তাবনা কমিটির সদস্যদের কাছে আমরা চেয়েছি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আমাদের তালিকা এখনও দিতে পারেনি। আমরা আবার তাদের রিমাইন্ডার দিয়েছি। সেটা পেলে আমাদের পর্যায়ে একটা সুপারিশমালা হয়তো তৈরি করতে পারবো। এরপর ভূমি ও শিল্প মন্ত্রণালয় মিলে হয়তো পূর্ণাঙ্গ সিদ্ধান্তে আসা যাবে।’

আজিজ জিলানী চৌধুরী আরও বলেন, ‘একজন কৃষক যদি তার ফসলের ন্যায্যমূল্য পান, তবে সে জমিটা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করবে না। বিক্রি করবে না। কৃষককে তার ফসল ধরে রাখতে এবং আরও উৎসাহিত করতে শস্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা ছাড়াও আর্থিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টি আসতে পারে প্রস্তাবনায়। কৃষক ফসল ফলিয়ে লাভবান হলে সে ফসলেই থাকবে। এটা আমরা কীভাবে করব সে বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। নানা ধরনের প্রস্তাবনা আসতে পারে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, ‘বিএআরসি আমাদের কাছে তথ্য চেয়েছে। বর্তমানে জমিগুলোর কী অবস্থা? সে অনুযায়ী তারা জমিগুলো রক্ষার সুপারিশ করবে কৃষি মন্ত্রণালয়ে। কোন কোন জমি আছে সেখানে তিনটি ফসল হয়। আমরা যদি সেখানে ঘরবাড়ি বা কোনো কাজে না লাগিয়ে যেখানে একটি ফসল হয় সেই জমিতে সেই কাজ করতে পারি। এ বিষয়গুলো যাতে শক্তভাবে মানা হয় সরকারিভাবে সেই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের তো খেতে হবে। প্রতিনিয়ত জমি কমে যাচ্ছে, মানুষ বাড়ছে। ভূমি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ও এ উদ্যোগের সঙ্গে থাকবে।’

‘মূলত এক, দুই ও তিন ফসলি চিহ্নিত হলে, যদি কোনো কারণে কৃষিজমি অকৃষি জমি করতে হয়, তখন এক ফসলি জমি নেয়া হবে। এছাড়া এক ফসলি জমিতে দুই ফসলি করার এবং দুই ফসলি তিন ফসলি করার চেষ্টাও করা হবে। এসব বিষয় নিয়েই মূলত প্রস্তাবটি প্রস্তুত করা হচ্ছে।’

মহাপরিচালক বলেন, ‘যেখানে সেচের ব্যবস্থা নেই এবং বছরের বেশির ভাগ সময় পানির নিচে থাকে এমন জমিগুলোই সাধারণ এক ফসলি হয়ে থাকে। হাওর এলাকায় যেভাবে পানি আগে চলে যায় সেখানে আমরা সরিষা করতে পারি। পরে সেখানে বোরো করলাম। সে ধরনের প্রযুক্তি সেখানে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। যেখানে সেচের ব্যবস্থা আছে, সেই জমিতে চাইলেই দু-তিনটি ফসল করা যায়।’

আসাদুল্লাহ আরও বলেন, ‘পাহাড়ি এলাকা ও সিলেটে বিভিন্ন অঞ্চলে সেচের ব্যবস্থা নেই। সেখানে বোরো করা যায় না। সেই সময় জমিগুলো পতিত থাকে। এভাবে আমরা এরিয়াগুলো চিহ্নিত করে কীভাবে উন্নয়ন করা যায়, সেজন্য কৃষককে কোন ধরনের সহায়তা দিতে হবে- সবকিছু মিলেই প্রস্তাব প্রস্তুত করা হবে।’


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: