বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৪৭ পূর্বাহ্ন

অমাবস্যার কাল ও যুবকদের দায়

আমরা একটা কাল অতিক্রম করছি। ঘুণে ধরা এ সমাজ, ধীরে ধীরে পচে যাওয়া এ রাষ্ট্রে এই কালটা কেমন বুঝতে পারছেন? নিশ্চয় মহাকাল তো নয়। চরম একটা ঘোর অমাবস্যার কাল চলছে এখন। জানি না, এ কাল কবে কাটবে। প্রতিদিন খবরের কাগজ আর টেলিভিশনের পর্দা জুড়ে থাকে ধর্ষণের খবর। বিভিন্ন সংস্থার, গণমাধ্যমের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এ যেন নিরাময় অযোগ্য-অসুখের প্রকোপ। তা ছাড়া নিয়োগ-বাণিজ্যে লুটপাটে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। পুনর্বাসন বা বিকল্প ব্যবস্থার সংস্থান না করে হকার, রিকশা উচ্ছেদ করে বেকার সমস্যা আরও প্রকট করে তোলা হচ্ছে।

ইন্টারনেট ব্যবহার করে আমরা জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে পারতাম, কিন্তু সংযোগ এখন পর্নোগ্রাফিকে সহজপ্রাপ্য করেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাদক-ইয়াবা। যেখানে বিশাল ক্ষমতাশীল অংশ সন্তানদের হাতে মাদক তুলে দিয়ে অট্টালিকা বানায়, কোটি কোটি টাকার গাড়িতে চড়ে। দিন দিন দুর্নীতি বিস্তার বাড়ছে। পরিবারের নৈতিকবোধগুলো সর্বগ্রাসী হচ্ছে। এটা কি অমাবস্যার কাল নয়!

দেশে আজ ফ্রি স্টাইলে চলবার নীতি অনুসরণ হচ্ছে। ফলে ‘আইন বিহীন আইন’ এবং ‘পরিকল্পনা বিহীন অর্থনীতি’ চালু আছে। এই দেশের বিবেকবান মানুষেরা চিন্তিত হয়ে নিজেদের প্রশ্ন করছে, ‘দেশ আজ কোন পথে?’ ক্রাইম আর ক্রিমিনালে দেশটা ভরে গেল। অবস্থা দেখে এই মনে হতে কারওর কোনো অসুবিধে হচ্ছে না, আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা আরবের ‘আইয়ামে জাহেলিয়াতের’ জমানায় বাস করছি। জাতির কর্ণধারেরা বিভিন্ন মাধ্যমে এটা প্রচার করছে, ‘আমরা ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছি, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।’ এই সব উক্তিতে ফরেনারদের কাছ থেকে হয়তো বাহবা মিলছে কিন্তু এসব দেশের মানুষের কাছে অর্থবহ নয় এবং বিবেকবান মানুষের কাছে উদ্বেগের। উন্নয়নের জোয়ারটা এমনই, চোরেরা ডাকাত হলো, ডাকাতেরা লুটেরা হলো, ওদের গ্রেড বদলাল। আর আদার ব্যাপারীরা জেনারেল মার্চেন্টে পরিণত হলো। সামাজিক সুনীতি ভেঙে অবক্ষয়ের মহাসড়কে আমরা হাঁটছি। গ্যাসের মূল্য, বিদ্যুতের মূল্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে হিমশিম খাচ্ছে এ দেশের ৯৯ ভাগ মানুষ। তাদের মনে সত্যি এ চিন্তা উদয় হচ্ছে, ‘দেশ আজ কোন পথে?’

সড়কসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রতিদিন যেভাবে মৃত্যু হচ্ছে, তাতে এই চিত্রটি আমাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে আমরা কোন অচলায়তন সমাজ এবং রাষ্ট্রে দাঁড়িয়ে আছি। এটাই সমাজ ও রাষ্ট্রের সেই চিত্র, যেখানে সুস্থির চিন্তা এবং বোধের কোনো জায়গা নেই। স্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে হ্রাস পাচ্ছে। যতটুকু গণতান্ত্রিক চর্চার জনবলয় গড়ে উঠেছিল, ডিজিটাল ৫৭ ও ৩২ ধারা দিয়ে সেগুলোও ভেঙে ফেলা হচ্ছে।

ক্রমশ এখন আমরা আত্মসুখ সর্বস্ব হয়ে উঠেছি। আমরা আমাদের বিবেককে নিকোটিনের ধোঁয়ায় বিষাক্ত করে তুলেছি। তাই তো কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে না। আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে সিসার ধোঁয়া। আমাদের সামনে এতো এতো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, আমাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আওয়াজটা খুব ছোট হয়ে আসছে। খুব ক্ষীণ। এগুলো কোনোটাই কাঙ্ক্ষিত নয়। এখন আর আমাদের এসবে যায়-আসে না। আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে নানামাত্রিক ঝঞ্ঝাট মুক্ত বিলাসী আলাপনে কিংবা জীবন-যাপনে। বাসে কিংবা চায়ের কাপে ঠিকই আমরা ঝড় তুলছি। কিন্তু ওখান পর্যন্তই। সাথে ভয় আর ভীতির আর্তনাদও এতটা, আমরা ওই সংস্কৃতির ভেতরে আটকা পড়ছি। মিটিং-মিছিলে যাওয়াটা কিংবা আওয়াজ তুলে প্রতিবাদ জানানোটা এখন ‘ঝামেলা’ মনে হয়।  এটাই হয়তো পুঁজিবাদের এখন বাস্তবতা। এ বাস্তবতার ভেতরে আমরা সবাই পড়ে গেছি।

এটা একটা চক্রব্যূহ। ক্ষমতার চক্রব্যূহ। ত্রিমাত্রিক শক্তিতে এটা আমাদের ঘিরে ফেলেছে। তারই ফল সর্বভুক বিভিন্ন প্রবণতা। এখান থেকে বের হতে সময় লাগবে। তবে হতাশা বা নৈরাশ্যের কিছু নেই। আমি আশাবাদী আছি, থাকতে চাই। আসুন, আমরা সবাই মিলে ভালো কিছু করার চেষ্টা করি। যা কিছু মঙ্গল, তা সঙ্গে নিয়ে লড়াই করি। সংগ্রাম করি। কোনো লড়াই বা সংগ্রামের ফলাফল বৃথা যায় না।

বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরোনো আমাদের পথচলা। আমাদের পথচলা কোথাও মসৃণ না। নানা সংকট, নানা প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে আমরা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি। একজন ব্যক্তি সৃষ্টির অন্তর্লোকে প্রথমত নিজেকে সংগঠিত করে। এই গঠন সমাজের অপরাপর ভাব-বস্তুর ভেতর দিয়ে নিজেকে সংগঠিত করে নেয়। দ্বিতীয় কাজ হলো, সংগঠনের ভিত দিয়ে চেতনাগত জায়গায় সমাজ-মানুষ-প্রকৃতিকে সম্পৃক্ত করা। মনে রাখা দরকার, প্রকৃতি নিজেই সংগঠন।  এ মনোবল, এ শক্তি ও সাহস নিয়ে আমরা পারব। তরুণেরা পারে, যুবকেরা পারেন, বহুবার এটা প্রমাণিত হয়েছে।

আমাদের বোধশক্তি একটি চেতনাগত সংগঠনের ভেতর প্রবেশ করে। কেননা ভাষা-চিন্তা-দর্শন-শ্রেণিগত রুচি মিলেই একটি চেতনাগত সংগঠন সৃষ্টি করে। চেতনা কোন স্থির ধারণা নয়, চলমান। সৃষ্টির ভেতর দিয়ে চলমান চেতনাগত জায়গায় মানুষ স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে চায়। এবং ঘটায়। যুবকরা এই ক্ষেত্রে সমাজের অন্তর্গত আর উপরি-কাঠামোর কাজ করে। মানুষকে জাগায়, জাগতে অনুপ্রাণিত করে। স্বপ্নের বাস্তবায়নের পথ দেখায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন সৃষ্টিযজ্ঞে যুব সংগঠনের ভূমিকা কি? এখন আপনি-আমি কতটা প্রস্তুত সেটাই প্রশ্ন।

যারা মনে করি একটা পরিবর্তন চাই, এ রাষ্ট্রের গুণগত মান চাই, সাম্যের সমাজ চাই, আমরা সেই চেষ্টাটা করি সর্বাত্মক। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে এদেশের যুবকরা বুকে তাজা রক্ত ঢেলে যখন একটা লাল-সবুজ মানচিত্র বানিয়ে ফেলতে পেরেছেন, তখন আমরাও পারব। আমাদের রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য ও ইতিহাস। সে ইতিহাস সংগ্রামের, এবং রক্তক্ষয়ী। আমাদের দেশ ও জাতির উত্থান-পতনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইতিহাসের দিকে আরেকটু চোখ ফেরালে দেখা যাবে, গত শতাব্দীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদের বিপরীতে স্বাধীনতাকামী মানুষের জাগরণ আর ফ্যাসিবাদী শাসন কাঠামোর বিপরীতে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থান। অনস্বীকার্য আজ, মুক্তিকামী মানুষের জাগরণের পেছনে চেতনাগত সংগঠনের কাজটি সুচারু করেছিল বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার যুবকরাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানবিকতার স্লোগান আর উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পেছনে স্বাধীনতাকামী মানুষের চেতনাগত পাটাতন নির্মাণেও যুবকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য।

কোন সংগঠনই আদর্শ বিচ্যুত হয়ে টিকে থাকতে পারেনি। অনেক উদাহরণ আছে। সেদিকে যাব না। তবে আদর্শচ্যুতিতে সবচে বড় বিভেদ ঘটে নেতৃত্বের চেতনাগত জায়গায়। যার ফলে লক্ষ্য আর আদর্শ ওখানে স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু নানা বৈচিত্র্যের সামগ্রিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের চিন্তার সম্মিলিত রূপ আদর্শকে আরও বেশি সংগঠিত করতে পারে। একটি উদাহরণ দিলে সেটা স্পষ্ট হবে, একক ফুলের বাগান থেকে কোন বাগানে যদি নানান জাতের বৈচিত্র্যময় ফুলের সমাহার ঘটে, সেটা নানাভাবে সৌন্দর্যকে ঋদ্ধ করে। কারণ বাগানকে আদর্শ হিসেবে নিলে, নানা ফুলের ভেতর আমরা সৌন্দর্য চেতনার সম্মিলন হিসেবে দেখতে পাব। চেতনার এই সম্মিলন সমাজ বদলের প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে।

আমাদের কাজ কি? যুবকদের দায় কি? আমাদের কাজ মানুষের সঙ্গে থাকা। মানুষের অধিকার, মুক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নের ভেতর থাকা। পুঁজিবাদের অস্তমিত চেহারা আজ দেখতে পাচ্ছি, তেমনি ভোরের লাল টুকটুকে সূর্যে প্রভা জ্বলে উঠছে ভবিষ্যতের আকাশে। যাস্ট বিবেকের আস্তিনটা খুলে ফেলুন। বিপ্লবী চে-কে শুধু টিশার্টে প্রদর্শনবাদের আইকন নয়, বাস্তব জীবনে আইডল হিসেবে নিয়ে এগিয়ে চলি। অন্তত ইন্দ্রিয় শক্তি বা বোধ এতটুকু সাক্ষ্য দেয়, আমরা চেতনায় সংগঠিত। আদর্শের দৃঢ়তায় অটল। আমাদের ভবিষ্যৎ বিজয় ঠেকায় কে? চান বা না চান আপনার ভবিতব্য আপনাকে ডাক দিয়েছে।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: