বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৫১ পূর্বাহ্ন

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে সড়ক নিরাপত্তা

কুয়াশা ভেজা ভোর। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আলো-আঁধারের খেলা চলে এখন প্রতিদিন। ভোরের আলো ফোটার আগেই এ এলাকায় ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠে।

আমি যে এলাকায় থাকি, সেখানে অনেকগুলো স্কুল রয়েছে। পুরোনো কয়েকটি স্কুল, যেগুলোর বয়স ইতিমধ্যে পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে। এখন এ এলাকায় লাফিয়ে লাফিয়ে স্কুলের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার সকাল-বিকেল এখন ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকে ঠাসা থাকে।

এ এলাকায় বসতবাটি, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, কোচিং সেন্টার, ভাসমান ছোট-খাটো বাজার (দিনে নির্দিষ্ট চাঁদা দেওয়ার বিনিময়ে এ বাজারে দোকান-পাট বসে)- সবকিছুর কেন্দ্রেই এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।

জানালার পাশ দিয়ে দেখি, স্কুলের ইউনিফর্ম পরে বাবার হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে ওরা। দেখতে ভালোই লাগে। চমৎকার সব ইউনিফর্মের বিভিন্ন রং। রঙের সঙ্গে রঙের খেলা। চকচক করে উঠে রঙিন পোশাকে শিশু-কিশোরদের ভরা রেলওয়ে কলোনি থেকে পুনর্বাসিত অথচ প্রাচীন এ এলাকা।

ছোট ছোট শিশু, কারো কারো চোখে তখনো ঘুম লেগে আছে। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না তবু যাচ্ছে সে। আবার কেউ আনন্দের সঙ্গে স্কুলে যাচ্ছে। ব্যাগ ভর্তি বই-খাতা। ব্যাগটার এত ওজন সে নিতে পারছে না কাঁধে। তখন বাবা ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে স্কুলে।

স্কুলের সামনে দোকান থেকে বাচ্চারা এটা-সেটা নতুন খেলনার জিনিস কিনছে, বন্ধুদের দেখাবে বলে, বন্ধুদের চমকে দেবে বলে। এটা তাদের একধরনের আনন্দ। একটা উৎসব-আমেজ বিরাজ করছে। এ রকম দৃশ্য প্রতিদিন আমি জানালার গ্রিলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি।

একই সময়ে অবস্থান করেও আমরা দু-জন মানুষ হয়ে যাচ্ছি ভিন্ন দুই সময়ের প্রতিভূ। ভিন্ন সময়চেতনাগুলোতে আমরা যে প্রাচীনত্ব-নবীনত্ব প্রক্রিয়াগুলো আরোপ করি, তা নানান সামাজিক সংঘাতেরই অংশ। এই সময়চেতনার জন্ম মানুষের ইতিহাসবোধ জন্মানোর সঙ্গে জড়িত।

কালভেদের দূরত্ব কীভাবে কমাতে হবে, তা নিয়ে বরং কাব্য ও কৌতুক করে চমৎকার উপদেশ দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ক্ষণিকা গ্রন্থের ‘সেকাল’ কবিতায়। কালিদাসের সময়কে পুরোনো যুগ মনে হয় কবির, অথচ তার কাব্য পড়তে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের জন্য উজ্জয়িনীর সেই সময় যেন জীবন্ত হয়ে ফিরে আসে।

প্রথম মনে হয়, হয়তো সেই সময়ে জন্ম নিলে জীবনের স্বাদই অন্যরকম মনে হয়।

সারা জীবন শহরে-গ্রামে বড় হওয়া আমার মনে হয় এখন বদলে গেছে পারিপার্শ্বিক। সমাজ-সময়-মূল্যবোধ যেন অনেকটাই অপরিচিত। কথাটির মধ্যে এ শহরের মধ্যবিত্ত জীবনের ঠেলাঠেলির মধ্যে বুড়ো হচ্ছে যে শরীর, তার ক্লান্তি আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু এ সময়ে পৌঁছে আমারও মনে হয়, অনুভূতি কেবল শরীরের পরিবর্তন থেকে উদ্ভূত নয়। ক্যালেন্ডারের যেকোনো দিনেই আমরা বিবিধ পরস্পর-অসম্পর্কিত সময় দ্যোতনার মধ্যে বাস করি। অনেক সময়, যাকে পুরোনো মনে হয়, তার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাই- তখন চারপাশ নিজেকে নবীন বলে সদম্ভে ঘোষণা করেছে যে, তাকে নবীন জেনেও তার দিকে নজর ফেরে না। মনে হয় আমি পুরোনো, তা-ই সই!।

প্রসঙ্গে ফিরে আসি, যত দিন যাচ্ছে আমাদের শিক্ষার হার বাড়ছে। গুণগত শিক্ষার মান বাড়ছে কি না সে প্রশ্নটি হয়তো রয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক পরিকল্পনা, শিক্ষানীতি গৃহীত হলেও এটি এখন হিমাগারে চলে গেছে। কেউ কেউ এখন বলার চেষ্টা করছে, বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন হলো শিক্ষায় কিছু দৃশ্যমান সাফল্য। ওই আলোচনায় আমি যাচ্ছি না। তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্তর ছেলেমেয়ের সমতা অর্জন করে ফেলেছে।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী, এখন প্রাথমিকে ছাত্রীদের প্রায় ৫১ শতাংশ, যা মাধ্যমিকে ৫৪ শতাংশ। এই অর্জনের ধারা অব্যাহত রয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানিসহ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগে স্বয়ং শিক্ষকরাও অভিযুক্ত হচ্ছেন।

তবে একটা বিষয়ে অনেক দিন ধরে লক্ষ্য করছি, তা হলো স্কুলের বাইরের নিরাপত্তার দারুণ সংকট। স্কুলকে কেন্দ্র করে যেসব ভাসমান দোকান গড়ে উঠেছে, বাজার বসছে, সেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভিড়; আরেক দিকে স্কুলের সামনে পুরো রাস্তাজুড়ে রিকশা, মোটরসাইকেল এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, স্বাভাবিকভাবে হাঁটার কোনো উপায় থাকে না। এ পরিস্থিতিতে বাচ্চাগুলোকে স্কুল থেকে নিরাপদে বের করে আনা বেশ দুঃসাধ্য ব্যাপার।

সাম্প্রতিক সময়ে বুয়েটে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে অনেক খবর এখন চোখের সামনে চলে আসছে। এসব নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলন-সংগ্রাম জোরালো চলছে। কিন্তু স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে আমি অন্য অনেকের মতোই উদ্বিগ্ন।

কেন না এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের একধরনের উদাসীনতা রয়েছে।

আমার ভাগনে খিলগাঁওয়ের একটি প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী স্কুলে পড়ালেখা করছে। সবেমাত্র প্লে-গ্রুপে পড়ছে। স্কুলটি একজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে প্রতিষ্ঠিত। স্কুলটি ১৯৭৬ সালের ১ জানুয়ারি পথচলা শুরু করে। ভাগনেকে যখন স্কুল থেকে নিয়ে আসতে যাই, স্কুল ছুটির সময়, তখন দেখি স্কুলের সামনে ৬০ ফিট রাস্তা জুড়ে অসংখ্য রিকশা, মোটরসাইকেল। মাঝে মাঝে কয়েকটি গাড়িও দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। এসব পরিবহন ঠেলে অভিভাবকদের পক্ষে বাচ্চাকে স্কুল থেকে বের করে আনা অনেক কঠিন ব্যাপার।

অবস্থাটা এমন, একটা রিকশার সঙ্গে আরেকটা রিকশার সংঘর্ষ বেঁধে যায়। কখনো কখনো তাদের মধ্যে মারামারি চলে। কিংবা কোনো রিকশা-মোটরসাইকেল বা রিকশা অভিভাবক বা বাচ্চার গায়ের সঙ্গে লাগিয়ে দিচ্ছে। অনেকে অভিভাবক বা শিক্ষার্থীকে ধাক্কা দিচ্ছে। এভাবে রাস্তা পারাপার করা অনেক সময় বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে এখানে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আবার স্কুলের পাশে রাস্তার মোড়গুলোতে রিকশাগুলো আটকে রাখছে।

এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে অভিযোগ জানানো হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে তিনি এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিলেও কোনো প্রতিকার এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তার প্রতিষ্ঠানে কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। আমি যখন অভিযোগ করি, সে সময়ে ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন। তার স্কুলের সামনে যখন কয়েকটি দোকান চালু হয়েছে, এলাকার পরিবেশ নষ্ট হওয়ার অভিযোগ তুলে তিনি এসব দোকান উচ্ছেদে মানববন্ধন করেছিলেন।

স্কুলে চারজন ব্যক্তি সিকিউরিটির দায়িত্বে আছে, তাদের বারবার বলার পরও তারা এ ব্যাপারে নির্বিকার থাকে। বেশি প্রতিবাদ জানালে বড়জোর মাঝে মাঝে বাঁশির হুইসিল বাজায় মিনিট দু-একের জন্য রিকশাগুলো সরিয়ে দেয়। আবার সেই পুরোনো পরিস্থিতি ফিরে আসে। স্কুলের সামনে থেকে এসব পরিবহন সরানোর কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে তারা আগ্রহী নয়।

খিলগাঁওয়ে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনের চিত্র, দেশের অনেক স্থানেও এ চিত্র দেখা যায়। এসব অব্যবস্থাপনা-গন্ডগোলের ভেতর দিয়ে বেড়ে হচ্ছে আমাদের সন্তানরা।

আমরা দেখেছি, সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক শিক্ষার্থীকে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের অসহায়ত্ব আর অস্থিরতা বাড়ছেই। কিছুদিন আগে কিশোর বিদ্রোহ ব্যাপক আকার নিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের হতাশা, ক্ষোভ ও তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই।

কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কর্তৃপক্ষের টনক নড়লেও স্থায়ীভাবে টনক কিন্তু নড়ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে সঠিক জ্ঞান, সচেতনতা না থাকায় অনেক সময় দুর্ঘটনার শিকার হন শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। সংশ্লিষ্টদের স্বাভাবিক ঔদাসীন্যে বা অবজ্ঞাতেই দেয় আপনার-আমার বিপন্নতার দ্যোতক।

আমরা নিরাপদ সড়কের প্রশ্নে চালকদের অদক্ষতা ও খামখেয়ালির কথাই শুধু বলি। যাত্রী কিংবা পথচারীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কথা বলি না। আমার ধারণা, এ সমস্যার সমাধানে সুশাসন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সুশাসন কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষেও সম্ভব নয়, যারা তাদের সন্তানকে আনা-নেয়াতে নিজস্ব মোটরসাইকেল বা গাড়ি অথবা রিকশা নিয়ে আসেন, তাদেরও শৃঙ্খলা-সচেতনতা দরকার।

শাসনব্যবস্থার আমূল সংস্কার ছাড়া শৃঙ্খলা রক্ষা সম্ভব নয়। সড়কে যাতায়াত নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করা সম্ভব নয়।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: