বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৪৭ পূর্বাহ্ন

সংবাদপত্র শিল্প রক্ষায় সহজ শর্তে ঋণ ও প্রণোদনা দাবি নোয়াবের

নিউজ ডেস্ক : করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সংবাদপত্র শিল্পকে রক্ষায় সরকারি উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)। সামগ্রিকভাবে সংবাদপত্র শিল্পকে রক্ষা করতে সহজ শর্তে ঋণ ও প্রণোদনা জরুরি প্রয়োজন বলে অনুভব করছে সংগঠনটি। একইসঙ্গে সরকারের কাছে পাওনা বিপুল পরিমাণ বিজ্ঞাপনের বিলও দ্রুত দেওয়ার আবেদন জানিয়েছে নোয়াব। সেই সঙ্গে সংবাদপত্র শিল্পসংশ্নিষ্ট শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি নিয়ে জটিলতা নিরসনে দ্রুত ও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি জানিয়েছে তারা।

শুক্রবার নোয়াবের এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে সকল পাঠক, সাংবাদিক, বিজ্ঞাপনদাতা, এজেন্ট, হকারসহ সংশ্নিষ্ট সকল মহলকে এই দুঃসময়ে নিজ অবস্থান থেকে নোয়াবের পাশে থাকার আহ্বান জানানো হয়।

নোয়াবের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী আজকে কভিড-১৯ অতিমারির প্রভাবে অর্থনীতি থমকে পড়েছে। করোনা সংকটের প্রভাব সংবাদপত্র শিল্পের ওপরে পড়েছে ভয়াবহভাবে। দেশের সংবাদপত্র শিল্প প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। পত্রিকা বিক্রির সংখ্যা অনেক কমে গেছে। একইভাবে বিজ্ঞাপনও কমেছে ব্যাপকভাবে। ঢাকাসহ সারাদেশে অনেক সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ কিছু পত্রিকা এখন কেবল অনলাইনে প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে বহু পত্রিকা তাদের কর্মীদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না। যে পত্রিকাগুলো ছাপা চালু রেখেছে তারা বাধ্য হয়ে ব্যয় সংকোচনের নানা পদ্ধতি খুঁজছে। পত্রিকার পৃষ্ঠা সংখ্যা কমানো, ছাপার পরিমাণ কমানো, রঙিন পৃষ্ঠা কমিয়ে দেওয়া, প্রশাসনিক ব্যয় কমানো প্রভৃতি উপায়ে তারা ব্যয় সংকোচন করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিশ্বায়ন ও ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে ছাপা সংবাদপত্র এমনিতেই রুগ্‌ণ শিল্পে পরিণত হয়েছিল। করোনাভাইরাসের অতিমারি রুগ্‌ণ সংবাদপত্র শিল্পের জন্য আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সারাদেশে পত্রিকা বিক্রি কমে গেছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। বিজ্ঞাপনের আয় কমে নেমে এসেছে এক-চতুর্থাংশে। সকল দিক থেকে আয় কমে যাওয়ায় কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারছে না। কেউ অর্ধেক দিচ্ছে। অনেকে তাও দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সকল রকমের ব্যয় কমানোর চেষ্টা করেও পত্রিকাগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন অস্থিরতার কারণে চট্টগ্রামে সকল পত্রিকা ছাপা ও বিতরণ কার্যত বন্ধ হয়ে ছিল বেশ কিছু দিন।

বিবৃতিতে সংকট মোকাবিলায় নোয়াবের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, কভিড-১৯ কালীন পরিস্থিতিতে মাননীয় তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)-এর একাধিক বৈঠক হয়েছে। এই বৈঠকগুলোতে সংবাদপত্রগুলোর পক্ষ থেকে সংকট উত্তরণের জন্য একাধিক প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। এর পর পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। কিন্তু সমস্যা সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা বিশেষ কার্যকর উদ্যোগের অপেক্ষায় রয়েছি। অন্যান্য শিল্প খাত বিভিন্ন মাত্রায় সরাসরি সরকারি সহায়তা পেয়েছে। কিন্তু সরকারিভাবে সংবাদপত্র সেবাশিল্প হিসেবে স্বীকৃত হলেও এই শিল্প আজও কোনো সহায়তা পায়নি।

উল্লেখযোগ্য যে, সংবাদপত্র শিল্পের এই সংকটকালে সংবাদপত্র মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক, এজেন্ট ও হকাররা নিজেদের মাঝে আলোচনা করছেন এবং সংকট উত্তরণের পথ খুঁজছেন। বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক দাবি তারা সরকারের কাছে বিভিন্ন সময়ে পেশ করেছেন। বাংলাদেশের সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াব বরাবরই চেষ্টা চালিয়ে এসেছে যাতে সংশ্নিষ্ট সরকারি পক্ষ নীতিমালা নির্ধারণ ও বাজেট প্রণয়ন ইত্যাদির সময় সংবাদপত্র শিল্পের বাস্তব অবস্থা ওয়াকিবহাল হয়ে বিবেচনা করতে পারেন। বিগত বছরের মতো এ বছরও নোয়াব বাজেট প্রণয়নের আগে সংবাদপত্র শিল্পসংশ্নিষ্ট কর, মূল্য সংযোজন কর ইত্যাদি বিষয়ে বাস্তবানুগ দাবি জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, অর্থ মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে। কিন্তু আমরা হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, এসবের একটিও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

এতে আরও বলা হয়, বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নোয়াবের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রস্তাব ও দাবি নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে দেখা করেছেন নোয়াব নেতারা। তারা নোয়াবের উল্লিখিত বিষয়গুলো জরুরি বলে মনে করেন এবং এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে সংগঠনের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা সংবলিত লিখিত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এখনকার সংকটময় মুহূর্তে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এই শিল্পের টিকে থাকা কঠিন। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। বিগত বাজেটে এ সব দাবি বিষয়ে কিছু ছিল না। তবে সম্প্রতি তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে কিছু বকেয়া বিল পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

শ্রম আইন অনুসারে সংবাদপত্র একটি শিল্প। ২০১৪ সালে সংবাদপত্রকে সেবাশিল্প ঘোষণা করা হয়। রুগ্‌ণ শিল্পে পরিণত হওয়া সংবাদপত্রের করপোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছিল নোয়াব। একই সঙ্গে নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাদ দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। অন্যান্য দাবির মধ্যে ছিল : বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর উৎসে কর (টিডিএস) ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা এবং উৎসস্থলে কাঁচামালের ওপর ৫ শতাংশের বদলে অগ্রিম কর (এআইটি) শূন্য শতাংশ করা।

সংবাদপত্র সেবাশিল্প হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ কোনো সুবিধা পাচ্ছে না উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, যেমন তৈরি পোশাকশিল্প মুনাফা অর্জনকারী শিল্প হওয়া সত্ত্বেও এর করপোরেট ট্যাক্স ১০ থেকে ১২ শতাংশ। সংবাদপত্র সেবাশিল্প হওয়া সত্ত্বেও করপোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ। এবারের বাজেটে সকল শিল্পের জন্য ২.৫% করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সংবাদপত্রের করপোরেট ট্যাক্স ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করা জরুরি ছিল। আয়কর অধ্যাদেশ অনুসারে সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর টিডিএস ৪ শতাংশ এবং উৎসস্থলে কাঁচামালের ওপর এআইটি ৫ শতাংশসহ মোট ৯ শতাংশ। অধিকাংশ সংবাদপত্রের মোট আয়ের ৯ শতাংশ লভ্যাংশই থাকে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে টিডিএস ৪ থেকে ২ শতাংশ এবং ৫ শতাংশের বদলে এআইটি শূন্য শতাংশ দাবি করছে নোয়াব।

মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইনে সংবাদপত্র ভ্যাট থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সেবার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। তা ছাড়া এটা সেবাশিল্প এবং এই শিল্পের প্রধান কাঁচামাল নিউজপ্রিন্ট, যা মোট খরচের অর্ধেকের বেশি। ভ্যাট থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সেবার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থেকেও ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। নোয়াব নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর ভ্যাটমুক্ত সুবিধা দেওয়া অথবা সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণের দাবি করেছে।

করোনা সংকট মোকাবিলায় অন্যান্য খাতে সরকারি উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে নোয়াব বলেছে, বর্তমান কভিড-১৯ সংকটে সব খাতই কিন্তু প্রণোদনা ও সরকারের বড় রকমের সহায়তা বা ছাড় পাচ্ছে। কিন্তু সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যম এসবের বাইরে রয়ে গেছে। সংবাদপত্রের মূল কাঁচামাল নিউজপ্রিন্টে এত ভ্যাট থাকা উচিত নয়। সংবাদপত্র শিল্পে এমনিতেই যে সংকটাপন্ন অবস্থা, তাতে করপোরেট ট্যাপ, এআইটি এবং টিডিএস নামে যেসব কর আছে, সেগুলো বাদ না দিলে অথবা ন্যূনতম পর্যায়ে না আনলে এই খাত টিকবে না।

অন্যদিকে সরকারের উদ্যোগে সংবাদপত্র শিল্পের নবম ওয়েজবোর্ডের জন্য চরম অযৌক্তিক রোয়েদাদ ঘোষণা করা হয়েছে। সংবাদপত্র শিল্প আগে থেকেই এক চরম দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এই অবাস্তব রোয়েদাদ কার্যকরের চাপ তাদের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। তাই প্রস্তাবগুলো কোনোভাবেই বাস্তবায়নযোগ্য নয়। সংবাদপত্রগুলো এই রোয়েদাদ গ্রহণ করতে পারেনি। হাইকোর্টে এই বিষয়ে একাধিক রিট এখনও চলমান।
পূর্বের প্রতিটি ওয়েজবোর্ড রোয়েদাদও অবাস্তব ছিল। দেশের স্বল্পসংখ্যক সংবাদপত্রেই অতীতের ওয়েজবোর্ড রোয়েদাদ কার্যকর হয়েছে। অতীতেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিশেষ সহায়তা ও অনুদান ছিল না। উল্লেখযোগ্য কোনো সুযোগ-সুবিধাও থাকে না। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এবং ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে চাইলেই সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারছে না।

সংবাদপত্র মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের মতামত কখনোই বিবেচনায় না নেওয়ায় মজুরি বোর্ড শুধু বেতন-ভাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, যা দিন দিন এই শিল্পকে আরও রুগ্‌ণ করছে। অবাস্তব আর্থিক চাপ সামলাতে না পেরে আবশ্যিক ব্যয়গুলোও সংকোচন করতে বাধ্য হয়েছে। এমন অবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়েজবোর্ড রোয়েদাদ কার্যকর না করা বা আংশিক দেওয়া এবং সর্বোপরি প্রতিষ্ঠান বন্ধের পর্যায়ে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
এই পটভূমিতে সংবাদপত্র শিল্পের টিকে থাকাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে সামনে এসেছে মনে করছে নোয়াব। বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, এমন অবস্থায় আমরা সরকারের কাছ থেকে দেশে সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা, এই শিল্পের ব্যয়, সামগ্রিকভাবে সংবাদপত্র শিল্পকে রক্ষার জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও প্রণোদনা জরুরি প্রয়োজন বলে অনুভব করছি। একই সঙ্গে সরকারের কাছে পাওনা বিপুল পরিমাণ বিজ্ঞাপনের বিল দ্রুত পরিশোধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে সংবাদপত্র শিল্পসংশ্নিষ্ট শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি নিয়ে জটিলতা নিরসনে দ্রুত ও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি জানাই।

সকল পাঠক, সাংবাদিক, বিজ্ঞাপনদাতা, এজেন্ট ও হকারের এই দুঃসময়ে নিজ অবস্থান থেকে আমাদের পাশে থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। আপনাদের সহযোগিতা সংবাদপত্র শিল্প বাঁচিয়ে রাখার জন্য একান্ত কাম্য। আমরা সরকারসহ সংশ্নিষ্ট সকল মহলের কাছে সংবাদপত্র শিল্পকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে আবেদন জানাচ্ছি।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: