সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৪৮ পূর্বাহ্ন

মহামারিতে পৌষ-সর্বনাশের মহাকাল

নিউজ ডেস্ক :: করোনার ওপর ডেঙ্গু। তার ওপর লকডাউন স্থগিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাদবাকি সবই খুলে দেয়া হয়েছে। মদের বার মেলে দেয়া হয়েছে অনেক আগেই। খুলেমেলে যেখানে যার যা করার একটা মৌসুম যাচ্ছে। অন্যভাবে বলা যায় সেগুলো বন্ধই হয়নি। সেগুলোতে মোজমাস্তি-খাইদাই কেমন চলে নায়িকা পরীমনি, জাহাঙ্গীরের বৌ হেলেনা, মডেল মৌ-পিয়াসাদের কল্যাণে তা জানার বাকি নেই।

গণপরিবহন, দোকানপাট, অফিস-আদালত খুলে দেয়ায় অন্য রকমের আমেজ কিছু মহলে। এ নিয়ে বিশেষ করে অর্ধেক গণপরিবহন চলার বিষয়টিতে সরকারের ভেতরের গোলমাল ফাঁস হয়ে গেছে। তা বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার প্রজ্ঞাপনটি জারির পর থেকেই। পূর্ণ আসনে যাত্রী নিয়ে অর্ধেক সংখ্যক গণপরিবহন চলবে- এ শর্তটি নিয়ে সরকারের ভেতরের নানা মত বেশি ফাঁস হয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে। তাও আবার প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে। টিভি ক্যামেরায়। এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের মন্ত্রণালয়ের। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটু আলোচনা করে নিলে ভালো হতো। কারণ অর্ধেক গাড়ি চলবে, আর অর্ধেক চলবে না- এর নিশ্চয়তা কে দেবে? আগে আলাপ করলে আমরা মতামত দিতাম। বিষয়টি এখন জেলা প্রশাসন ও পুলিশের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। তারা যদি সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারে, ভালো কথা।’

ওবায়দুল কাদেরের কথার জবাব দিয়েছেন মন্ত্রীপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ার হোসেন। সেটাও প্রকাশ্যে, সংবাদ ব্রিফিংয়ে। তার মতে, এটি মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। প্রশাসন ও মালিক-শ্রমিকদের বিষয়। মন্ত্রী এবং কেবিনেট সচিবের মন্তব্যে সরকারের ভেতরের অবস্থা বুঝে নিতে একটুও কষ্ট হয়নি মানুষের। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেও কেন বিধিনিষেধ তুলে নিতে হয়েছে, তা এখন আর কারোই না বোঝার বিষয় নয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চ সংক্রমণের মধ্যে সবকিছু খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানসম্মত নয়। এতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। তখন সংক্রমণ ও মৃত্যু আরও বাড়বে। আবার যাদের খুশি হওয়ার কথা তাদের এক গ্রুপ পরিবহন মালিক। তাদের কথাবার্তাও অন্যরকম। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছেন, ‘অর্ধেক গণপরিবহন বাছাই করার মতো একটি জটিল প্রক্রিয়া বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এক মালিকের কয়টি গাড়ি আছে বা কতটা গাড়ি চালাচ্ছে- দেশব্যাপী এ বিষয়টি নির্ণয় করা একদিকে যেমন কঠিন হবে, অন্যদিকে শ্রমিকরা বেকার থাকবে এবং তাদের কষ্ট লাঘব হবে না। একই সঙ্গে অর্ধেক গাড়ি চলাচলের ফলে পরিবহন সংকট দেখা দেবে এবং যাত্রীর চাপ বাড়বে। এতে সংক্রমণ বাড়বে।

যুক্তিতে সবাই কড়া। টনটনে যুক্তি। কারো কারো যুক্তিও লাগে না। অসুখ-বিসুখ যুক্তি মানে না। এই সুযোগে ওষুধের বাণিজ্যেও কোনো নীতি-নৈতিকতা লাগছে না। করোনার সঙ্গে ডেঙ্গুর সর্বনাশ যেন তাদের পৌষ মাস ডেকে এনেছে। করোনা, ডেঙ্গু, জ্বর-সর্দি-কাশির এ মৌসুম অলিগলির অচল-অখ্যাত হাসপাতালগুলোকেও বাণিজ্যিক সাফল্য এনে দিয়েছে। আর ওষুধের চাহিদা সীমা ছাড়ানো পর্যায়ে। প্যারাসিটামলের মতো ট্যাবলেটেরও সংকট দেখা দিয়েছে। করোনায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু এরপর ওই ওষুধ সাড়ে তিন থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না। ৪শ-৬শ টাকার ইনজেকশন ১৫শ থেকে দুই হাজার টাকায় কিনতে হয়। করোনা চিকিৎসায় বেশি প্রয়োগ হয়‘ফেবিপেরাভির’। এটি মূলত ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসায় বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হয়ে থাকে। দেশীয় অনেকগুলো কোম্পানি এটি উৎপাদন করে থাকে। ২০০ মিলিগ্রামের একটি ওষুধের দাম ২শ থেকে ৪শ টাকা হলেও স্থান-কাল-পাত্রভেদে এটি বিক্রি হয় সাড়ে ৪শ থেকে ৬শ টাকায়।

করোনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ ‘রেমডিসিভির’। বেক্সিমকো, হেলথ কেয়ার, স্কয়ারসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এর উৎপাদন করে। করোনার শুরুর দিকে এটি ৪ থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। পরে ঔষধ প্রশাসন এর দাম নির্ধারণ করে দেয়। বেক্সিমকোরটি ২ হাজার টাকা, স্কয়ার সাড়ে ৪ হাজার টাকা এবং হেলথ কেয়ার সাড়ে ৫ হাজার টাকা। তবে দোকানিরা এটি এখনো সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। করোনা আক্রান্ত শ্বাসকষ্টের রোগীদের ‘মন্টিলুকাস’ ও ‘ডক্সিসাইক্লিন’ ধরনের ওষুধ নিয়েও জোচ্চুরি চলছে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্তই এই পৌষ মাস আর সর্বনাশের মহাচক্কর।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট;


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: