সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৩১ পূর্বাহ্ন

স্বল্পবাস হলেই হেনস্তার অধিকার জন্মায় না

নিউজ ডেস্ক :: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্লিভলেস ব্লাউজ ও শাড়ি পরে ফটো তুলতে গিয়ে এক মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক শিক্ষিকা কর্তৃক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। সাথে নির্যাতিত হয়েছেন একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার ও তার মা।

সেই শিক্ষিকা মনে করেন, স্লিভলেস ব্লাউজ পরে ফটো শুট করা পর্নগ্রাফি। তার মুখের ভাষা কতটা কদর্য হতে পারে তার কিছুটা প্রমাণ সেই ফটোগ্রাফার তার লেখা এক চিঠিতে বলেছেন যেটা এখন ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে ভাবতে হবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীর যৌন নিগ্রহের প্রতিবাদে যখন আন্দোলন চলছে, তখন এমন এক খবর এলো।

যে সমাজ নারীকে স্বল্প পোশাক পরিধানের দোষে ধর্ষণের জন্য দায়ী করে, সেই সমাজকে কীভাবে চপেটাঘাত করা যাবে সেটা নিয়ে ভাবা দরকার। নারী স্বল্প পোশাক পরিধান করলেই তাকে ধর্ষণ করবার শাসন করবার অধিকার কারও জন্মায় না। নারীর স্বল্পবাস পুরুষের এবং পুরুষতান্ত্রিক নারীর অজুহাত বই কিছুই না

আমরা ভুল যাইনি নরসিংদী রেলস্টেশনে নিপীড়নের শিকার হওয়া এক কিশোরীর কথা। মফস্বল শহরে কোনো এক বোরখাওয়ালি নারী হামলে পড়েছিল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েটির ওপর। সাথে ছিল স্টেশনে ঘুরে বেড়ানো বখাটেরা।

কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের প্রধানতম বিদ্যাপীঠের শিক্ষিকার আচরণ, তার মনোজগৎ ও মুখের ভাষা যদি এমন হয় তাহলে ভাবনার বিষয় আছে এই জাতির আগামী নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কী ব্যবস্থা নেবে বা এ বিষয়ে কি বক্তব্য দেবে সেটার অপেক্ষা না করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রীর এখন অবশ্য কাজ হবে স্লিভলেস ব্লাউজ ও শাড়ি পরে সেই শিক্ষিকার সামনে গিয়ে ক্যাটওয়াক করা।

নারী পোশাকের ক্ষেত্রে সামাজিক নিয়মাবলি কারা নির্ধারণ করে সেটা আমরা এখন বুঝতে পারি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় নির্ধারকের ভূমিকায় যখন এমন এক সহিংস শিক্ষিকাকে পাওয়া যায় তখন বলতে বাধ্য হতে হয়, এটি কী আর বিশ্ববিদ্যালয় আছে? নাকি বড় মাদরাসায় পরিণত হয়েছে যেটা অনেকে বলছেন অনেকদিন ধরে। এমন মনমানসিকতা যাদের তাদের কাছে পড়তে এসে কী শিখছে আমাদের সন্তানরা, সেই প্রশ্ন উঠাও অমূলক নয়।

উত্তেজনা এক বিশেষ রকম অনুভূতি যা মস্তিষ্কে তৈরি হয় এবং মানুষ তার অধীন হয়ে পড়ে। এই শিক্ষিকা বলতে চেয়েছেন স্লিভলেস ব্লাউজ পরলে উত্তেজনারবশে নাকি পুরুষরা এই মেয়েকে যৌন হেনস্তা করতে পারে, এমনকি ধর্ষণও।

অর্থাৎ পুরুষের উত্তেজনা যেন না আসে সেটা দেখভাল করার দায়িত্ব নারীর নিজেরই। এমন উর্বর মস্তিষ্কের শিক্ষিকার মনোজগৎ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় তার কাছে নারীর উত্তেজক পোশাক এক বিশাল বড় অপরাধ। তার যুক্তি নারী ‘উত্তেজক পোশাক’ পরিধান করে বলেই, পুরুষ উত্তজেনার বশবর্তী হয়ে তার ওপর চড়াও হতে বাধ্য হয়।

যে সমাজ নারীকে স্বল্প পোশাক পরিধানের দোষে ধর্ষণের জন্য দায়ী করে, সেই সমাজকে কীভাবে চপেটাঘাত করা যাবে সেটা নিয়ে ভাবা দরকার। নারী স্বল্প পোশাক পরিধান করলেই তাকে ধর্ষণ করার শাসন করার অধিকার কারও জন্মায় না। নারীর স্বল্পবাস পুরুষের এবং পুরুষতান্ত্রিক নারীর অজুহাত বই কিছুই নয়।

নিজের উত্তেজনা প্রশমন করতে না পারলে সেটা যার যার অক্ষমতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষিকা বলছিলেন, স্লিভলেস ব্লাউজের প্রকাশ্যে ছবি তোলা পর্নগ্রাফির পর্যায়ে পড়ে। এই বিকৃত মস্তিষ্কের নারীকে কে বোঝাবে যে অতি খোলামেলা পোশাক পরলেও নারীকে হেনস্তা করার অধিকার তার নেই।

পোশাক হবে আরামদায়ক, স্বচ্ছন্দ, সুবিধাজনক ও রুচিসম্মত। সে যেই হোক না কেন, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী সবার জন্যই। সমাজ-নির্মিত যে কাম্য ও স্বীকৃত নারীত্ব, এই লিঙ্গ-নির্মাণের অনেকগুলো বিধি-নিষেধের একটি প্রধান খাত মেয়েদের পোশাক। তার প্রতিফলন রাষ্ট্রচালিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটলো। অশ্লীলতার যুক্তি-প্রতিযুক্তির তর্কে না গিয়ে সহজ জিজ্ঞাসা, তা হলে মুখ থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা মধ্যপ্রাচ্যের আপামর নারী-সমাজের হাজার বছর আগের প্রবর্তিত ড্রেসকোড হিজাবই তাহলে সমাধান?

এই ভদ্রমহিলা পড়ালেখা করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত হয়েও তিনি মুক্ত আকাশের তলায় দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার কাছে নারী শুধু আবৃত আর অনাবৃতের ছকেই বাঁধা। তার হাঁটু, গ্রিবা, বাহুমূল কিংবা ক্লিভেজ অনাবৃত থেকে গেলে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

নারী ধর্ষণ ও নিগ্রহের র মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা প্রতিনিয়ত যেভাবে বেড়ে চলছে, তাতে বোঝা যায় সমাজের কাছে নারীর মূল্যায়ন কোথায় সীমাবদ্ধ। শিশু থেকে সন্ন্যাসিনী, আট থেকে আশি— সবাই যেখানে নারী দেহ হিসেবে ভাবিত ও চিহ্নিত হচ্ছেন, তখন শঙ্কার মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নারীবাদী আন্দোলনকারীরা নারীদের প্রতি অবমাননাকর আচরণের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গঠনের চেষ্টা করে চলেছেন নিরন্তর।

বাংলাদেশের নারী সমাজও বহুদিন ধরেই এই লড়াইটা করছে। প্রশ্ন হলো সেই লড়াইয়ে আদৌ সমাজের সর্বস্তরের মেয়েরা অংশগ্রহণ করতে পারছেন কি না বা পারলেও সদিচ্ছা কতটুকু।

পারছে না বা করছে না যে, তার প্রমাণ এই শিক্ষিকা যিনি পুরুষের মতো চিন্তাভাবনা করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। পুরুষের ঠিক-ভুল সিদ্ধান্তে তাল মিলিয়ে পথ চলে আত্মসন্তুষ্টির এমন ঘটনা আকছার লক্ষ্য করা যায়। এই শিক্ষিকা মানুষ নয়— নারী হিসেবে নিজেকে ভাবতে ভালোবেসে পুরুষের অঙুলি হেলনে নড়াচড়া করার মধ্যে প্রশান্তি খোঁজেন। তা সে ন্যায় হোক বা অন্যায়।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: