রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৩২ পূর্বাহ্ন

সবার নজর কেড়েছে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া চিত্রশিল্পী করিমের শিল্পকর্ম

নোবিপ্রবি থেকে শাহরিয়ার নাসের : কখনো বাড়ির দেয়ালে পছন্দের মানুষের ছবি আঁকেন, কখনো আর্ট পেপারে আঁকেন প্রকৃতির ছবি, আবার কখনো ঝড়ে পড়া পাতা কুড়িয়ে তা দিয়েই সৃষ্টি করেন শিল্পকর্ম।

তিনি আর. করিম। আঁকাই তার নেশা। দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ুয়া অসামান্য প্রতিভার অধিকারী এই তরুণের বাড়ি কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালিতে।

আর. করিমের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা গ্রামে। স্কুলের পাঠ শেষ করে বর্তমানে পড়ছেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে। এ পর্যন্ত তিনি এঁকেছেন দেশ-বিদেশের অনেক গুণীজনের ছবি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ, কবি নির্মলেন্দু গুণ, প্রয়াত সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের ছবি এঁকেছেন।

আবৃত্তির বরপুত্র শিমুল মুস্তাফা’র ছবি, সঙ্গীত জ্যোতিষ্ক মান্না দে’র ছবি, সঙ্গীত শিল্পী ভুপেন হাজারিকার ছবিও এঁকেছেন। এঁকেছেন বিখ্যাত বাউল শিল্পী কদ্দুস বয়াতি’র ছবি, গায়ক মনির খানে’র ছবি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, কৃষি ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ এর উপস্থাপক শাইখ সিরাজ, বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ এর সঞ্চালক হানিফ সংকেতের ছবি।

ছবি এঁকে এ পর্যন্ত বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন আর. করিম। রয়েছে নানা অর্জন। পেন্সিলে আঁকা কবি নির্মলেন্দু গুণের ছবি যার জন্যে কবি নির্মলেন্দু গুণ তার(করিম) কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তাঁর কবিতাকুঞ্জ বইতে ব্যবহার করেছেন। সম্প্রতি বাউলশিল্পী কদ্দুস বয়াতি তার অফিসিয়াল ফেসবুকে পেজে তাঁকে (বয়াতি) আঁকা ছবি শেয়ার দিয়ে করিমকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

করিমের চিত্রকর্ম শোভা পাচ্ছে সেলেব্রিটিসহ অনেকের ফেসবুক টাইমলাইন, বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ আর ইউটিউবে।

আর. করিম বলেন, ‘ছোটবেলা হতেই আঁকাআঁকি আমার পছন্দের। যখন নার্সারিতে পড়ি তখন থেকে আঁকাআঁকি শুরু। তখন পাঠ্য বইয়ের সাথে একটি ছবি আঁকার বইও ছিলো। বলতে গেলে সে বইটিই আমার ছবি আঁকার উৎস। ছবি আঁকার সে বইটা কেনো জানি আমাকে খুব আকর্ষণ করতো।

আমি ক্লাসের বাইরেও বাড়িতে বইটি দেখে দেখে সে বইয়ের ফুল, ফল, লতা,পাতা এবং পাখি ইত্যাদি এসবের ছবি আঁকতে চেষ্টা করতাম। এ বই ছাড়াও অনন্য বইয়ের অলংকরন গুলো দেখতাম। শুধু যে আমার বই গুলো দেখতাম তা কিন্তু নয়।

আমার বড় ভাই-বোনদের বইগুলোও দেখতাম আর বইয়ের অলংকরণ দেখে আঁকা-আঁকি করতাম। এভাবে গেল ২ বছর। এরপর আমাকে ভর্তি করানো হয় প্রাইমারি স্কুলে ২য় শ্রেণিতে। তখন প্রাইমারির বইতে আমি দেখতে পাই হাতে আঁকা রঙিন অলংকরণ। যা এর আগে দেখিনি।

প্রাইমারিতে এসে আমার ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁকটা বেড়ে যায় আরো। ক্লাসে বসে, বাড়িতে যখন তখন ছবি আঁকতাম। কয়লা দিয়েও এঁকেছি। এমন কি মাটিতে হাত দিয়ে পর্যন্ত এঁকেছিলাম। নার্সারিতে পড়ার সময় যে ছবি আঁকতাম সে থেকে আমার পরিবার আমার ছবি প্রেম সম্পর্কে ধরে নিয়েছিলেন।

মা-বাবা, ভাইবোন সবাই উৎসাহ দিতেন ছবি এঁকে দেখালে। কে.জি. স্কুল থেকে যখন প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয় তখন আমার ছবি আঁকার ব্যাপারটি আলাদা ভাবে অনেকের নজরে আসে। পুরো এলাকায় এবং পুরো স্কুলে জানাজানি হয়ে যায় যে আমি ছবি আঁকি । বলতে গেলে এভাবেই আমার হাতেখড়ি শুরু হয়।

তিনি বলেন, ‘আমি শব্দ শিল্পী নই। আমি একজন ক্ষুদ্র আঁকিয়ে। জানিনা রংতুলিতে কতটা বোঝাতে পারি। তবে কিছু জিনিস একেঁ বোঝাতে পারলে আমি সন্তুষ্ট হই। শৈশব আমার কাজের খোরাক জোগায় অনেক ক্ষেত্রে। তাই এখন আমার ক্যানভাস জুড়ে রংতুলিতে স্মৃতির আল্পনা বিরাজ করে।

এখন শৈশব নিয়ে আমার রংতুলি আমাকে এমন কিছু ছবি উপহার দেয় যে ছবির ভেতর দিয়ে আমি সে বন্ধুদের সাথে আবার বিকাল বেলায় দল বেঁধে খেলতে যাই। আমি আমার ছোটবেলাকে লালন করি আমার কাজের মধ্য দিয়ে৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গানের মতো ‘ মুছে যাওয়া দিন গুলি আমায় যে পিছু ডাকে, স্মৃতি যেনো আমার এ হৃদয়ে বেদনার রঙে রঙে ছবি আঁকে। ‘

উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে চারুকলা নিয়ে পড়ার আগ্রহ এই তরুণ চিত্রশিল্পীর। তিনি বলেন, ‘চারুকলা নিয়ে পড়ার বেশ আগ্রহ আমার। দেখি সামনে কি হয়। তবে চেষ্টা করে যাব। আমি আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব বিরতিহীন। পড়াশোনার পাশাপাশি ভিন্ন কিছু করার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ভিন্ন কিছু করার চিন্তাটা আমি করিনি।

আমাকে করিয়েছে। হ্যাঁ যদি ছবি আঁকার শুরুর কথা বলি তাহলে অনেকটা এ রকমই। করতে করতে স্তর থেকে স্তরে আসতে আসতে আমার কাজকে আমি বুঝতে শিখি। একটা পর্যায়ে এসে মনে হয়েছিলো এ বিদ্যাটা আমাকে ধরে রাখতে হবে। এরপর আরেকটা পর্যায়ে এসে বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাম ছবি আঁকাটা আমার ভেতরেই আছে।

চাইলেও এটা না করে থাকতে পারবোনা। তখন থেকে একাবারে পুরোদমে কাজ শুরু করি। এখনো পড়ালেখার পাশাপাশি বুঝে বুঝে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং যাব।’

গণ মানুষের ভালোবাসাটাকেই নিজের বড় অর্জন বলে মনে করেন এই তরুণ। তিনি বলেন,’ দিন দিন নতুন নতুন কত কিছুর সাথেই তো পরিচিত হচ্ছি, কতো কিছুই তো শিখছি। এ শিখাটাই তো পরিবর্তন এ শিখাটাই তো অর্জন।

যদি এ থেকে কয়েকটা উল্লেখযোগ্য অর্জনের কথা বলি তা হচ্ছে – ছবি এঁকে অনেক টাকা উপার্জন করেছি, ছবি আঁকার জন্য অনেক জায়গায় পুরস্কৃত হয়েছি, এবং সবচেয়ে বড় যেটা পেয়েছি বা পাচ্ছি সেটা হচ্ছে মানুষের অজস্র ভালোবাসা। এ ভালোবাসাটাই আমার কাছে বড় অর্জন।

এ অর্জনটাই আমি ধরে রাখতে চাই। আরো মানুষ জমাতে চাই। আমি মনে করি কোনো কাজের জন্য পুরস্কার পাওয়া মানে সে কাজের প্রতি দায়িত্ব বেড়ে যাওয়া। আমার কাছে টাকা, ক্রেষ্ট, সনদ এবং ভালোবাসা এ সবই একেকটি পুরস্কারের মতো। এ অর্জন গুলো আমাকে কাজের প্রতি দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই বিরতিহীন আপন চিত্তে এঁকে যাচ্ছি।

ছবি আঁকার মাধ্যমে পুরো জগতকে চেনা যায় বলে মনে করেন এই তরুণ চিত্রশিল্পী। ভালোবাসেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এবং এসএম সুলতানের আদর্শ। তিনি বলেন, ছবি আঁকার মাধ্যমে পুরো জগতকে চেনা যায়, পুরো জগতের গল্পকে চেনা যায়। এ ছবি আঁকা শিখাচ্ছে আমাকে আদব-কায়দা, চরিত্রের গঠন ইত্যাদি । যখন প্রাইমারিতে পড়ি তখন প্রাতিষ্ঠানিক বইয়ের বাইরে কিছু পত্র-পত্রিকা পড়ার সুযোগ হয়েছিলো।

সেখানে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এবং এস এম সুলতানকে নতুনভাবে জানতে পারি। মহান দুই শিল্পীর কথাগুলো আমাকে ভিন্নভাবে চিন্তা আগেও করাতো , এখনো করায়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সম্পর্কে পড়তে গিয়ে জেনেছিলাম ‘শিল্পী মানে একজন মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন মানুষ’। তারপর এস এম সুলতান সম্পর্কে পড়তে গিয়ে জেনেছিলাম ‘শিল্পবিদ্যা চর্চায় মানুষের চরিত্র গঠন হয়’। তাঁরা আমার আদর্শ। তাঁদের মহা মূল্যবান কথা গুলো আমার জীবনে কতটা প্রতিফলন হয়েছে জানিনা, তবে আমি প্রভাবিত হয়েছি, হচ্ছি এবং চেষ্টা করে যাচ্ছি।

পড়াশোনা আর আঁকাআঁকির পাশাপাশি করিম উপজেলা শিল্পকলা অ্যাকাডেমি, উপজেলা উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), মহেশখালী পৌর শাখা, বাংলাদেশ চারুশিল্পী অধিকার আন্দোলন, কক্সবাজার আর্ট ক্লাব এবং মনির খান সংঘসহ বেশকিছু স্থানীয় সামাজিক সংগঠনে কাজ করেন। তিনি বলেন,’ সংগঠনগুলো আমার প্রাণের সংগঠন। আমি যখন যেটা করি সেটা একাবারে মন থেকেই করি। এ সংগঠনগুলোর আদর্শের প্রভাবে আমি অনেকটা প্রভাবিত। আসলে আমার জন্য এই পরিসর গুলো অনেক জরুরী বলে মনে করি। এ থেকে আমি অনেক কিছু শিখছি।

দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়েও ভাবেন এবং স্বপ্ন দেখেন আর. করিম। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু অভিন্ন। সকল অর্থে নীতিই বাংলাদেশ। আমি এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে থাকবেনা ধর্মীয় গোড়ামী, শ্রেণিবৈষম্য, গুজবের কারণে হানাহানি, নারী সহিংসতা, শিশুনির্যাতন, দালালী, শান্তির নামে ধোঁকাবাজি, পুঁজিবাদ, গুম, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি এবং নানা কুসংস্কার। প্রতিদিন সংবাদ পত্রে সুসংবাদের চেয়ে দুঃসংবাদই যখন বেশী দেখি তখন ভেঙে পড়ি। তা দেখে উজ্জীবিত হইনা মোটেও নতুন করে বেঁচে থাকার।

তার পরেও থেমে থাকিনা, স্বপ্ন দেখি। একাত্তরে যেহেতু আমরা একবার বিজয় হয়েছিলাম তাই স্বপ্ন দেখাটা আমাদের মানায়। আমাদের জাগতে হবে। আমি মনে করি যারা সত্যিকারের দেশ নিয়ে ভাবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে চলে, কোনো প্রকার অস্তিরতা তাদের কাজে বাঁধা হতে পারেনা। আমি বিশ্বাস করি সকল কালিমা মোচন করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরবার ক্ষমতা আমাদের তরুণপ্রজন্মের আছে। শুধু প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছার।’


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: