রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৩:০০ পূর্বাহ্ন

ঘরবন্দি নারী-শিশুরা সহিংসতার শিকার

নিউজ ডেস্ক :: করোনা মহামারিতে বিশ্ব জুড়েই সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। লকডাউনে ঘরবন্দি মানুষের মানসিক অশান্তির চরম বহিঃপ্রকাশ ঠেকেছিল নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতায়। ফলে বেড়েছে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংস অপরাধ। এ সময় দেশে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি বেড়েছে বিবাহবিচ্ছেদেরও হার। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার কারণে কর্মক্ষেত্রে চাকরিচ্যুত হওয়া, আর্থিক অনটন, সংসারে বিভিন্ন দিকে সমন্বয় করে চলা প্রভৃতি সামলাতে গিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন অনেকে।

তবে মহামারির এই বছর একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা যখন দেশে ঘটছিল তখন রাজধানীসহ সারা দেশে দলে দলে নারীরা রাজপথে নেমে আসে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে। দেশ জুড়ে নারী নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের ঘটনার তুমুল প্রতিবাদের মুখে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ সংশোধন করে সম্প্রতি আইন পাশ করে সরকার। আগে কেবল সংঘবদ্ধ ধর্ষণ বা ধর্ষণের পর হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড’ ছিল, আইনের সংশোধনিতে ধর্ষণের জন্যও সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড’ করা হয়।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে তুলে নিয়ে এক গৃহবধূকে স্বামীর সামনে পালাক্রমে ধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। ঐ ঘটনার পর ৪ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে একদল যুবক পাশবিক কায়দায় নির্যাতন করে, সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এ নিয়ে দেশ জুড়ে তুমুল প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ৯ অক্টোবর বিকালে রাজধানীর শাহবাগে ‘ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী মহাসমাবেশ হয়। সেখানে নারী নির্যাতন বিশেষ করে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করা হয়। শাহবাগ থেকে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই গণ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন আইন- ২০০০-এর কয়েকটি ধারা সংশোধন করে।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, আইনের এমন সংশোধনীর পরও বন্ধ হচ্ছে না ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের ঘটনা। এক্ষেত্রে অতীতে বিচারহীনতার নজিরকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত না করলে আইন সংশোধন করেও কোনো ফায়দা হবে না। সেজন্য দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন, ঘটনার সঠিক অনুসন্ধান ও তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, সময়ের সঙ্গে সহিংসতার রূপ পরিবর্তিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশের নারী ও শিশুরা এর প্রধান শিকার হচ্ছে। কিন্তু বিচার-প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, দুর্নীতি, তদন্তে অবহেলা ও ধীরগতির কারণে অপরাধীরা অনেক সময় শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। তিনি নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে শুধু নারী ও শিশু সংক্রান্ত মামলা হয়েছে অন্তত ১৮ হাজার ২২১টি। বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেশের ২৭ জেলায় এপ্রিল মাসে ৪ হাজার ২৪৯ জন নারী এবং ৪৫৬টি শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। বাল্যবিবাহ হয়েছে ৩৩টি। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, স্বামীর হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮৪৮ নারী, মানসিক নির্যাতনের শিকার ২ হাজার ৮, যৌন নির্যাতনের শিকার ৮৫ জন এবং অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৩০৮ জন নারী। জরিপে অংশ নেওয়া ১ হাজার ৬৭২ জন নারী এবং ৪২৪টি শিশু আগে কখনো নির্যাতনের শিকার হয়নি। শিশুদের মধ্যে শতকরা ৯২ ভাগ তাদের বাবা-মা ও আত্মীয়দের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে। আর নারীরা বেশির ভাগই স্বামীর হাতে।

বেড়েছে শিশু নির্যাতন :
এ বছর করোনা মহামারিতে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে শিশু নির্যাতন। করোনাকালে শুধু এপ্রিল মাসেই দেশের ২৭ জেলায় ৩৫ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যেখানে পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সারা দেশে ৪৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। এই জরিপে প্রকাশ পায়, ৪৫৬ শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। যাদের মধ্যে ৪২৪ শিশু আগে কখনো নির্যাতনের শিকার হয়নি। আর জুনের তুলনায় জুলাই মাসে কর্মক্ষেত্রে শিশু নির্যাতনের হার শতকরা ১৩৭ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, শিশুর প্রতি নির্যাতনের হার বেড়ে যাওয়ার এই হার খুব ভয়াবহ। তিনি সরকারকে অন্যসব জরুরি অবস্থার পাশাপাশি শিশুদের নিরাপত্তার প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি দিতে আহ্বান জানান।

এদিকে দেশের শ্রমজীবী শিশুদের প্রায় ৮৬ দশমিক ৬ ভাগ শিশু করোনাকালে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট-এএসডির উদ্যোগে পরিচালিত কোভিড-১৯-এর প্রভাবে ঢাকায় কর্মরত শ্রমজীবী শিশুদের অবস্থা যাচাই শীর্ষক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। এএসডির নির্বাহী পরিচালক জামিল এইচ চৌধুরী বলেন, করোনার কারণে প্রথমত নিম্ন ও দরিদ্র পরিবারের শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। দ্বিতীয়ত পরিবারের আয়ের যোগান দিতে গিয়ে অনেক শিশুই শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, এমনকি অনেকে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ছে। তৃতীয়ত অনেক মেয়েশিশু বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। চতুর্থত স্কুল বন্ধ থাকায় ঘরের মধ্যে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

রাজধানীতে বেড়েছে তালাক :
করোনা মহামারিতে এ বছর বিবাহ বিচ্ছেদও বেড়েছে আশাঙ্কাজনক হারে। রাজধানীতে তালাক হচ্ছে দিনে ৩৯টি করে। চলতি বছর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ঢাকায় বিবাহবিচ্ছেদ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। বিবাহবিচ্ছেদের কারণের মধ্যে রয়েছে করোনা মহামারিতে তৈরি হওয়া মানসিক চাপ, আর্থিক সংকটের পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন এবং যোগাযোগ কমে যাওয়া। দুই সিটির মেয়রের কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন থেকে অক্টোবর মাসে তালাক হয়েছে ৫ হাজার ৯৭০টি।

বাড়ছে মানসিক চাপ :
করোনায় শারীরিক দূরত্বের সঙ্গে বেড়েছে মানসিক চাপও। এর প্রভাব পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্যে। এর শিকার হচ্ছে নারী ও শিশুরা। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে শারীরিক সংস্পর্শ জরুরি। কেননা স্পর্শ শরীরে বিভিন্ন হরমোনের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে, যা প্রয়োজনীয় অনুভূতির জন্ম দেয় ও মানসিক চাপ থেকে মুক্ত রাখে। কিন্তু দীর্ঘদিন সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা মানসিক দূরত্ব তৈরি করে ও এতে শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় ।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: