রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:২২ অপরাহ্ন

চীন–মার্কিন: সম্পর্কের বিবর্তনশীলতায় কে এগিয়ে? – কাদের চৌধুরী

১৮শতকের শেষ পাদ থেকেই আমেরিকা বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্ধিষ্ণু বৃহৎ শক্তি হিসাবে উদয় হয়, ইউরোপীয় শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে। নাম্বার-১ হয়েছিল, আজও আছে। তার এ মর্যাদা আজ চ্যালেঞ্জের সামনে।

গেল শতকের মাঝামাঝি কাল হতেই কমিউনিস্ট চীন তাদের সাম্রাজ্যবাদী ‘কুকুর’, ‌‘কাগুজে বাঘ’ ইত্যাদি বলে আসছিল। তখন কোন সম্পর্ক ছিল না।

আজ চীনের বিষয়ে ১৯৭০’র প্রেসি. নিক্সনকে সনাতন কূটনৈতিক চত্বরে তার সুদূর দৃষ্টিপাতের জন্য ‘প্রফেট’ মনে করা হয়। কেননা, চীন আগামীতে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্ধী সামরিক শক্তি হতে যাচ্ছে, তখন এমনটা মনে করেই তার নিরাপত্তা উপদেস্তা ডঃ হেনরি কিসিঞ্জারকে চীনের সাথে সম্পর্ক গড়ার আদেশ দিয়েছিলেন। সেই থেকে শুরু …।
টেবিলে এখন (২০২১) প্রশ্ন, কে হবে বিশ্বের পরবর্তী প্রজন্মের নাম্বার ওয়ান (#১) ?

বর্তমান আমেরিকা না উদীয়মান চীন?
এ প্রশ্নে চীন কি ভাবছে? চীন কেমন আচরণ করবে মার্কিনীদের আচরণের বিপরীতে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে? আমেরিকা/তার বন্ধুরা নিজেদের মর্যাদা সংহত করার জন্য কতটুকু কি করতে চাইবে বা পারবে? নানান প্রশ্ন আলোচনায় – ।

২০০৮-০৯’র অর্থনৈতিক সংকট কালে এ দুই দেশের সম্পর্ক ছিল ‘পারস্পরিক নির্ভরশীলতা’র । চীনের দরকার ছিল তার রপ্তানি আমেরিকা তথা পশ্চিমা বাজারে প্রসার করা। সংকট-গ্রস্ত আমেরিকার দরকার ছিল নিজেদের ট্রেজারি বিল চীনাদের বিক্রি করে ক্যাশ-মানীর। আমেরিকানদের মাথাপিছু সঞ্চয় তখন অত্যন্ত নগণ্য ছিল, কেনার জন্য ক্যাশ ছিল না। সঞ্চয় ছিল জি.দি.পি’র মাত্র ২%+। তাঁরা উভয় দেশই তখন অর্থনীতিতে ‘কোমরে-কোমর রেখে’ অভিসার করেছে, করতে হয়েছে (টম ফ্রিগম্যান তার ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ কলামের ভাষা )।

চীনা নয়া মাইন্ড-সেট বুঝতে একটা কথা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ঝু-চিং-পিং ইউনেস্কো’র মিটিঙে একবার (মার্চ, ২০০১৪) এক ইঙ্গিতপূর্ণ ও বিশেষ প্রাণিধানযোগ্য কথা বলেছিলেন। চীন তার সভ্যতাকে ‘পুনরুজ্জীবন’, হৃত গৌরব / ঐতিহ্য ‘পুনরুদ্ধার’ ও জনগণের সুখ নিশ্চিত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সব নেতারাই যে ভাবে বলেন, অর্থ সেভাবে হয়ত নয়। এ ‘চীনা স্বপ্ন’ বাস্তবায়নে এমন এক নীতি-কৌশল অনুসরণ করছিল, যেখানে উন্নয়ন বস্তুগত বিকাশের সাথে সাথে সভ্যতা-সংস্কৃতি বিকাশেরও ভারসাম্য যেন থাকে। এতে স্পষ্ট বোধগম্য যে, চীন অতীতে যেভাবে পশ্চিমাদের দ্বারা লাঞ্ছিত, অপমানিত, অত্যাচারিত হয়েছিল, তার ‘উপযুক্ত জবাব’ দিতেই কাজ করছে।

পশ্চিম ভেবেছিল, হয়ত চীন প্রশাসন গণতন্ত্রে / উদারতায় ফিরে যাবে। রাশিয়ার মত। বাস্তবে চীন তা করছে না। চোখের সামনেই দেখেছে, রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তনের পর রাশিয়া কীভাবে ধসে পরেছিল। তবে চীন পাশাপাশি নাগরিকদের ‘সীমিত অধিকার’ দেবে, জাতীয়তাবাদের ঝুঁকবে; এবং ঘরে-বাইরে আগ্রাসীও হবে। এটা তাদের পার্টির একান্তই নিজস্ব কৌশল।

জাতীয় অর্থনীতিতে ২০১৪ সনেই চীন আমেরিকাকে পেছনে ফেলার অবস্থানে আসে। এরপর ‘কোমরে–কোমরে’ দোলানোর উষ্ণ সম্পর্কে আর নেই, তা শীতল হতে থাকে। কিসিঞ্জার ’৭১এর পর সম্পর্কটা উম্মুচন করেছিল। এরপর আমেরিকা চীনকে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবেশের বড় সুযোগ করে দেয়। বিশেষত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় সদস্য করতে সাহায্য করে। বিশ্ব বাণিজ্যে চীনের তা একান্তই দরকার ছিল তখন। রাশিয়াকে মোকাবেলার জন্য আমেরিকা তা করতে হয়েছিল, স্পস্থটই। ‘ঠাণ্ডা–লড়াইয়ের’ যুগে।

এরপর, আমেরিকার সাথে ১৯৮৯’ তে তিয়েন-মিয়েন স্কোয়ার (পিকিং) হত্যাযজ্ঞ পর সম্পর্ক খারাপ হয়। বিল ক্লিনটন (১৯৯২) তার নির্বাচন প্রচারে বলেছিলেন, আমি নির্বাচিত হলে এই ‘এশিয়ার কসাইদের’ সাথে গলাগলি করব না। কিন্ত, পরের বছরই সিয়াটলে ‘এপেক’ মিটিঙে জিয়াং ঝেমিন এলে ক্লিনটন এ সব ভুলেও এ জাতীয় কুটবাক্য ব্যয় করেন নি। দিনের শেষে, বরং প্রেসি. ঝেমিনকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করেছেন; – আমেরিকা বিশ্বের নাম্বার-১ দেশের প্রেসি. হিসাবে। বরং চীনকে কাছে টানতে চেষ্টা করেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ক্লিনটন তাদের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর মেয়াদে প্রতি বছর ২৫০ চীনা ছাত্রদের পড়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। চীন এ সবে অনেক উপকৃত হয়েছিল। মার্কিনী জ্ঞান-দক্ষতা অর্জন করে চীন নিজেদের ভিত্তি শক্ত করেছিল, করছেও।

কৌশল ও ধৈর্যের সাথে, চীনরা মার্কিনীদের সম্পর্ক লালন করেছিল। ১৯৯৯-এ বেল্গ্রেডে চীনা দূতাবাসে মার্কিনীদের মদদে ন্যাটো বোমা ফেলেছিল। বিপুল ক্ষয় ক্ষতি হয়েছিল। পরে ন্যাটো বলে, “ভুল বশত” এটা হয়েছিল; ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল। চীনারা নীরবে তা হজমও করেছিল। দেশে অগমানিত চীনারা ক্ষেপেছিল, অপমানিত হয়েছিল। চীনা সরকার বলেছিল, আমেরিকার সাথে তাদের সম্পর্ক আরও “অধিক গুরুত্বপূর্ণ”। এ ভাবেই উভয় দেশই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বিভিন্ন চড়াই উৎরাইয়ের মাঝে আগলে রাখা হয়েছিল।
চীনের বড় কৌশল ছিল, সম্পর্ক স্থিতিশীল ও গতিশীল রেখেই অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করা।

মার্কিনীদের আচরণ নিয়েও অনেক কথা। গোঁয়ার্তমি, একতরফা, বিশ্ব ব্যাবস্থাকে পদদলিত করা, এমন কি বন্ধু দেশের স্বার্থও খর্ব করার দায়িত্ব-জ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড, এ সবই ছিল এদের মূল বৈশিষ্ট্য; যা বিশ্বের নাম্বার-১ দেশের সাথে মানায় না।

একটা মজার বিষয় আছে। ক্লিনটন ২০০৩-এ নিজ দেশের নাগরিকদের এক ভাষণে সতর্ক করেছিলেন এই বলে যে, যদি তুমি (আমেরিকা) মনে কর তুমি নাম্বার#১, তোমার অনেক ক্ষমতা, বিশ্বকে অবজ্ঞা কর, আগ্রাসী হও , তাই নীতি বিসর্জন দিয়ে যখন যা ইচ্ছে তা-ই কর, তা হলে তোমাকে যখন নাম্বার-২ আসনে বসতে হবে বা বসার উপক্রম হবে, তখন তুমিও একই ধরনের আচরণই প্রত্যাশা করতে পার। পরে এ নিয়ে ঘরে সমালোচনা হয়েছিল যে, ক্লিনটন এমনতর মন্তব্য করে মানুষকে পরোক্ষ ভাবে চীনকে ‘ভবিষ্যতের নাম্বার-১’ বলে ভাবতে সহায়তা/ইঙ্গিত করেন। উল্লেখ্য যে, ক্লিনটন এ জাতীয় কথা আর কখনো বলেন নি। এভাবেই “#১”র ধারণটা আন্দরমহলের টেবিলে আসে।

বিশ্বের নাম্বার-১ একদা ছিল ইতালি, তার পর গ্রেট ব্রিটেন, এখন এরা মার্কিনীদের ভাল বন্ধু। ‘বহু পাক্ষিক বিশ্ব-ব্যবস্থা’ – একতরফা নয়-সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে গত দশকে এই মার্কিনের বিরুদ্ধে ‘ভেটো’ দিয়েছিল এক বন্ধু, ব্রিটেন (সাবেক #১)। বুঝিয়েছিল, বিশ্ব ব্যবস্থাকে অবজ্ঞা করে গায়ের জোরে নিজ ইচ্ছা মত একক ভাবে মার্কিন বা যেই হোক, তা করতে পারে না। রাষ্ট্রপুঞ্জকে মানে–অন্য কয়েক মাতব্বরদের-মেনে চলতে হবে।
একই প্রশ্ন চীনকেও করা যায়। চীন কি তাহলে ন্যায্যতা ও সমতা ভিত্তিক বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে আচরণ করে? অনেকেই জানেন, Asian InfraStructure Investment Bank (AIIB)-এর কথা । এটা বাস্তবে এশিয়ায় সেই আই.এম.এফ.’রি (IMF) মত। বিভিন্ন দেশে মেগা প্রোজেক্টে অর্থ ঋন ও অন্যান্য সাহায্য দেবে, অনেক সময় জটিল শর্তে / সুদে এবং সে গুলো কোন ভাবে বাস্তবায়ন করে, কখনো পরিচালনাও করে শেয়ারে। গ্রহীতা দেশের বিপদের সময়, একপর্যায়ে সেখানে রাজনৈতিক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব ও হস্তক্ষেপ করে আসছে। এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। এমন কি, মার্কিনের সাথে নাজুক বৈদেশিক বাণিজ্য লেনদেনে মার্কিন ডলার বিনিময় মধ্যমে না করে প্রায়ই চীনা ইয়েনেও করতে বাধ্য করার চেষ্টা করে। বাস্তবতা সম্প্রতি এ ধারাই বয়ে চলেছে। রুঢ় না শুনালে, চীন এখন নব্য সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকায় !? ‘নাম্বার#১’ পাওয়ার হিসাবে সাধারণত আমেরিকা যে অসংলগ্ন আচরণ করে আসছে তেমনি চীনও করে এটাই হয়ত বুঝাতে চায় যে, এরা পরবর্তী নাম্বার #১ পাওয়ার হতে যাচ্ছে !

মার্কিনীদের সনাতনী অর্থনৈতিক কৌশল অনুসারে, বিশেষ কোন মুদ্রা-সংকট কালে (যেমন ২০০৮-’০৯) মুদ্রা-মুদ্রন করতে পারে রাষ্ট্রীয় বৃহৎ ব্যয় মেটানোর জন্য। এর পাশাপাশি, যেমন গত ইরাক যুদ্ধের পর মুদ্রা-বাজার সচল রাখার উদ্দেশ্যে প্রচুর সরকারী বন্ডও বাজারে ছেড়েছিল। আমেরিকায় সে কালে মোট আমেরিকান ডিবেঞ্চার/ বন্ড ৪৫% এর উপর চীনা কর্পোরেট বিনিয়োগকারীরা এসব কিনে। তথ্য-প্রযুক্তি খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ চীনা বিনিয়োগকারীদের, অন্যান্য খাত তো আছেই। মার্কিন আভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে চীনা বিনিয়োগকারীরা সুবিধাজনক ভারত কেন্দ্রে আছে, যাদের কাছে আমেরিকা দেনাদার। অবশ্য টা স্বাভাবিক।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: