শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩৯ অপরাহ্ন

দেশে শহর-গ্রামে ব্যাপক বৈষম্য

নিউজ ডেস্ক :: রাজধানীর মনিপুর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শেওড়াপাড়া শাখার বিজ্ঞান বিভাগের নবম শ্রেণির ছাত্রী সাইফা আহমেদ। করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকায় তার বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা অনলাইনে ক্লাস নেন। সকাল ৮টা থেকে ক্লাস শুরু হয়ে ১০টা ২০ মিনিটে শেষ হয়। প্রতিদিন তিনটি করে বিষয়ের ক্লাস নেওয়া হয়। সরকারি ছুটির দিন বাদে সপ্তাহে ছয় দিন অনলাইন ক্লাস চলে। গত তিন মাসে সাইফার ২০২১ শিক্ষাবর্ষের সিলেবাসের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শেষ হয়ে এসেছে।

মাগুরা জেলার সদর উপজেলার নড়িহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ২১৩ জন। সবাই অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত। প্রধান শিক্ষক মমতাজ পারভীন বলেন, ২১৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ১৬ জনের অ্যান্ড্রয়েড ফোন আছে। কীভাবে অনলাইন ক্লাস নেব? তিনি জানান, তারা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো নির্দিষ্ট বই যেমন বাংলা বইয়ের পৃষ্ঠা নম্বর কয়েকটি বলে পড়া দিয়ে দেন। বলে দেন বাড়িতে বড় ভাইবোন ও কারও থেকে পড়ে নিতে। সাত দিন বা ১৫ দিন পর আবারও পড়া দেন। তবে বাস্তবে এই শিক্ষার্থীরা পড়ছে কিনা তা শিক্ষকদের জানা নেই।

একই উপজেলার ফুলবাড়ী হাজী মতিয়ার রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আরজু মিয়া জানাল, সত্যি কথা বলতে কি, স্কুল থেকে বই এনেছি জানুয়ারি মাসে। রেখে দিয়েছি। এখন বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করি। স্কুল খুললে বই নিয়ে স্কুলে যাব। ‘গত কয়েক মাসে বই খোলোনি’- জানতে চাইলে কৃষক পরিবারের সন্তান আরজু অকপটে বলে,’মাঝে মাঝে বইখাতার ধুলো ঝেড়ে রেখে দিই। গত পরশু কালবৈশাখী উঠেছিল। তখনও ধুলো ঝেড়েছি।’

সাইফা আর আরজু দু’জনই মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। একজন রাজধানীতে বাস করে নামি স্কুলে পড়ছে। অনলাইন ক্লাস করে সে সিলেবাসের এক-তৃতীয়াংশ শেষ করেছে। আরেকজন বইপত্র এখনও খুলেও দেখেনি। করোনাকালে সারাদেশে গ্রাম ও শহরের মধ্যে অনলাইন ক্লাস নিয়ে বড় ধরনের বৈষম্য তৈরি হচ্ছে শিক্ষায়।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল, নটর ডেম কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা কমার্স কলেজ, হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রাজউক উত্তরা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, খিলগাঁও ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সাউথপয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ নামিদামি স্কুল ও অখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে নিয়মিত। খ্যাতানামা প্রতিটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড পরিচালিত স্কুলগুলোও অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। অন্যদিকে, সরকারি নির্দেশনা থাকলেও গ্রাম ও মফস্বলের স্কুলগুলো অনলাইন ক্লাস কাগজেকলমে নিলেও বাস্তবে নিচ্ছে না। কোথাও কোথাও শিক্ষকরা দায়সারা গোছের ক্লাস ভিডিও করে তা ফেসবুক ও ইউটিউবে ছেড়ে দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা তা আদৌ দেখছে কিনা, তা শিক্ষকরা জানেন না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রামাঞ্চলে বাড়িতে বসে থাকা শিশু শিক্ষার্থীরা করোনাকালে শিশুশ্রমে জড়াচ্ছে। কন্যাশিশুদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে অভিভাবকদের মাঝে।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিক্ষায় বৈষম্য আগেও ছিল। নানা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আমরা তা জানতাম। তবে এখন করোনাকালে এসব বৈষম্য ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। আগে উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত বৈষম্য ছিল। এখন উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের পরস্পরের মধ্যেই বৈষম্য। গ্রাম আর শহরের মধ্যেও বৈষম্য তো প্রকটভাবেই দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি বলেন, সিপিডি আর বিআইডিএসের তথ্য মতে, অতিরিক্ত ২০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। এতে ড্রপআউট বাড়ছে, মেয়েদের বিয়ে দিয়ে পরিবারের সদস্য কমাচ্ছেন অভিভাবকরা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বৈষম্য বাড়ছে। ছেলে আর মেয়ের মধ্যেও বৈষম্য বাড়ছে। কেননা, এক পরিবারে একটিমাত্র এন্ড্রয়েড ফোন থাকলে সেটি ছেলেকেই দেওয়া হচ্ছে। মহামারিকালে শিক্ষকরাও কায়িক পরিশ্রম করে জীবনধারণ করছেন।

এ থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে তিনি বলেন, সরকারের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট হওয়া দরকার। স্বাস্থ্য, কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাকেও অগ্রাধিকারে নিতে হবে। শিক্ষা খাতে বাজেটের ২০ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষায় পারিবারিক বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় মহামারিকালে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

টানা ১৮ মাস দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পর থেকেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ক্লাস সংসদ টেলিভিশনে প্রচার শুরু হয়। যদিও সেসব ক্লাস শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে দূরশিক্ষণে (সংসদ টিভি, অনলাইন, রেডিও ও মোবাইল ফোন) ৩১.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছে। অর্থাৎ ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো ধরনের অনলাইন শিক্ষার আওতায় আসেনি। যেসব শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণ প্রক্রিয়ার বাইরে রয়েছে, তাদের মধ্যে ৫৭.৯ শতাংশ ডিভাইসের অভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। আর গ্রামীণ এলাকায় এই হার ৬৮.৯ শতাংশ। তবে রাজধানী ও জেলা সদরের বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো অনলাইনে ক্লাস নিলেও সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখছে তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ৪০ মিনিটের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের যুক্ত হতে হতেই অনেকটা সময় চলে যায়। এরপর রোল নম্বর ডাকা ও পড়া শুরু করতে করতেই সময় শেষ হয়ে যায়।

দেখা গেছে, গত বছর প্রাথমিকে ঝরেপড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ, আর মাধ্যমিকে এই হার ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ। ঝরেপড়ার পেছনে অন্যতম কারণ দরিদ্রতা, বাল্যবিয়ে ও আবাসস্থল ত্যাগ। বিশেষ করে শহরের বস্তিবাসী এবং চর ও হাওর অঞ্চলের শিশুরাই বেশি ঝরে পড়ে। করোনার কারণে এসব পরিবারে দরিদ্রতা আগের চেয়ে বেড়েছে।

দেশের কয়েকটি এলাকার চিত্র: পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ এ সাত্তার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী জিসান জানায়, করোনার প্রথম থেকেই স্কুল বন্ধ রয়েছে। অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে না। তবে, গত বছর করোনাকালে ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড দিত স্যাররা। কিন্তু এ বছর তাও বন্ধ রয়েছে। পড়াশোনায় খুব সমস্যা হচ্ছে।

বান্দরবানের রুমা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল আজিজ বলেন, আমার স্কুলটিতে বর্তমানে প্রধান শিক্ষকসহ মাত্র চারজন শিক্ষক। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী আছে ৩৪০ জন। সিংহভাগ শিক্ষার্থী দুর্গম এলাকার হওয়ায় আমরা সরাসরি অনলাইনে ক্লাস নিতে পারি না। ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার প্রান্তিক একটি বিদ্যালয় হচ্ছে সাখুয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। নানা প্রতিবন্ধকতায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করতে পারছে না অনলাইনে শিক্ষা। গ্রামের শিক্ষার্থীদের সিংহভাগ পরিবারে নেই স্মার্ট ফোন।

পাবনার ঈশ্বরদীতেও প্রায় সব স্কুল-কলেজের অনলাইনে ক্লাস নেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। যাও দু-একটি স্কুলে চালু আছে, তাও নামমাত্র। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও মাদ্রাসাসহ ঈশ্বরদীর প্রায় একশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হাতেগোনা গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সবগুলোর অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম এখন বন্ধ।

বেড়েছে বাল্যবিয়ে: কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পিয়ারপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ে পাঁচ শতাধিক ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে। করোনাকালে ক্লাসরুমে পাঠদান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের জীবনে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর এর প্রভাব বেশি পড়ছে। এক বছরে এ প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে ১০ জনের বেশি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। নবম ও দশম শ্রেণি ছাড়াও ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির মেয়েদেরও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

শিক্ষকরা জানান, পিয়ারপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ষষ্ঠ শ্রেণির তিন শিক্ষার্থী রিথি, রনি ইয়াসমীন ও বৈশাখী খাতুনের চলতি বছর বিয়ে দিয়েছেন অভিভাবকরা। একইভাবে তানিয়া ও সোনালী খাতুন, যাদের এবার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল তাদেরও বিয়ে হয়ে গেছে।

কুষ্টিয়া জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জায়েদুর রহমান বলেন, অনলাইনে ক্লাসের জন্য তারা সচেতন করছেন। তবে সুযোগ-সুবিধা না থাকায় গ্রামের স্কুলগুলোতে সুফল মিলছে না। কারণ অনেকের কাছেই স্মার্ট ফোন ও ডাটা কেনার অর্থ নেই। বাল্যবিয়ের বিষয়টি বাড়ছে বলেও তার কাছে খবর আছে। বিষয়টি নিয়ে তারা শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: