শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১০:১১ অপরাহ্ন

ব্যাংক ব্যবসায় মন্দা পুঁজিবাজারে চাঙ্গা

বেসরকারি খাতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ দিতে পারেনি দেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক। এগুলোর মধ্যে আবার কিছু ব্যাংকের রয়েছে তারল্য সংকট। অধিকাংশ ব্যাংকের নিট সুদ আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি বেড়েছে ব্যবস্থাপনা ব্যয়। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় মুনাফার একটি বড় অংশই সঞ্চিতি হিসেবে সংরক্ষণ করতে হচ্ছে ব্যাংক খাতকে। এমন পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগের নিট মুনাফা কমে গেছে। তবে ব্যাংক ব্যবসায় মুনাফা কমলেও চাঙ্গা রয়েছে তাদের শেয়ারদর। এতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে কিছু ব্যাংকের শেয়ারদর।

সদ্য শেষ হওয়া হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে শেয়ারবাজরে তালিকাভুক্ত ৩০ ব্যাংকের নিট মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ কমেছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৩০ ব্যাংকের মধ্যে ১৭টির নিট মুনাফা আগের বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের তুলনায় কমেছে। নিট মুনাফা কমে যাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এবি, আল আরাফা, এক্সিম, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ওয়ান, রূপালী, আইএফআইসি, সোস্যাল ইসলামি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। এক বছরের ব্যবধানে এসব ব্যাংকের নিট মুনাফা কমেছে ৮৩ শতাংশ পর্যন্ত।

পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে মুনাফা কমে যাওয়া এসব ব্যাংকের শেয়ারে চাঙ্গা ভাব। নতুন বছর শুরুর ১৮ কার্যদিবসেই এসব ব্যাংকের শেয়ারদর বেড়েছে ৪৭ শতাংশ পর্যন্ত। আয়ের তুলনায় শেয়ারদর বেড়ে যাওয়ায় কয়েকটি ব্যাংকের পিই রেশিও (মূল্য আয় অনুপাত) বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এক্সিম, রূপালী ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের পিই রেশিও ৬৮ থেকে ৯৫ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

বর্তমানে ব্যাংক খাতের বার্ষিক সম্ভাব্য গড় পিই রেশিও হচ্ছে ১১ দশমিক ১ পয়েন্ট, যা চলতি বছরের শুরুতে ছিল ৯ দশমিক ৫ পয়েন্ট। আর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ভারিত (ওয়েটেড এভারেজ) পিই রেশিও হচ্ছে ১৬ দশমিক ৫৫ পয়েন্ট। বর্তমানে ১০ ব্যাংকের পিই রেশিও ডিএসইর তুলনায় বেশি রয়েছে।

পুঁজিবাজারে নিরাপদ শেয়ার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় নির্দেশক হচ্ছে পিই রেশিও। শেয়ারের বর্তমান বাজারমূল্যকে আয় দিয়ে ভাগ করলে পিই রেশিও পাওয়া যায়। এটি বেশি হলে বিনিয়োগ ফেরত আসতেও বেশি সময় লাগে। কোনো কোম্পানির পিই রেশিও ৪০-এর বেশি হলে সেই কোম্পানির শেয়ার কিনতে বিনিয়োগকারীরা মার্জিন ঋণ নিতে পারেন না। মূলত ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি কমাতে এমন নিয়ম বেঁধে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

তবে নতুন বছরে ব্যবসায়িক মন্দায় থাকা ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভর করেই বাড়ছে পুঁজিবাজারের সূচক। ব্যাংকের বাজার মূলধন ও লেনদেনযোগ্য শেয়ার বেশি থাকায় সূচকে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে খাতটি। চলতি বছর ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে ৩২ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা, যার মধ্যে শুধু ব্যাংক খাতের বাজার মূলধন বেড়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) ও বিমা খাতের শেয়ারদর বা বাজার মূলধন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এ ছাড়া টেলিযোগাযোগ ও জ¦ালানি খাতের শেয়ারদর বাড়লেও লেনদেনযোগ্য শেয়ার তুলনামূলক কম থাকায় সূচকে ব্যাংকের মতো প্রভাব রাখতে পারে না এ ধরনের খাত। চলতি বছর ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচকটি বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, আর্থিক স্বাস্থ্যে চিড় ধরায় গত বছরের ৩১ অক্টোবর এক্সিম ব্যাংকের শেয়ারদর নেমে আসে অভিহিত মূল্যের নিচে সাড়ে ৯ টাকায়। ব্যাংকটি সদ্য শেষ হওয়া হিসাব বছরের তিন প্রান্তিকের মধ্যে দুই প্রান্তিকেই লোকসানে পড়ে। তৃতীয় প্রান্তিক শেষে এক্সিম ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়ায় মাত্র ১১ পয়সায়, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯১ শতাংশ কম। নিট মুনাফায় বড় ধরনের অধোগতি সত্ত্বেও গত ২৪ জানুয়ারি এক্সিম ব্যাংকের শেয়ারদর বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ টাকা ৯০ পয়সায়। এ হিসাবে নভেম্বরের পর থেকে এ ব্যাংকের শেয়ারদর বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। চলতি মাসেই বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। আর পিই রেশিও দাঁড়িয়েছে ৯৪ দশমিক ৭৭ পয়েন্টে।

এক্সিম ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ২০১৮ সালের নয় মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) ব্যাংকটির পরিচালন আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ৭ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে শেয়ারে বড় অঙ্কের লোকসানের বিপরীতে ১১৫ কোটি টাকা সঞ্চিতি হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়েছে। ফলে তৃতীয় প্রান্তিক শেষে ব্যাংকটির নিট মুনাফা গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে। ২০১৮ সালের শুরুতে এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নিট মুনাফা কমে যাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের অবস্থাও বেশ খারাপ। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির নিট মুনাফা ৮৩ দশমিক ৬ শতাংশ কমে গেছে। সুদ আয় বাড়লেও খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি বেড়ে যাওয়ায় নিট মুনাফায় এই দশা হয়েছে ব্যাংকটির। তবে ব্যবসায়িক মন্দায় থাকলেও ডিসেম্বরের পর স্টান্ডার্ড ব্যাংকের শেয়ারদর বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। এখন ব্যাংকটির পিই রেশিও দাঁড়িয়েছে ৮০ পয়েন্টের ওপরে।

যেসব ব্যাংকের পিই রেশিও ২০-এর বেশি, সেগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেসব ব্যাংকের পিই রেশিও ২০-এর ওপর রয়েছে বিনিয়োগকারীদের উচিত সেসব শেয়ার থেকে বেরিয়ে আসা। সেটা না হলে তাদের বড় ধরনের লোকসানে পড়তে হতে পারে।

রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন হচ্ছে ৬৮ পিই রেশিওতে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে বড় অঙ্কের সঞ্চিতি রাখতে গিয়ে ২০১৬ সালে লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি। পরের বছর নিট মুনাফায় কিছুটা উন্নতি দেখা গেলেও ২০১৮ সালে আবার ভাটা পড়েছে। আগের বছরের তুলনায় ২০১৮ সালের নয় মাসে ৩০ শতাংশের বেশি নিট মুনাফা কমেছে। তব চলতি মাসেই ব্যাংকটির শেয়ারদর বেড়েছে ২৭ শতাংশ।

গ্রাহককে দেওয়া ঋণের পরিমাণ কমে যাওয়ায় আয়ের প্রধান উৎস নড়বড়ে হয়ে পড়েছে বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক এবি ব্যাংকের। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ কমেছে ২১ শতাংশ। এতে ২০১৮ সালের নয় মাসে নিট সুদ আয় কমেছে প্রায় ৩৭ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংকটির নিট মুনাফা কমেছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। বর্তমান শেয়ারদর অনুযায়ী, ব্যাংকটির পিই রেশিও ২৫ পয়েন্ট। তবে জেড ক্যাটাগরিতে থাকা ব্যাংকটির শেয়ারদরে ঝুঁকি অনেকটাই কমে এসেছে।

আমানতের বিপরীতে সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় পরিচালন আয় কমেছে আলোচিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের আইএফআইসি ব্যাংকের। আয়ের প্রধান উৎস কমে যাওয়ায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ব্যাংকটির নিট মুনাফা কমেছে ৪২ শতাংশ। তবে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকেই শেয়ারদরে উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। চলতি মাসেই দর বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ।

সুদ আয়ে উল্লম্ফনের পরও তৃতীয় প্রান্তিকে ওয়ান ব্যাংকের নিট মুনাফা কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। মূলত মন্দ ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি বেড়ে যাওয়ায় নিট মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকেও বড় অঙ্কের লোকসান হয়েছে। সুদ পরিশোধ ও ব্যবস্থাপনাসহ পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধিতে মুনাফা সংকটে পড়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংকও। তৃতীয় প্রান্তিকে ব্যাংকটির নিট মুনাফা আগের বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে। হঠাৎ করেই ব্যবস্থাপনাসহ পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় নিট মুনাফা কিছুটা কমে গেছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের। চলতি মাসে এসব ব্যাংকের শেয়ারদর বেড়েছে ২০ থেকে ২৮ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডিএসইর ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী জানান, লেনদেনযোগ্য (ফ্রি ফ্লোট) শেয়ার কম থাকাসহ অনেক কারণেই শেয়ারদর বাড়তে পারে। বিনিয়োগকারীদের উচিত পিই রেশিও বেশি থাকা শেয়ার নিয়ে সতর্ক থাকা।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: