শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৪৩ অপরাহ্ন

শিরোনাম
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে  প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে- সুবর্ণচর উপজেলা আ.লীগ হাতিয়ার উন্নয়নে সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ কর্মসূচিকে কাজে লাগানো হবে – মোহাম্মদ আলী এমপি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ৩৯ বছর পর জমি ফিরে পেলেন যদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার শিবালয়ে ১৫তম  মাই টিভির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত  ক্রীড়াবিদরা দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনছে- ধর্মমন্ত্রী উজিরপুরে সৎসঙ্গ ফাউন্ডেশনের সেমিনার অনুষ্ঠিত শিবালয়ে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠিবাড়ি খেলা অনুষ্ঠিত লঞ্চের দড়ি ছিঁড়ে ৫ জনের মৃত্যু : আসামিদের তিন দিনের রিমান্ড ঈদের দিনে সদরঘাটে দুর্ঘটনায় ঝরল ৫ প্রাণ সৌদির সাথে মিল রেখে নোয়াখালীর ৪ গ্রামে ঈদ উদযাপন

পুরুষ কেন ধর্ষণ করে?

নিউজ ডেস্ক :: ভারতীয় গবেষক তারা কোওশাল যখন ধর্ষণকারীদের সাক্ষাৎকার নেয়ার কাজটি করছিলেন, তখন এর একটা গভীর প্রভাব পড়েছিল তাঁর শরীর-মনের ওপর। ২০১৭ সালে তিনি যখন তার গবেষণা শুরু করেন, তারপর থেকেই তিনি বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হতে থাকেন। হঠাৎ হঠাৎ মাথা ঘুরে অচেতন হয়ে যান। কোনও কোনওদিন তো অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, দিল্লির উপকণ্ঠে নয়ডার বাসাবাড়িতে একদিন তিনি তাঁর বেডরুমে নিজেকে একা আবিষ্কার করলেন, দরোজায় ভেতর থেকে খিল দেয়া। তিনি বলেন, “আমার পার্টনার সাহিল তখন দরোজায় জোরে জোরে শব্দ করছে, খোলার চেষ্টা করছে। বার বার জানতে চাইছে আমি ঠিক আছি কিনা।”

“আমি তখন ভেতরে জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদছি। আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম আমার আসলে থেরাপি দরকার।”

যৌন সহিংসতার ট্রমা আসলে কী, এই গবেষণায় যুক্ত হওয়ার অনেক আগে তারা সেটা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জেনেছেন। এ নিয়ে তিনি যখন কথা বলতে শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স সবে ১৬। নিজের বাবা-মাকে জানিয়েছিলেন, “আমি মাত্র ৪ বছর বয়সে ধর্ষণের শিকার হই, আমাদের বাগানের মালীর হাতে!”

ঘটনা শুনে তাঁর বাবা-মা একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কিন্তু তারার জন্য এটা যেন একটা বাঁধ ভেঙ্গে সব অর্গল খুলে যাওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন তারা। এ নিয়ে তিনি প্রকাশ্য বিতর্কে অংশ নেয়া শুরু করলেন, বন্ধুদের জানালেন- এমনকি একটা বইও লিখে ফেললেন।

তারার কথায়, “সেই ঘটনার কিছু স্মৃতি আমার মনে আছে, আমি লোকটার নাম জানতাম। লোকটা দেখতে কেমন ছিল আমার মনে আছে। লোকটার কোঁকড়া চুল এবং আমার নীল রঙের পোশাকে রক্তের দাগ, সবকিছু আমার মনে আছে।”

তারা যখন বেড়ে উঠছিলেন, তখন ভারতে প্রতিদিন যেসব যৌন হামলার ঘটনা ঘটে সেগুলো নিয়ে তিনি ভাবতেন। কেন এই ধরনের যৌন সহিংসতা ঘটে সেটা জানার আগ্রহ তৈরি হলো তার মধ্যে। তিনি বলেন, “আমার ‘পুরুষ কেন ধর্ষণ করে’ বইটি আসলে নিজের দীর্ঘ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং আমার পেশাগত অভিজ্ঞতার একটা চূড়ান্ত সম্মিলন বলতে পারেন। কিন্তু এই কাজটা করতে গিয়েও আমি অনেক ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছি।”

চোরা ধর্ষণকারীদের খোঁজে
ভারতে ধর্ষণ এবং যৌন সহিংসতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে সবার মনোযোগের কেন্দ্রে আসে ২০১২ সালে। ওই বছর দিল্লিতে একটি চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ২৩ বছর বয়সী এক তরুণী, ফিজিওথেরাপির এক ছাত্রী। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার সময় এই তরুণী যেভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলেন, তার ফলে কয়েক দিন পরে তিনি মারা যান। ২০২০ সালের মার্চ মাসে এই ঘটনার জন্য অভিযুক্ত চারজনকে ফাঁসিও দেওয়া হয়।

এ ঘটনার পর ভারতে যৌন সহিংসতার বিষয়টি ক্রমবর্ধমানভাবে আরও বেশি আলোচনায় আসলেও, পরিস্থিতি পাল্টায়নি। হামলার ঘটনা দিনে দিনে আরও বাড়ছে। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইমস রেকর্ডস ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী- ২০১৮ সালে পুলিশ ভারতে ৩৩ হাজার ৯৭৭টি ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করেছে। এর অর্থ হচ্ছে- ভারতে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু যারা এ নিয়ে আন্দোলন করছেন, তাদের মতে প্রকৃত ধর্ষণের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। কারণ অনেক ঘটনার ব্যাপারেই কোনও অভিযোগ আসে না।

যেসব ধর্ষকের ব্যাপারে কখনোই মামলা করা হয় না বা যাদের কোনও সাজা হয় না, তাদের খুঁজে বের করতে চেয়েছিলেন তারা কোওশেল। তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মোট ৯ জন লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন যাদের সবার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আছে। কিন্তু এসব অভিযোগ সরকারিভাবে কর্তৃপক্ষ কখনও তদন্ত করে দেখেনি।

নিজের বইতে তারা লিখেছেন, “আমি এদের সঙ্গে তাদের বাড়ির নিজস্ব পরিবেশের মধ্যে সময় কাটিয়েছি; আমি তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তাদের পর্যবেক্ষণ করেছি। আমি ছদ্মবেশে তাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম- ছদ্মনামে আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এই নামে আমার ই-মেইল এবং ফেসবুক আইডিও ছিল।”

তারা তার গায়ে আঁকা উল্কি যেন কারও নজরে না পড়ে সেজন্য বেশ সতর্ক ছিলেন। তিনি ভারতীয় স্টাইলের কুর্তা পরেন, সঙ্গে জিন্সও। যখন তিনি এই লোকগুলোর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন, তখন সবসময় সাথে একজন ট্রান্সলেটর বা দোভাষী রেখেছিলেন। তবে আসলে এই দোভাষী একইসঙ্গে তারার একজন ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর কাজই করতেন। তিনি এমন একটা ভান করছিলেন, যেন তিনি আসলে অস্ট্রেলিয়ায় থাকা একজন অনাবাসী ভারতীয়। ভারতের সাধারণ পুরুষ মানুষের জীবন সম্পর্কে একটি চলচ্চিত্র তৈরির কাজ নিয়ে তিনি গবেষণা করছেন।

তার তার বইতে লিখেছেন, “এই গবেষণার সময় আমি যে ২৫০টি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি এবং যেসব বিষয়ে আমি পর্যবেক্ষণ করেছি, সব পুরুষের বেলাতেই তা ছিল একই। কিন্তু আমি তাদেরকে কখনোই বলিনি যে, তাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আছে বলেই আমি তাদের নিয়ে গবেষণা করছি।”

‘সম্মতি’ কাকে বলে তা বোঝার অভাব
তারা কোওশাল সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি রেখেছিলেন। তাঁর পকেটে সবসময় থাকত একটি পেপার স্প্রে। যে কোনও সময় পালানোর দরকার পড়লে সেজন্য থাকতো জরুরী কিছু স্থানীয় যোগাযোগের নম্বর। একটি হোয়াটসঅ্যাপ সাপোর্ট গ্রুপে তিনি তার প্রতি মুহূর্তের অবস্থান লাইভ শেয়ার করতেন।

কিন্তু এত কিছুর পরও এসব পুরুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল, যা তিনি কখনোই আগে ধারণা করতে পারেননি। সাক্ষাৎকারে তিনি খুবই অন্তরঙ্গ ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি। এদের মধ্যে তিনজন পুরুষ এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় যৌনতৃপ্তির জন্য নিজেদের শরীর স্পর্শ করছিল।

একজনের কথা তার মনে আছে। উত্তর ভারতে নিজের বাড়ির বারান্দায় শীতের রোদে লোকটি তার উল্টোদিকে মুখোমুখি বসে ছিল। তারা লেখেন, “আমার সামনে বসে থাকা ছোটখাটো লোকটি আসলে আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ভয়ংকর যৌন অপরাধীদের একজন (লোকটির নিজের স্বীকারোক্তি অনুসারেই)। তার ছোট্ট গ্রামের বহু নারী এই লোকটির যৌন হামলার শিকার হয়েছে। কিন্তু এজন্যে লোকটিকে জেলেও যেতে হয়নি, সমাজে তাকে একঘরেও করা হয়নি। বরং সে এখনও সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ গণ্যমান্য ব্যক্তি। শুধু তাই নয়, আমাকে দেখে লোকটি যৌন উত্তেজিত হয়ে পড়লো এবং আমার শরীর স্পর্শ করতে কোনও সংকোচ পর্যন্ত করছিল না।”

সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় এসব অভিজ্ঞতা তারার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলেছিল। তারা বলেন, “যখন আমার এসব সাক্ষাৎকার নেয়া হয়ে গেলো, আমি বুঝতে পারলাম এগুলোর একটা সম্মিলিত ট্রমায় আক্রান্ত হয়েছি আমি। আমি বুঝতে পারলাম, এই ট্রমা মোকাবেলা করার জন্য আমাকে থেরাপি নিতে হবে।”

“আমি অনেক ধরনের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হই। এমন অনেক রাত গেছে, যখন ঘুমের মধ্যে আমি আমার সঙ্গীকে কামড়ে দিয়েছি- ঘুমের মধ্যে আমি তাকে বলেছি আমাকে উৎপীড়ন করা বন্ধ করতে।”

তবে শেষ পর্যন্ত তারা এখান থেকে একটা স্পষ্ট উপলব্ধি নিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলেন। তিনি বলেন,
“ধর্ষণ বলতে আসলে কি বোঝায়, তা নিয়ে এই লোকগুলোর আসলে কোনও অভিন্ন ধারণা নেই। যৌন সম্পর্কের জন্য সম্মতি বলতে কী বোঝায় সেটা তারা মোটেই জানে না।”

ধর্ষকদের ‘আলাদা মানুষ’ হিসেবে দেখা
তারা যখন তাঁর গবেষণা শুরু করেছিলেন, তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় যৌন সহিংসতার বিষয়টি নিয়ে নারীদের সঙ্গে অনেক আলোচনা করেছেন। তারা বলেন, “আমি যেসব পুরুষের ওপর গবেষণা চালিয়েছিলাম, তাদের দুজনের সন্ধান আমি পাই সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ধরনের আলোচনায় অংশগ্রহণকারী কয়েকজন নারীর কাছ থেকে। অন্য সাতজনকে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন ছিল। কাজেই তখন আমি স্থানীয় পুলিশের শরণাপন্ন হলাম। স্থানীয় গণমাধ্যম, এনজিও, এমনকি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও সাহায্য নিলাম।”

তারা যে পুরুষদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, তাদের বেশিরভাগ পুরুষই স্বীকার করেছে যে, তারা ধর্ষণ করেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে একাধিক ধর্ষণের কথাও স্বীকার করেছে। তবে এই গবেষণার সময় তারা কোওশেল সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তিনি ধর্ষণের অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত কারো সঙ্গে কথা বলবেন না।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “যারা ধর্ষণ করে, আসলে জেলখানা তাদের প্রতিনিধিত্বশীল কোনও জায়গা নয়। মানুষ তো আর কোনও দ্বীপে বসবাস করে না। কোনও মানুষকে তার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ছাড়া পর্যবেক্ষণ করলে সেখান থেকে কিন্তু পুরো ছবিটা পাওয়া যাবে না।”

তবে তারা কোওশেলের সঙ্গে তুলনা করলে ডক্টর মধুমিতা পান্ডের গবেষণা একেবারেই ভিন্ন। তিনি যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড হালাম ইউনিভার্সিটির ক্রিমিনোলজির লেকচারার। তিনি তার গবেষণাটি চালিয়েছেন যৌন অপরাধের দায়ে সাজা পেয়েছে এমন লোকজনের ওপর। ২০১২ সালে দিল্লিতে চলন্ত বাসে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার পর তিনি তাঁর গবেষণা শুরু করেন।

মধুমিতা পান্ডে বলেন, “ওই ঘটনার পর ধর্ষকদেরকে দানব হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে একটা সম্মিলিত ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছিল। ওদের কাজে আমরা এতটাই ক্ষিপ্ত হয়েছিলাম যে, আমরা তাদেরকে একেবারে ‘আলাদা ধরণের’ মানুষ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম, যারা আমাদের এবং আমাদের সংস্কৃতির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা কিছু।”

ধর্ষকদের ব্যাপারে একটা ব্যাপক প্রচলিত ধারণা হচ্ছে যে, এরা নারীদের ব্যাপারে অনেক বেশি সনাতনী চিন্তা এবং নিপীড়নমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। গবেষক হিসেবে তিনি এই বিষয়ের দিকে নজর দিতে চাইলেন।

মধুমিতা বলেন, “কিন্তু আমাদের যা ধারণা, নারীদের ব্যাপারে এই লোকগুলোর চিন্তাভাবনা কি আসলেই সেরকম আলাদা কিছু?”

যে কেউ ধর্ষক হতে পারে
ডক্টর মধুমিতা পান্ডে দিল্লির তিহার জেলে ধর্ষণের অভিযোগে সাজা খাটা একশোর বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নেন। তিহার জেলখানাকে বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ার সবচাইতে বড় কারাগার। এই ধর্ষণকারীদের প্রত্যেকের কাহিনী আলাদা। একজন গ্যাং রেপিস্ট বলছিল, ঘটনার পরপরই সে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। একটি মন্দিরের একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী বলছিল, পাঁচ বছরের এক মেয়েকে সে ধর্ষণ করেছিল, কারণ তাকে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল। এক যুবক দাবি করেছিল, সে আসলে ধর্ষণ করেনি, পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই তাদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক হয়েছিল। কিন্তু মেয়েটির পরিবার যখন তাদেরকে একসঙ্গে দেখতে পায়, তখন তারা ধর্ষণের মিথ্যে অভিযোগ এনেছিল।

ডঃ মধুমিতা পান্ডে ৫ বছরের একটি মেয়ের ধর্ষণের কাহিনী শুনে ভীষণভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন। তিনি মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জানান, মেয়েটির বাবা যখন জানলো যে, তার মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তখন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল এবং তার পরিবারকে পরিত্যাগ করেছিল। তখন পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ করা, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেয়া- এই সমস্ত কাজ করেছে ধর্ষণের শিকার শিশুটির মা-ই। যদিও এর যে বিচার হবে সেটার কোনও আশা তারা করছিল না।

ডঃ মধুমিতা পান্ডে এই লোকগুলো নারীর ব্যাপারে কি ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে এবং তাদের এই চিন্তাভাবনা যৌন সহিংসতায় কি ভূমিকা রাখে সেটা অনুধাবন করার চেষ্টা করছিলেন তাঁর গবেষণায়। তিনি বলেন, “এই প্রত্যেকটি ঘটনার ধরণ হয়তো আলাদা। কিন্তু একটা অভিন্ন বিষয় প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই আছে, সেটা হচ্ছে এরা সবাই মনে করে, এটা যেন তাদের একটা অধিকার। এ থেকে যেটা বোঝা যায়, সেটা হলো, আমাদের সমাজে পুরুষরা আসলে কতটা সুবিধাভোগী।”

গবেষণায় তিনি দেখতে পেলেন, এই ধর্ষকরা তাদের কৃত অপরাধের জন্য অপরাধের শিকার নারীকেই দোষারোপ করছে। আর এই ধরনের যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে যে সম্মতির একটা ব্যাপার আছে, সেটা তারা একেবারেই বোঝে না।

তারা কোওশেলের গবেষণার মতো ডঃ মধুমিতা পান্ডের গবেষণাতেও একটা ‘মিথ’ অসার বলে প্রমাণিত হলো। মধুমিতা পাণ্ডে বলছেন, “ধর্ষক মানেই যেন অন্ধকার ছায়ায় ওঁত পেতে থাকা অপরিচিত কোনও আগন্তুক, কিন্তু আসলে মোটেই তা নয়।”

এসব ঘটনায় যেটা দেখা গেল, বেশিরভাগ ধর্ষক আসলে আগে থেকেই ধর্ষিতাকে চিনতো। কাজেই এটা সহজেই বোঝা যায়, যে কেউ আসলে ধর্ষণকারী হতে পারে এবং এরা অসাধারণ কোনও লোক নয়, এরা আমাদের চারপাশেই আছে।

এর আগের অনেক পরিসংখ্যান থেকেও দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনাতেই ধর্ষণের শিকার মেয়েরা ধর্ষকদের আগে থেকেই চিনতো। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর হিসেব মতে, ২০১৫ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৯৫ শতাংশ। যারা ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, তাদের বিশ্বাস, অনেক ধর্ষণের ঘটনাতেই যে কোনও অভিযোগ হয় না, তার একটা কারণ এটা।

ডঃ অনুপ সুরেন্দ্রনাথ হচ্ছেন ‘প্রজেক্ট থার্টি নাইন-এ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক। এটি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। তিনি বলছেন, “ধর্ষণের ঘটনার অভিযোগ যে কম আসে এটা একটা সমস্যা, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধী ধর্ষিতার পরিচিত এবং সমাজে এমন অনেক ধরনের বিষয় আছে, যেগুলোর কারণে ধর্ষিতা এবং তার অভিভাবকরা এটি নিয়ে অভিযোগ করে না।”

আর শেষ পর্যন্ত যেসব ধর্ষণের ঘটনায় অভিযোগ হয়, তার মধ্যে কেবল সবচাইতে ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলোই হয়তো সংবাদ শিরোনাম হয়।

মৃত্যুদণ্ড কি কোনও সমাধান!
ধর্ষণের এরকম উচ্চহার যে কেবলমাত্র ভারতে, ব্যাপারটা তা নয়। তবে অনেকের বিশ্বাস, ভারতের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং জনসংখ্যায় নারী-পুরুষের অনুপাতে ভারসাম্যহীনতা হয়তো পরিস্থিতিকে আরো খারাপ দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

সাংবাদিক সৌতিক বিশ্বাস যেমন বলেছেন, “ভারতে ধর্ষণকে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষমতা প্রদর্শনের এবং একই সঙ্গে ক্ষমতাহীনদের ভয়ভীতি দেখানোর একটা হাতিয়ার হিসেবে। তবে ভারতে ধর্ষণের ঘটনার অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু দেশটির বিশৃঙ্খল ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার রাজনৈতিক চাপের কাছে অসহায় এবং এর ফলে অনেক অভিযুক্তই আসলে ছাড়া পেয়ে যায়। সার্বিকভাবে ধর্ষণের কারণে সাজার ঘটনা খুবই কম।”

২০১২ সালে দিল্লিতে চলন্ত বাসে দল বেঁধে সেই ধর্ষণের ঘটনা এবং খুনের পর কর্তৃপক্ষ আইন আরও অনেক বেশি কঠোর করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করা। কিন্তু তারা কোওশেল এবং ডঃ মধুমিতা পান্ডে, দুজনেই একমত যে- ফাঁসির সাজা দীর্ঘমেয়াদে কোনও সমাধান নয়।

ডঃ মধুমিতা পান্ডে বলছেন, তিনি সংস্কার এবং পুনর্বাসনের মতো বিষয়েই বেশি বিশ্বাস করেন। “আমাদের আরো বেশি করে মনোযোগ দেয়া উচিত সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে, যাতে করে নারী এবং পুরুষের মধ্যে যে অসম ক্ষমতার সম্পর্ক সেটি বদলে দেয়া যায়।”

এ বিষয়ে তারা কোওশেলও একমত। তিনি বলেন, “আমাদেরকে এখানে মনোযোগ দিতে হবে এই অপরাধের সবচাইতে সক্রিয় উপাদানটির দিকে এবং এখানে সবচেয়ে সক্রিয় উপাদানটি হচ্ছে পুরুষ। কিভাবে আমরা এদের থামাবো? এদের থামানোর উপায় হচ্ছে একেবারে শৈশব থেকেই তাদেরকে আরো ভালো হতে শিক্ষা দেয়া।”

তারা কোওশেল যেসব পুরুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তারা সমাজের যে শ্রেণী থেকেই আসুক, তাদের কাউকেই স্কুলে সেক্স এডুকেশন বা যৌন শিক্ষা দেয়া হয়নি। এরা তাদের যৌন জ্ঞান অর্জন করেছে বন্ধুদের আড্ডায়, যারা নিজেরাও তাদের মতো অজ্ঞ, অথবা পর্নগ্রাফি দেখে বা যৌনকর্মীর কাছ থেকে। এদের অনেকে শৈশবে সহিংসতাও দেখেছে।

তারা বলেন, “এরা হয়তো দেখেছে তাদের বাবা তাদের মাকে মারধর করছে অথবা তাদের মধ্যে কোনও ভালোবাসা নেই। এরা হয়তো ক্রমাগত পিতার হাতে বা পরিবারের অন্য কোনও পুরুষ সদস্যরে হাতে বার বার সহিংসতার শিকার হয়েছে।”

তাহলে পুরুষ কেন ধর্ষণ করে?
ডক্টর মধুমিতা বলেন, “এর কোনও একক উত্তর নেই। কারণ ধর্ষণ হচ্ছে- একটি খুবই জটিল অপরাধ। প্রত্যেকটি ঘটনার বয়ান আসলে আলাদা- কেউ হয়তো লিপ্ত ছিল দলবদ্ধ ধর্ষণে, কেউ হয়তো তাদের ভিকটিমকে আগে থেকেই জানতো, আবার কেউ হয়তো একদম অপরিচিত কাউকে ধর্ষণ করেছে। আর নানা ধরনের ধর্ষক আছে, কেউ খুব রাগী, কেউ মর্ষকামী ধর্ষক, কেউ সিরিয়াল ধর্ষক।”

তবে ডঃ মধুমিতা পান্ডে একটা বিষয়ের উপর জোর দিচ্ছেন। সেটা হচ্ছে, এই ধর্ষক যে কেউ হতে পারে: স্বামী, সহকর্মী, ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রেমিক, সহপাঠী অথবা শিক্ষক। “জেলখানার ভিতরে আমি যে ধর্ষকদের দেখতে যাবো, তাদের ব্যাপারে আমার আগে থেকে একটা কাল্পনিক ধারণা ছিল, যেমনটা এদেশের বেশিরভাগ মানুষেরই হয়তো আছে। এই ধারণাটা আমার গড়ে উঠেছে বলিউডের ছবি দেখে।”

“এরা হয়তো খুব ভয়ঙ্কর দর্শন কিছু পুরুষ, তাদের মুখে বা গায়ে হয়তো কাটা দাগ থাকবে এবং তাদের পরনে থাকবে জেলখানার ডোরাকাটা পোশাক। আমি এমন ভয়ও পাচ্ছিলাম যে হয়তো এই লোকগুলো আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে, অথবা আমার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করবে এবং এই পুরো অভিজ্ঞতাটা আমার জন্য হবে খুবই অস্বস্তিকর।”

কিন্তু ডঃ মধুমিতা পান্ডে শীঘ্রই উপলব্ধি করলেন যে, এরা সবাই এক ধরনের মানুষ নয়। “আমি তাদের সঙ্গে কথা বলে যত সময় কাটাচ্ছিলাম, তাদের জীবনের কাহিনী শুনছিলাম, ততই আমি বুঝতে পারছিলাম, এরা আসলে অতটা অদ্ভুত নয়, অতটা অসাধারণ কেউ নয় এবং এই বিষয়টাই আমাদের আসলে বেশি করে বোঝা দরকার।”

তিনি বলেন, “আমরা একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বাস করি। এখানে একজন হয়তো আপনাকে ধর্ষণ করছে না, কিন্তু আপনার উপর তার কর্তৃত্ব এবং দাপটের প্রকাশ নানাভাবে ঘটাতে পারে। আর সমাজে যেন এগুলোকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া হয়েছে।”

এক্ষেত্রে তিনি কর্মক্ষেত্রের সেক্সিজম অথবা রাস্তায় যৌন হয়রানির মতো নিত্যদিনের নারী বিদ্বেষী আচরণের কথা উল্লেখ করছেন। তিনি বলেন, “একজন ধর্ষক কোন মেয়ে কী ধরণের পোশাক পরেছিল সেটাকে যখন ধর্ষণের অজুহাত হিসেবে উল্লেখ করে, সেটা শুনে আমরা খুবই ক্ষিপ্ত হই। কিন্তু কেন আসলে আমরা এতটা হতবাক হই এটা দেখে?”

“নিত্যদিনের নারীবিদ্বেষী সব ঘটনা যখন স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়া হয় এবং এর থেকে আরও মারাত্মক কিছু যখন ঘটে, তখন এত অবাক হওয়ার কি আছে? এই ধর্ষকদের সঙ্গে কথা বলা শেষ করার পর আমি দেখতে পাই, এরা যেসব শব্দ ব্যবহার করে, তাদের কৃতকাজের জন্য যে ধরনের অজুহাত দেয়, সেটা আসলে তারা যে ধরনের সামাজিক কথাবার্তার মধ্যে বেড়ে উঠেছে সেখান থেকেই এসেছে।”

ডঃ মধুমিতা পান্ডে এখন ভারতে একটি পুনর্বাসন কর্মসূচিতে কাজ করছেন যার লক্ষ্য যৌন অপরাধীদের ব্যাপারে যে বিকৃত চিন্তা চালু আছে, সেটাতে পরিবর্তন আনা। “আমি চাই ভারতে একটি সেক্স অফেন্ডার্স রিহ্যাবিলিটেশন ট্রেনিং (এসওআরটি) চালু হোক, যেখানে গ্রুপে বা এককভাবে অংশ নেয়া যাবে। সেখানে অন্যান্য কার্যক্রমও চলবে যাতে করে ধর্ষণের ব্যাপারে প্রচলিত মিথগুলো ভেঙ্গে ফেলা যায় এবং ভারতে নারীর ব্যাপারে যে সেকেলে দৃষ্টিভঙ্গি, সেটা পাল্টে দেয়া যায়।”

“প্রতিদিন আমি এই ভাবনা নিয়েই জেগে উঠি এবং সারাক্ষণ এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই ঘুমাতে যাই। এবং এটা আমার মধ্যে বিরাট আশা জাগিয়ে রাখে।” সূত্র- বিবিসি।

এনএস/


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: