শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০২:০৭ পূর্বাহ্ন

করোনা নিয়েই কালকের রোজনামচা : হাসান মাহমুদ গুরু

হাসপাতালের বিছানা থেকে ২৮ বছরের এক উদ্দীপ্ত যুবক অনন্ত যাত্রার আগে, তাঁর বেদনার রোজনামচায় লিখে গেছে কিছু কথা। বিশ্বকে টালমাটাল করে তোলা করোনার নীল বিষ তার দৃপ্ত যৌবনের জওয়ানি থেতলে দিচ্ছিল প্রতি মুহূর্তে। অজস্র জীবন বাজি রাখা যে যৌবন পাল্টে দিতে পারে গোটা পৃথিবী। সে তাগড়া কন্ঠের করুণ কাতরতা অজান্তেই চোখের কোনে নোনা জলের রেখা দীর্ঘ করে তোলে।

যৌবনের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ভেঙে করোনা সুবিধা পাবে না বলেই ধারণা ছিল যুবকের। তার সে বিশ্বাসকে চিড়ে দিয়ে পরিচিত জ্বর, কাশি, গলাব্যাথার চোহদ্দি পেরিয়ে অসুখ গিয়ে ঠেকে শ্বাসকষ্টে। দমবন্ধ হয়ে আসা ফুসফুস সচল করতে তাকে হাসপাতালে নিতে, পরিচিত সাইরেন বাজিয়ে ছুটে আসে এম্বুল্যান্স। মমতায়ী মা আর প্রিয় পিতার চোখে তখন এক অজানা বিদায়ের ডংকাধ্বনি।

একটু নিঃশ্বাসের খোঁজে আথালি পাথালি মানুষটা অ্যাম্বুলেন্সের ছোট্ট জানলা দিয়ে দেখেছিল তাঁর বিদায়পথ। দেখছিল, চোখচেড়া জল নিয়ে অপলক তাকিয়ে মা’। দুহাঁটু ধুলায় গেঁথে চোখভর্তি অবিশ্বাস নিয়ে বাবার আক্ষেপ। বড় দরদ নিয়ে কাতর যৌবন দেখেছিল তার আজন্ম প্রিয়তম মানুষগুলোকে।

হাসপাতালের আইসিইউ-কক্ষের শুভ্র বিছানায়, জীবন ও মৃত্যু সুতোয় দাঁড়িয়ে যুবক পড়তে পেরেছিল তার চিকিৎসক ও সেবিকাদের চোখের ভাষা। সে ভাষা বলে দেয় তাঁর গন্তব্য ‘না ফেরার দেশ’। মৃত্যুর পর তার লাশ কি দেখতে দেয়া হবে প্রিয়জনদের? তার শেষ বিদায়ের কাফেলায় যুক্ত হবে কি কেউ? এমন কতো কি প্রশ্ন নিয়ে চির আঁধারের দেশে পাড়ি জমে এক যৌবনের।

তবে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর উল্টোপিঠেই লেগে আছে অনেক অনেক সাহস আর বেঁচে উঠার গল্পও। করোনা মোকাবেলা করে প্রিয় পৃথীবিতে সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসার অপার আনন্দ আর সাহসিকতার নজিরও প্রচুর। কোভিড-১৯ এর করাল থাবায় তছনছ গোটা পৃথিবী আর এই অনুজীব দেশ ভেদে প্রতিনিয়ত নিচ্ছে নানান রূপ। ফলে করোনা আক্রান্ত একেক জন মানুষের ক্ষেত্রে ঘটছে একেক রকমের ঘটনা। একজনের আক্রমণের মাত্রা ও তীব্রতা অন্য জনেরটার সাথে মেলানো দায় হয়ে পড়ছে। কেউ শুধু মাথাব্যাথা আর জ্বরে ভুগছে। কারো বা ডাইরিয়া। কারো জ্বর-ব্যাথা কিছুই নেই, শুরুটাই হয়েছে সরাসরি শ্বাসকষ্ট দিয়ে। এমন বহুরূপী ভাইরাসের গতি প্রকৃতি নিরুপন করাও তাই দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে বিশ্বের তাবৎ চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের।

এই যেমন অন্য আরেক যুবকের কথা বলা যেতে পারে। সহকর্মীদের করোনা ‘পজেটিভ’ জেনে নিজেও পরীক্ষা করে রিপোর্ট পেলেন পজেটিভ। তারপর বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরবন্দি হলেন। কিন্তু জ্বর, কাশি, ব্যাথা, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট কোনো উপসর্গই নেই তার শরীরে। কোন উপসর্গ ছাড়াই এভাবে ১৮ দিন কাটিয়ে আবারো টেস্ট করিয়ে এলো করোনা নেগেটিভ। এই যুবক টেরই পেলেন না করোনার ভয়াল দুর্ভোগ কাকে বলে? তাই বিভিন্ন দেশে, নানান মানুষের শরীরে বহুরূপে ধরা দেয় এই ভাইরাস। তাই এর আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকটাই যেন এখন সবার একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার চাইলেই এক মুহূর্তে ধ্বংস করা সম্ভব নয় এই অদৃশ্য দানবকে।

মাসের পর মাস লকডাউনও কোন দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের পথ নয়। ধ্বসে পড়ছে অর্থনীতি; বাড়ছে কাজহীন মানুষের সংখ্যা। দিনমজুরের ভাতের হাড়িতে কষ্টের কোরাস জমছে প্রতিদিন। বস্তিতে বস্তিতে দুমুঠো অন্নের যুদ্ধে মানুষের বন্য হয়ে উঠার শংকা হাতছানি দিচ্ছে। করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই হয়তো অনাগত বিশ্ব তার গতিরোধ করতে পারবে। কিন্তু সে আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত করোনাকে নিয়েই চলতে হবে। তাকে মাথায় রেখেই আঁকতে হবে আগামীর পথনকশা। দিন যতই এগুচ্ছে বাড়ছে আক্রান্তের হার।

একটা মন্দেরভালো দিকও আছে। করোনা আক্রান্তদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা হলেও বদলেছে। করোনা রোগীকে রেখে স্বজনদের পালিয়ে যাবার হার হ্রাস পাচ্ছে। জানাজা বা মৃতদেহ সৎকারে ভীতি কাটছে। দূরত্ব বজায় রেখে এবং নিজের সুরক্ষা নিয়ে হলেও করোনাক্রান্ত প্রিয় স্বজনের পাশে থাকছে সন্তান কিংবা পিতামাতা। অজো পাড়াগাঁয়ে এখনো তেমনটা না হলেও রাজধানীসহ শহরগুলোতে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে বেশ। করোনা আক্রান্ত হলেই সবাই মারা যায় না; মানুষের মাঝে এমন আত্মবিশ্বাসও আসছে, যা খুবই আশাব্যঞ্জক। করোনা যে সহসাই নির্মূল হচ্ছে না সে ধারণাও মানুষের বিশ্বাসের বাতায়নে ধরা দিচ্ছে।

আচরণে, নিয়মে আর সামজিকতায় পরিবর্তন এনে এই মানুষই করোনা সাথে নিয়ে চলবে সামনের দিনগুলোতে। দৈনন্দিন অফিস বা সন্তানের স্কুল, কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য সবকিছুই চলবে পরিবর্তিত সে নিয়মে। মুখে মাস্ক পরা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, সময় বের করে রোজ ৪০ মিনিট ব্যায়াম করা, রাতজাগাকে বিদায় জানিয়ে ভোরের আলোয় পৃথিবী দেখা, মদ ও ধূমপানকে গুডবাই জানানো, ফাস্টফুড পরিহার করে সবজি, মাছ, ফল আর পুষ্টিকর খাবারে ফিরে আসাসহ রোজনামচায় আনতে হবে নানান পরিবর্তন। হলুদ, মধু, কালোজিরা, রসুনের মতো ভেষজ ব্যবহারে বাড়বে মনোযোগ। এমন অনুজীবের কবল থেকে বাঁচতে হলে ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত আর ধূলার দূষণময় পরিবেশের পরিবর্তনও ঘটাতে হবে ব্যক্তিপর্যায় থেকে।

মানিয়ে নিয়েই পা ফেলতে হবে আগামীর পথে। গতিময় মানব সভ্যতাকে স্থবির ভাবা যায় না কখনো। তবে বল্গা হরিণের মতো চলা যারা সচেতনতাকে পাত্তা দেন না; তারাই বরং বিপদের ভেলায় চড়ে ডেকে আনতে পারেন মৃত্যুর অজানা সমুদ্রের কৃষ্ণ তরঙ্গ। কিন্তু বিশাল জনগোষ্ঠীর করোনা আক্রান্ত হওয়া এবং সুস্থ্য হওয়ার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে মানুষ যে তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে তা মোটামুটি ধারণা করা যায়। ইতোপূর্বে যেসব মহামারীর আক্রমণ পৃথিবীর ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিল সেসব রোগও একবারে বিদায় হয়নি পৃথিবী থেকে। ওষুধ আবিষ্কারে তা এসেছে মানুষের নিয়ন্ত্রণে। বিশ্বব্যাপী গবেষক আর বিজ্ঞানীদের নিরসল চেষ্টায় হয়তো করোনাও পরাভূত হবে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত এই মৃত্যু মৃত্যু খেলার মাঝেই নিজেদের মানিয়ে নিয়ে সচেতনতার সর্বোচ্চটা দিয়ে চলতে হবে বন্ধুর পথ।

রাস্তায় বের হলেই যে, করোনা আক্রান্তের শংকা প্রতিনিয়ত মস্তিকের দেয়াল কুঁড়ে খাচ্ছে তা থেকে নিস্তারের আপাত উপায়ের নামই হচ্ছে ‘সচেতনতা’। তবে বিজ্ঞান বলে, একটি রোগের বিপরীতে বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতোরোধ ক্ষমতা যখন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে সেই সমাজে ঐ জীবানুর কার্যকারিতা ধীরে ধীরে তীব্রতা হারাতে থাকে, তৈরি হয় প্রতিরোধ ক্ষমতা। কিন্তু সব বন্ধ করে হাতপা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকলে যেমন একদিকে অনটনের নির্মমতায় অজানার ডামাডোল বাজবে, তেমনি সচেতনতার সব নিয়মের গালে চুনকালি মেখে উদোম চলাফেরাও ডেকে আনতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। তাই নিজের মূল সুরক্ষাটা নিজেকে করার ওপরই সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে।

পাশের বাড়ির কেউ করোনা আক্রান্ত হয়েছে তাই তাকে ঘৃণা, নিন্দা আর বিদ্বেষের চোখে একঘরে করে সামাজিক বৈকল্য সৃষ্টি করা কখনোই মানবিকতা নয়। বরং সামাজিক দূরত্ব মেনে মানবিক সহয়তা নিয়ে পাশে দাঁড়ানোই মহানুভবতা । কারণ তিনি সুস্থ হয়ে উঠলে তার প্লাজমাই হয়তো আমার সাধের জীবনটা বাঁচিয়ে দিতে পারে দুমাস পর। তাই ভয়ে সিঁধিয়ে গিয়ে দৈনিক কেবল মৃত্যুর মন্ত্রজঁপ করলেই কিন্তু মুক্তি মিলবে না। ভাবতে হবে কি করে করোনা আক্রান্তের পরও নিয়ম আর কঠোরভাবে কিছু দিক নির্দেশনা মেনে সুস্থ হয়ে ওঠা যায়? পৃথিবীময় মৃত্যু ভয়ের এই কাফন মোড়ানো সময়কে ভাবতে হবে আশার প্রদীপ্ত আলো জ্বালিয়ে। কারণ মানুষতো আশায়ই বেঁচে থাকে।

লেখক : সিরিয়র করেসপন্ডেন্ট, এনটিভি


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: