রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:০১ পূর্বাহ্ন
নিউজ ডেস্ক :: দেশে রপ্তানির বিপরীতে যে পরিমাণ অর্থ আসার কথা, সেটা আসছে না। গত জুন পর্যন্ত দেশে আসেনি প্রায় ১২৮ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি প্রায় ১২ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সন্দেহ, এ অর্থের প্রায় অর্ধেকটা পাচার হয়ে গেছে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে প্রকাশ করে। সেখানে এ সন্দেহ তুলে ধরা হয়। সন্দেহের কারণ হিসেবে বলা হয়, একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রপ্তানির অর্থ দেশে আসে। কিন্তু সেই সময় পার হওয়ার পরও বিপুল অঙ্কের রপ্তানি আয় দেশে আসেনি। যদিও ‘শর্ট শিপমেন্ট’, রপ্তানিকারক কিংবা আমদানিকারক দেউলিয়া হয়ে যাওয়া, রপ্তানিতে প্রতারণা কিংবা ভুয়া রপ্তানি এবং রপ্তানি বিল আদায়সংক্রান্ত মামলায় রপ্তানি আয়ের একটা অংশ আটকে রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রপ্তানি আয় দেশে না এলেও সরকারের নগদ সহায়তা ও রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ঋণ ঠিকই তুলে নিচ্ছেন রপ্তানিকারকরা। এতে সরকারের নগদ সহায়তা ও ইডিএফ ঋণের অপব্যবহার হচ্ছে। এ জন্য ব্যাংক ও রপ্তানিকারকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এরই মধ্যে ওই সুপারিশ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোয় চিঠিও পাঠানো হয়েছে।
দীর্ঘসময় রপ্তানি মূল্য অপ্রত্যাবাসিত (দেশে না আসা) থাকার বিষয়টিকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক দীর্ঘদিনের অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয় দেশে আনার যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেটি অবশ্যই ভালো। তবে এ ধরনের অনৈতিক কাজে যারা জড়িত, তাদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
দেশে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে ডলারের সংকট চলছে। সংকট মোকাবিলায় অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয় দ্রুত দেশে আনার ওপর জোর দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ ব্যাংকার্স সভায়ও বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংকগুলো এসব বকেয়া রপ্তানি আয় আনতে পারলে বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য বাড়বে। এ জন্য গত আগস্টে ব্যাংকগুলোয় চিঠি পাঠিয়ে অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয়ের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেই তথ্যের ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনটি তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিবেদনটি গভর্নরের সামনেও উপস্থাপন করা হয়। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, বন্দর থেকে পণ্য রপ্তানির পরপরই তা বাংলাদেশ ব্যাংকের ড্যাশ বোর্ডে রিপোর্ট করতে হয়। রিপোর্টিংয়ের ১২০ দিনের মধ্যে রপ্তানি মূল্য দেশে আনার নিয়ম রয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত জুন পর্যন্ত মোট ৬৩ হাজার বিলের বিপরীতে ১২ হাজার ৮২৭ কোটি টাকার রপ্তানি আয় অপ্রত্যাবাসিত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা পূর্ণ এবং ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা আংশিক মেয়াদোত্তীর্ণ। এ সময় পর্যন্ত প্রায় ৫৫ কোটি ২৫ লাখ ডলারের বিল স্বাভাবিক নিয়মে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, ‘স্বাভাবিক মেয়াদোত্তীর্ণ রপ্তানি বিলগুলো দীর্ঘসময়ে দেশে না এলে পাচারের সন্দেহ করাটাই স্বাভাবিক। এমনিতেই ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর বিপুল অর্থপাচার হয়। এর মধ্যে প্রকৃত যে অর্থ আসার কথা, সেটিও যদি না আসে, তবে সত্যিকারার্থেই তা উদ্বেগের ব্যাপার। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি বিএফআইইউয়ের তৎপরতা বাড়াতে হবে। জড়িতদের শাস্তি দিতে হবে।’
নগদ সহায়তার অপব্যবহার নিয়ে ড. তৌফিক বলেন, ‘নগদ সহায়তার অপব্যবহার প্রথম থেকেই হয়ে আসছে। নীতিমালা শিথিলতার কারণেই এ সুযোগ নিচ্ছেন রপ্তানিকারকরা।’ এ ধরনের অপব্যবহার রোধে পুরো রপ্তানি আয় দেশে না আসা পর্যন্ত নগদ সহায়তার আবেদন বিবেচনায় না নেওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
৫৫ কোটি ডলার পাচারের সন্দেহ : স্বাভাবিক নিয়মে মেয়াদোত্তীর্ণ ৫৫ কোটি ২৫ লাখ ডলারের মধ্যে ২৮ কোটি ২২ লাখ ডলার ২০২০ সাল ও তার পরবর্তী কয়েক মাসের। বাকি ২৭ কোটি ৩ লাখ ডলার মেয়াদোত্তীর্ণ হয় ২০২১ সাল ও তার পরবর্তী কয়েক মাসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, এগুলো সহজে আদায়যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও আদায় করা হচ্ছে না কিংবা আদায় করা যাচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার পরও এখন পর্যন্ত আদায় না হওয়ার বিষয়টি অনভিপ্রেত। দীর্ঘ সময় ধরে এ অর্থ অপ্রত্যাবাসিত থাকার বিষয়ে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকেও যৌক্তিক কোনো কারণ উপস্থাপন করা হয়নি। আবার অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা পেতে আইনি কোনো সমস্যা না থাকায় রপ্তানিকারকদের এসব আয় দেশে আনার ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ফলে রপ্তানি মূল্য পাচার তথা বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচারের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই এসব অর্থ আদায়ে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক।
ব্যবসার আড়ালে অর্থপাচার নতুন নয়। কেউ রপ্তানির মূল্য কম দেখিয়ে, কেউ আবার বিদেশ থেকে রপ্তানির মূল্য দেশে না এনে অর্থপাচার করছেন। আবার আমদানির মূল্য বেশি দেখিয়েও অর্থপাচার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৭৯ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান আমাদের সময়কে বলেন, ‘দেশ থেকে যে অর্থ পাচার হয়, তার ৯০ শতাংশ বাণিজ্যভিত্তিক। অর্থাৎ আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচার বেশি হয়। আবার এমনও দেখা যায়, আমদানি-রপ্তানি কিছুই হয়নি, কিন্তু পেমেন্ট হয়েছে। আবার রপ্তানি হলেও মূল্য প্রত্যাবাসিত হয়নি ইত্যাদি। এ রকম বিভিন্ন পন্থায় অর্থপাচার হচ্ছে।’
বেড়েছে শর্ট শিপমেন্ট : শর্ট শিপমেন্টের (রপ্তানি পণ্যে ঘাটতি থাকা) কারণে প্রায় ২৮ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় রয়েছে, যা মোট অপ্রত্যাবাসিত আয়ের ২১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ পরিমাণ পণ্য প্রকৃতপক্ষে রপ্তানি হয়নি এবং এর বিপরীতে রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবাসনেরও সুযোগ নেই। কিন্তু সিস্টেমে হালনাগাদ তথ্য না থাকায় তা আংশিক মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে প্রদর্শিত হচ্ছে। এসব মেয়াদোত্তীর্ণ ও অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি মূল্য ২০২০ সালের আগস্ট ও তার আগের সময়ের। কেননা ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে শর্ট শিপমেন্ট সার্টিফিকেট ইস্যু বন্ধ রয়েছে।
দেউলিয়া, জালিয়াতি ও মামলায় আটকা ৪৫ কোটি ডলার : রপ্তানিকারণ কিংবা বিদেশি ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত, বন্ধ কিংবা দেউলিয়া হয়ে গেলে অর্থ আটকে যায়। অর্থ আটকে যায় জাল-জালিয়াাতি, প্রতারণা ও ভুয়া রপ্তানির অভিযোগে মামলা হলেও। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ ধরনের অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫ কোটি ২১ লাখ ডলার।
নগদ সহায়তা ও ইডিএফ ঋণের অপব্যবহার : বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, রপ্তানিমূল্য পূর্ণ মেয়াদোত্তীর্ণ থাকা অবস্থায় ইডিএফ ঋণ সুবিধা বন্ধ থাকে। কিন্তু আংশিক মেয়াদোত্তীর্ণ থাকা অবস্থায় ইডিএফ ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। অন্যদিকে, সরকারি নগদ সহায়তা প্রদানের জন্য ৭২০ দিনের অধিক সময় ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ রপ্তানি মূল্যকে বিবেচনা করা হয় না। তবে শর্ট শিপমেন্টজনিত রপ্তানি বিলগুলো ২০২০ ও তার আগের সময়ের হওয়ায় উভয় সুবিধা গ্রহণে রপ্তানিকারকরা কোনো সমস্যার মুখে পড়ছেন না। ফলে এগুলো সংশোধন বা হালনাগাদের জন্য তাদের আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টার ঘাটতি রয়েছে। আবার শর্ট শিপমেন্টজনিত কারণে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে মর্মে অবহিত করা হলেও কাস্টমস থেকে সংশোধন করার আগ পর্যন্ত শর্ট শিপমেন্টের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায় না। ফলে শর্ট শিপমেন্টের অজুহাতে মেয়াদোত্তীর্ণ থাকা সত্ত্বেও সরকারি নগদ সহায়তা ও ইডিএফ ঋণ সুবিধা অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা অনভিপ্রেত। বিষয়টি ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট এবং অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড বাজেটি ডিপার্টমেন্টের নজরে আনা প্রয়োজন।
কঠোর ব্যবস্থার হুশিয়ারি : বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালের সভাপতিত্বে গত বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, চট্টগ্রাম কাস্টমস, বিজিএমই, বিকেএমইএ ও বাংলাদেশ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের উপস্থিতিতে একটি সভা হয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারকরা কাস্টমসের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বিষয়টি নিষ্পন্ন করলে বিপুলসংখ্যক মেয়াদোত্তীর্ণ রপ্তানি বিল অনিষ্পন্ন অবস্থায় থাকবে। সে ক্ষেত্রে সরকারি নগদ সহায়তা ও ইডিএফ ঋণ সুবিধার অপব্যবহার বন্ধ হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে এখনি কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের আবশ্যকতা তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তা ও ইডিএফ ঋণ সুবিধা বন্ধ করা যেতে পারে।