শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০১:২৪ অপরাহ্ন

প্রবীণরা আমাদের সম্পদ – সেলিনা আক্তার

মানুষের জীবনচক্র- নবজাতককাল, শৈশবকাল, কিশোরকাল, প্রাপ্তবয়স্ককাল ও বার্ধক্যকাল। এ পঞ্চম ধাপের শেষ ধাপ হলো বার্ধক্যকাল।এ কালে অবস্থানরত মানুষগুলোকে আমরা বলি প্রবীণ। ‘প্রবীণ’ যাত্রাপথ ষাট বছর থেকে শুরু করে জীবনের সমাপ্তি পর্যন্ত ধরা হয়। বয়স্ক তিন ধরনের ৬০ থেকে ৭০ বয়সি যা তরুণ প্রবীণ ৭০ থেকে ৮০ বছর বয়সি মধ্যম প্রবীণ এবং ৮০ থেকে তদুর্ধ্ববা অতি প্রবীণ। প্রবীণ আর বার্ধক্যকাল এক নয়। প্রবীণ ব্যক্তি বার্ধক্যে পতিত নাও হতে পারেন।কিন্তু বাংলাদেশে একজন মানুষকে ষাট বছর পার হওয়ার আগেই বার্ধক্যে পতিত হতে দেখা যায়। এর পেছনের কারণগুলো হলো- দারিদ্র্য, কঠোর পরিশ্রম, অপুষ্টি, অসুস্থতা।

আমাদের দেশে ৬৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষকে প্রবীণ নাগরিক বা সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে ধরা হয়। কোনো দেশে এ বয়সের মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার সাত শতাংশ বা তার বেশি হলে তাকে বয়োবৃদ্ধ সমাজ বলে। এ সংখ্যা ১৪ বা তার বেশি হলে তাকে প্রবীণ সমাজ বলে। বাংলাদেশ ২০২৯ সালে প্রবীণমুখিতায় পৌঁছাবে এবং ২০৪৭-এ প্রবীণ সমাজ হবে। পরবর্তী তিন দশকে বিশ্বব্যাপী প্রবীণদের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে দেড়শ’ কোটিরও বেশি মানুষ প্রবীণ হবে এবং তাদের ৮০ শতাংশ নিম্ন- মধ্যম আয়ের দেশে বাস করবে।

জনসংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন সোনালি সময় পার করছে।জনসংখ্যা এইমূহুর্তে আমাদের জন্য সম্পদ। এর কারণ হলো, এ মুহূর্তে এ জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ কর্মক্ষম মানুষ। দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী যাদের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ বছর।এরাই এখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে দেশের মানুষের গড় আয়ু দিনদিন বাড়ছে। এটা একটা বড়ো তবে খুব দ্রুতই এ সংখ্যা পরিবর্তন হবে। আমাদের দেশে একদিকে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে অন্যদিকে প্রজনন হার কমছে। এজন্যই বয়স কাঠামোতে প্রাকৃতিক নিয়মেই বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়বে এবং এটা একটি সময়ে অনেকটা চীন ও জাপানের সমাজের মতো হবে।এর প্রভাবে নির্ভরশীল মানুষের অনুপাত দিন দিন কমবে। জনমিতিক সুবিধা কোনো জাতির জন্য বারবার আসে না। এ ধরনের জনমিতিক সুবর্ণকাল একবারই আসে, যা থাকে কম-বেশি ৩০-৩৫ বছর।জনমিতির পরিভাষায় এটাই হলো একটি দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ। ২০১২ সাল থেকে এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মধ্যে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে এ সোনালি সময় শেষ হবে ২০৪০-এর দশকের প্রথম দিকে। এরপর থেকে আবার কর্মক্ষম জনসংখ্যার চেয়ে নির্ভরশীল জনসংখ্যা বাড়তে থাকবে। তাই এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য সরকার নানারকম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।

একটি দেশের মানবগোষ্ঠীর এ পর্যায়কে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য মানবপুঁজি হিসেবে দেখা হয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড একটি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের প্রভাব ফেলে। এজন্য অনেক চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেই একটি দেশকে জনসংখ্যার এ সুযোগ নিতে হয়। চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সফলতার ওপরই নির্ভর করে এ সুযোগ কতটা জাতির জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে।দেশে বর্তমানে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হলেও আর মাত্র তিন দশকের মধ্যে প্রবীণদের মোট সংখ্যা কর্মক্ষমদের ছাড়িয়ে যাবে। প্রবীণদের যদি সমাজের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে সমন্বিত করা না যায় তাহলে প্রবীণ জনগোষ্ঠী একসময় সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমান হারে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে চার কোটি। এই বিশাল জনগোষ্টিকে দীর্ঘমেয়াদি বাস্তব সম্মত পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাজের তাদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। প্রবীণ জনগোষ্ঠী সমাজের সম্পদ। আর তাই তাদের কল্যাণ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অসহায় প্রবীণদের নিরাপদ জীবনের জন্য সরকার দেশের ছয় বিভাগে ৬টি প্রবীণ নিবাস পরিচালনা করছে।দেশের ৬৪ জেলায় ৮৫টি শিশু পরিবারের প্রতিটিতে ১০টি আসন প্রবীণদের জন্য সংরক্ষণ করা আছে। এটা যথেষ্ট নয়। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি বে-সরকারি বিশেষ করে করর্পোরেট হাউজগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রবীণদের সম্মান ও কল্যাণে সরকার জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩, পিতামাতার ভরণপোষণ আইন-২০২১ প্রণয়ন করে কার্যকর করেছ।সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসরগ্রহণের বয়স বৃদ্ধিসহ পেনশন সুবিধা সম্প্রসারণ, পিতামাতাকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিবারের সদস্য ৪ থেকে ৬ জনে উন্নীতকরণ, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের প্রবীণ স্বাস্থ্যসেবা খাতে অনুদান বৃদ্ধি করাসহ প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠনের উদ্যোগ প্রবীণদের সুরক্ষায় সরকারের দায়বদ্ধতার প্রত্যক্ষ উদাহরণ।

প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী, জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের সমাজে বৈষম্য ও নিপীড়নমুক্ত নিরাপদ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা বলা আছে। নীতিমালা অনুযায়ী জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সম্পদ, মর্যাদা, লিঙ্গনির্বিশেষে মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। এছাড়া আলাদা, বিনামূল্যে ও স্বল্প মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, সব ধরনের যানবাহনে আসন সংরক্ষণ, বিশেষ ছাড়ে টিকিট প্রদান এবং আলাদা টিকিট কাউন্টার স্থাপন, প্রবীণদের জন্য দিবা-যত্নকেন্দ্র স্থাপন করার বিষয়ও উল্লেখ রয়েছে। এমনকি মৃত্যুর পর দাফনের দায়িত্বও পালন করবে রাষ্ট্র। অন্যদিকে, সিনিয়র সিটিজেনদের সম্পদ রক্ষাসহ সঞ্চয় প্রকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ, উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা রয়েছে সরকারের।

দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ দুস্থ ও স্বল্প উপার্জনক্ষম অথবা উপার্জনে অক্ষম বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে পরিবার ও সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে ‘বয়স্কভাতা’ কর্মসূচি প্রবর্তন করা হয়। সে সময়ে প্রাথমিকভাবে দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি ওয়ার্ডে পাঁচজন পুরুষ ও পাঁচজন মহিলাসহ দশজন দরিদ্র বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে প্রতি মাসে ১০০ টাকা হারে ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে দেশের সব পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনকে এ কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা হয়।২০০৯-১০ অর্থবছরে বয়স্কভাতাভোগীর সংখ্যা ২০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২২ লাখ ৫০ হাজার এবং জনপ্রতি মাসিক ভাতার হার ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকায় উন্নীত করা হয়। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৮ লক্ষ ০১ হাজার বয়স্ক ব্যক্তিকে জনপ্রতি মাসিক ৬০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে । এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৪ হাজার ২০৫.৯৬কোটি টাকা। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিবিড় তদারকি এবং সমাজসেবা অধিদফতরের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরলস পরিশ্রমে বয়স্কভাতা বিতরণে প্রায় শতভাগ সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

নানা কারণে সমাজে বয়স্করা অবহেলিত এদের মধ্যে একাকীত্ব ও অসহায়ত্ব ও বাড়ছে দ্রুতগতিতে। পরিবারের কাছ থেকে যে ধরনের সহায়তা বয়স্করা আশা করে তা পাচ্ছে না। প্রবীণরা সম্মানের সাথে থাকতে চান। প্রবীণদের জন্য চারটি বিষয় অপরিহার্য স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ,খাদ্য ও বাসস্থানের নিরাপত্তা ,সমবয়সিদের সহচার্য এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। প্রবীণদের জুটি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে ।বয়স্কদের সময় কাটানোর জন্য সকলের সার্বিক সহায়তা প্রয়োজন। বয়স্কদের শারীরিক ও মানসিক বিনোদনের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ব্যবস্থা করতে হবে। বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় তাই সহসাই বিভিন্ন অসুখ তাদের আক্রান্ত করে। হৃদরোগ, কিডনি রোগ ক্যান্সারসহ নানারকম মরনঘাতি অসুখসহশ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা ,আর্থ্রাইটিস, অস্টিওপোয়োসিস ,ডায়াবেটিসের মতো সমস্যায় ভুগে থাকেন প্রবীণেরা।তাদের জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থার। বয়স্কদের স্মৃতিশক্তি হারানোর সমস্যা দিনদিন বাড়ছে এর মূল কারণ একাকীত্ব। ডিমেনশিয়া বা অ্যালজাইমা মস্তিষ্কের স্নায়ু গঠিত রোগ হলেও এই রোগে আক্রান্তদের অবস্থার অবনতির কারণ হলো একাকীত্ব। বয়স্কদের খাবারের বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে। খাবার তালিকা ফলমূল শাকসবজি ভিটামিন মিনারেল ইত্যাদি থাকতে হবে। তবে রিচ ফুড পরিহার করতে হবে।

কাউকে ফেলে রেখে নয়, বরঞ্চ সবাইকে নিয়ে বিশ্ব সমাজের প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অভিযাত্রা চলমান রাখতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য দলিলের মাহাত্ম্য এখানেই। প্রবীণরা সমাজে বটবৃক্ষের মতো। তাদের সারা জীবনের অভিজ্ঞতা তরুণদের চলার পথের পাথেয়। প্রবীণ ব্যক্তি পরিবার, সমাজ ও দেশের কল্যাণে জীবনব্যাপী অবদান রেখেছেন। দেশ জাতি তাদের কল্যাণের ভূমিকা রাখবে এটা সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

পিআইডি ফিচার


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: