বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০০ পূর্বাহ্ন

রিলিজিয়াস ট্যুরিজম : দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অনুষঙ্গ – মাহবুবুর রহমান তুহিন

অনেক পথের যাত্রা কিন্তু একটি পা ফেলার মধ্য দিয়েই শুরু হয়। বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ প্রথম পা ফেলে। পরের পা ফেলে তীর্থস্থান গমণের উদ্দেশ্যে। রবীন্দ্রনাথের দেবতার গ্রাস কবিতায় তীর্থ যাত্রা উঠে এসেছে-

গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটে গেল ক্রমে
মাতৃ মহাশয় যাবেন সাগর সংগমে।
তীর্থ স্থান লাগি। সঙ্গী দল গেল জুটি
কত বাল বৃদ্ধ নার নারী; নৌকা দুটি
প্রস্তুত হইল ঘাটে।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্সধর্মী উপন্যাস বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুন্ডলা’ উপন্যাসের নায়ক নবকুমার তীর্থস্থান দেখতে গিয়েই নির্জন বনে কপালকুন্ডলার সাক্ষাৎ পান। তীর্থ স্থানে যাওয়ার উদ্দেশ্য উঠে আসে এ ভাবে- যুবা কহিলেন, ‘আমি ত পূর্ব্বেই বলিয়াছিলাম, মহাশয়ের বাটীতে অভিভাকব আর কেহ নাই- মহাশয়ের আসা ভাল হয় নাই।’
প্রাচীন পূর্ব্ববৎ উগ্রভাএব কহিলেন, ‘আসব না? তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। এখন পরকালের কর্ম্ম করিব না ত কবে করিব?’
তীর্থস্থান গমণ থেকেই পর্যটন ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জময়েত হয়ে হজ্জের সময়। এ জমায়েত এখন ধর্মীয় রীতি পালনের পাশাপাশি সৌদি আরবের আয়ের প্রধান উৎস হয়ে দঁড়িয়েছে। গেলো বছর ৮৩ লাখ মানুষ হজ্জ করতে যান। এর মধ্যে ৬০ লাখের বেশি মানুষ ওমরাহ পালন করেন। গতবার হজ্জ থেকে সৌদি আরবের রোজগার হয়েছিলে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া যারা হজ্জ করতে সৌদি আরব যান তারা ২৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করেন।

দক্ষিণ এশিয়ায় পৃথিবীর ২০ ভাগ মানুষের বসবাস। ধর্ম এ অঞ্চলের মানুষের ইতিহাস, ঐহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন-যাপনের সাথে জড়িয়ে আছে। প্রধানত মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও শিখ ধর্মের অনুসারী এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। ধর্মীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও স্থাপনা এখানে রয়েছে।

শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানকের জন্মস্থান পাঞ্জাবে যেটি এখন পাকিস্তানের অংশ। কিন্তু শীখ ধর্মের অনুসারিরা বেশিরভাগ ভারতের পাঞ্জাবের বাসিন্দা। পাকিস্তান ও ভারতের বৈরি সম্পর্কের দরুণ গুরু নানকের জন্মস্থানে সহজে যেতে পারে না ভারতের নাগরিকরা। আরবের মুসলিম ব্যবসায়িরা ভারত মহাসাগর দিয়ে প্রথম এ অঞ্চলে আসে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মসজিদ নির্মিত হয় কেরালার মেথালাতে যা অনেকেরই অজানা। এ অঞ্চলে দৃষ্টি নন্দন স্থাপত্যের বহু মসজিদ ছাড়াও আজমীর শরীফ, নিজাম উদ্দিন, বাবা বুলেহ শাহ (করাচি)র মাজার শুধু ধর্মীয় আবেগগত দিক নয় স্থাপত্য শৈলীর দিক দিয়েও অনন্য। হযরত আদম (আ.) এর পায়ের ছাপ আছে শ্রীলংকাতে।

বাংলাদেশে ষাট গম্বুজ মসজিদসহ হযরত শাহজালাল, শাহ পরান, শাহমাগদুম, শাহ আমানতের মাজারের বিশাল জমায়েত ধর্মীয় পর্যটনের অন্যতম উদহারণ।

হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি, বিকাশ সবই এ অঞ্চলে। গয়া, কাশীসহ অসংখ্য হিন্দু ধর্মীয় তীর্থস্থান ও উপাসনালয় আছে যাতে লাখ লাখ ভক্ত জমায়েত হয়।

বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের জন্মভিটে নেপালে। তিনি দীক্ষাপ্রাপ্ত হন ভারতে। বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিলো। মহাস্থানগড়, পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহারসহ এ দেশে প্রায় ছোট বড় ৫০০ বুদ্ধিস্ট স্থাপনা আছে। এসব স্থাপনাকে ঘিরে আমাদের প্রতিবেশি বুদ্ধিস্ট দেশগুলোর পর্যটক আগমনের উগ্যোগ পর্যটন খাতকে দারুন সমৃদ্ধ করতে পারে। এটি মাথায় রেখে ২০১৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক বুদ্ধিস্ট সার্কিট সম্মেলন।

বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৩০ কেটি বাংলাভাষী ছড়িয়ে আছে। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ যে আসলে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের দোহা ও গান এটি অনেকেই জানেন না। এর বহুল প্রচার এ অঞ্চলের পর্যটনের ক্ষেত্রে উল্লম্ফন ঘটাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

গত বছর চীনের প্রায় ৫ কোটি পর্যটক পৃথিবীর নানা দেশ ভ্রমণ করেন। দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ সংখ্যক চীনা পর্যটক (প্রায় ৩ লাখ) আসে শ্রীলংকাতে। বুদ্ধিস্ট কান্ট্রি চীনে অতীশ দীপংকার গৌতম বুদ্ধের পর পূজিত হন, যার জন্মস্থান মুন্সিগঞ্জের বজ্রযোগিনী গ্রামে। আমরা যদি অতীশ দীপংকরের জন্মস্থানকে ্ট্যুরিস্ট ডেসটিনেশনে পরিণত করতে পারি এটি ব্যাপক সংখ্যক চীনা পর্যটককে আকৃষ্ট করবে।

ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির ভারত সফরের পূর্বে ফ্রান্সে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করে দওহপৎবফরনষব ওহফরধ’ শিরোনামে একটি ম্যাগাজিন পড়তে দেন। প্রেসিডেন্ট ম্যাগাজিনের প্রকাশিত একটি লেখায় পড়েন মোঘল সম্রাট আকবর পুত্র সন্তান কামনায় ফতেহপুর সিক্রিতে সেলিম খান চিশতির শরানপন্ন হন। সেলিম খান চিশতী সম্রাটকে দেয়া করলে যথাসময়ে তিনি পুত্র সন্তান লাভ করেন। ইতিহাসে এই পুত্রের নাম সম্রাট জাহাঙ্গীর নামে খ্যাত হয়। ঠিক এ সময় সারকোজি ও মাদাম কার্লা বুনি দম্পতি সন্তানের আশায় ছিলেন। নিকোলাস সারকোজি ভারতে এসে প্রথমেই যান ফতেহপুর সেলিম খান চিশতীর মাজারে। কিছুদিন পর কার্লা বুনি সন্তান সম্ভবা হন এবং পুত্র সন্তান লাভ করেন। এ খবর প্রকাশিত হয় ফ্রান্সের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা লা-মঁদে এবং জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল টিভি-৫ এ সংক্রান্ত একটি অনুষ্ঠান প্রচার করে। এর পর থেকে হাজার হাজার দম্পতি ফ্রান্স থেকে ভারতে আসছে সেলিম খান চিশতীর মাজারে।

অর্থনৈতক সমৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস দূর করে সৌহার্দ-সম্প্রীতি স্থাপনে রিলিজিয়াস ট্যুরিজম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সার্ক এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক : মাহবুবুর রহমান তুহিন, সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: