মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২২ অপরাহ্ন

শিরোনাম
চাটখিলে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে অব্যাহতি দেয়ায় আনন্দ মিছিল  চৌদ্দগ্রামে বিদ্যুৎ স্পৃষ্টে গৃহবধূর মৃত্যু ট্রেনে পায়ের আঙুল কাটা পড়েছে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের ঈদে ১৪ টি মিউজিক ভিডিও মুক্তি পেয়েছে প্রিন্স খানের চাটখিলে পৈত্রিক সম্পত্তি জবরদখলে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তপ্তদেহ শীতল করতো গাছের নিচে বসেই, গাছ না থাকায় এত গরম সরকার হজযাত্রীদের সর্বোত্তম সেবা দিতে বদ্ধপরিকর-ধর্মমন্ত্রী দেশের স্বার্থ বিরোধী কাজের সাথে যারাই জড়িত, তারাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী – আনু মুহাম্মদ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে  প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে- সুবর্ণচর উপজেলা আ.লীগ হাতিয়ার উন্নয়নে সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ কর্মসূচিকে কাজে লাগানো হবে – মোহাম্মদ আলী এমপি

কাছে থেকে দেখা নীলকণ্ঠ কম্যুনিস্টগণ – যতীন সরকার

সাতান্ন সালে আইএ পাস করলাম। কিন্তু বিএ ক্লাস তো নেত্রকোনা কলেজে নেই। কাজেই আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনে আবার অনিশ্চয়তা।
তবু, সেই অনিশ্চয়তার মধ্যেই দুঃসাহসে ভর করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। থাকা-খাওয়ার কোনো সংস্থান না করেই ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম।
নেত্রকোনা থেকেই ময়মনসিংহে এসে আনন্দমোহনে ভর্তি হয়েছিলো আমার সহপাঠি বন্ধু নৃপেন সরকারও। সেও ছিলো প্রায় আমারই মতো হতদরিদ্র। বাড়ি থেকে মাসে মাসে টাকা এনে কলেজে পড়ার মতো সংগতি তারও ছিলো না। কিন্তু ময়মনসিংহে খুব ভালো একটি লজিং পেয়ে যাওয়ায় তার বেশ সুবিধা হয়ে গিয়েছিলো। সেই নৃপেনই আমাকে বললো যে, লজিং পেতে হলে মহাদেব সান্যালের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় নেই এবং সে-ই আমাকে মহাদেব সান্যালর কাছে নিয়ে গেলো। প্রথম পরিচয়েই বুঝতে পারলাম যে, মহাদেব সান্যাল হচ্ছেন দেবাদিদের মহাদেবের মতোই পতিত-পাবন!
আমরা যারা নেত্রকোনা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম, আমাদের প্রায় সবারই অলিখিত গার্জেন হয়ে গেলেন মহাদেব বাবু। আমাদের লজিং করে দেয়া, ট্যুইশনি জোগাড় করে দেয়া, এমনকি রোগ হলে যাতে আমরা বিনা পয়সায় ডাক্তারের সাহায্য পেতে পারি তারও ব্যবস্থা করে দেয়া-এরকম অনেক কিছুরই দায়িত্ব মহাদেব বাবু নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় আমারও থাকা-খাওয়ার একটা অপ্রত্যাশিত রকমের ভালো ব্যবস্থা হয়ে গেলো। দু’তিনটা ছেলেমেয়েকে পড়ানোর বিনিময়ে আহার ও আশ্রয় মিললো শহরের ডেঙ্গু বেপারি রোডের উপেন্দ্র পালের বাসায়। পাল মহাশয় ছিলেন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ডাইলপট্টিতে তাঁর গুড়ের দোকান। আর্থিক অবস্থা তার সচ্ছল না হলেও দরাজ দিল বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তাই। আর তাঁর সহধর্মিনী ছিলেন একেবারে মাতৃরূপা। আমার প্রতি তাঁর স্নেহ ছিলো একান্তই অকৃত্রিম। আমি যে আমার মায়ের কাছ থেকে দূরে আছি-তেমনটি তিনি আমাকে ভাবতেই দেননি। প্রবাসেও যে এমন বাড়ির মতো পরিবেশ পেয়ে গেলাম তার সবটাই মহাদেব বাবুর অবদান।
শুধু আমি নই, আমার মতো এ রকম আরো অনেককেই তিনি চিরঋণী করে রেখেছেন। কিন্তু যিনি আমাদের সবার উপকারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি কি পরোপকার করার মতো অঢেল সম্পদে সম্পন্ন ছিলেন?
মোটেই না। নেত্রকোনার নওপাড়া গ্রামের সান্যাল পরিবারের সন্তান মহাদেব সান্যাল পরিবার-বিচ্ছিন্ন ও সম্পদ-বঞ্চিত হয়ে পড়েছিলেন কম্যুনিস্ট রাজনীতি করতে গিয়ে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় পরপরই কমরেড মনিসিংহের নেতৃত্বে হাজং কৃষকদের টংক আন্দোলনে যোগ দেয়ার অপরাধে মহাদেব সান্যাল সহ যে-সব কম্যুনিস্ট গ্রেফতার হয়েছিলেন, মুসলিম লীগের শাসন যতোদিন ছিলো ততোদিন তারা কেউই কারা প্রাচীরের বাইরে আসতে পারেননি। চুয়ান্নর নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হলো, তবু ওই দেশপ্রেমিক রাজবন্দীদের সহজে মুক্তি ঘটলো না। ছাত্রসমাজের প্রবল দাবির মুখে অনেক দেরিতে একে একে এঁরা মুক্ত হলেন। মুক্ত হলেন মহাদেব বাবুও। কিন্তু মুক্তির পর কোনো আবাসও নেই, নেই আহারেরও সংস্থান। তবে, মাথা গোঁজার ঠাঁই একটা মিললো। সেটি কমরেড শৈলেন রায়ের বাসা। বিপত্মীক শৈলেন রায় নিজে কম্যুনিস্ট বলেই তার বাসাটা হয়ে গিয়েছিলো কম্যুনিস্টদের মেসবাড়ির মতো। ময়মনসিংহ টেলিগ্রাফ অফিসের পাশের ওই বাসাটিতেই এসে উঠলেন সদ্য জেলফেরত কমরেড মহাদেব সান্যাল ও কমরেড অজয় রায়। শৈলেন রায়ের ভাই রতু রায়ও কিছুদিন আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এখানেই উঠেছেন। শুধু এরাই নন, তখনকার বিশাল ময়মনসিংহ জেলার সব এলাকার কমরেডরাই এ-বাসাতে সামায়িক আশ্রয় নিতেন।
কিন্তু মহাদেব সান্যালের মাথা গোঁজার ঠাঁই যদি বা মিললো, আহারের জোগাড় করা হলো খুবই কঠিন। একমাত্র ভরসা ট্যুইশানি। তাও বেশি পয়সার ট্যুইশানি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। কোন যুগে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন, অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পাট তো সেখানেই খতম। ক্লাস নাইন টেনের ছাত্র পড়াতে না পারলে, বিশেষ করে অঙ্ক না জানলে, ট্যুইশানি করে ভালো পয়সা পাওয়া সম্ভব নয়। মহাদেব বাবুকে তাই নিচের ক্লাসের ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে অন্নবস্ত্রের সংস্থান করতে হলো, আর সে কারণেই অনেকগুলো ট্যুইশানি নিতে হলো। এতোগুলো ট্যুইশানি করার পর সময় বা এনার্জি কোনোটাই অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। অথচ মহাদেব বাবুর এনার্জি অফুরন্ত। আর সময়ও তিনি বের করে নিতে জানেন। অবিশ্যি এনার্জি আর সময়- দুটোই নিজের জন্যে খুব কমই ব্যবহার করতেন তিনি, সবই পরার্থে উৎসর্গীকৃত, আমাদের জন্যেই তার সকল ভাবনা ও দুর্ভাবনা নিবেদিত।
এ অবস্থাতেও কিন্তু প্রজাপতির নির্বন্ধ ঘটে গেলো মহাদেব সান্যালের জীবনে।
হরি চক্রবর্তী নামে এক চাটগাঁইয়া ব্রাহ্মণ ময়মনসিংহেরই এক জমিদারি সেরেস্তায় চাকরি করতেন। জমিদারি উঠে যাওয়ার পর তিনি তীব্র জীবিকা সংকটে পড়লেন, এর সঙ্গে এসে যুক্ত হলো বয়স্কা কন্যাকে পাত্রস্থ করার সমস্যা। যেনতেন প্রকারে যে কোনো পাত্রের হাতে কন্যা সমর্পণ করে সে-সমস্যার সমাধান করতে চাইলেন তিনি। কমরেড শৈলেন রায়ের পরিচিত ছিলেন এক ভদ্রলোক। শৈলেন বাবু হরি চক্রবর্তীকে কন্যা দায় থেকে উদ্ধার করার জন্যে মহাদেব বাবুকে বর হবার প্রস্তাব দিলেন। মহাদেব বাবু সঙ্গে সঙ্গে রাজি। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর জুড়ি নেই।
বিয়ের ব্যবস্থাাও অভিনব। হরি চক্রবর্তী থাকতেন ব্রাহ্মপল্লীতে ‘হৃদয় নিবাস’ নামের একটি মস্ত বড়ো বাড়িতে। বাড়িটি জমিদারদের। জমিদারি উঠে গেলেও এবং হরি চক্রবর্তীর চাকরি না থাকলেও, তিনি তখনো সেই বাড়িটিতে থাকার সুযোগ পাচ্ছিলেন। বিয়ে হবে ওই বাড়িতেই।
একদিন মহাদেব বাবু আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমার বিয়ের তারিখটির কথা তো শুনেছেনই। ওই দিন সন্ধ্যাবেলায় খাওয়া-দাওয়া করে আমাদের বাসায় (মানে কমরেড শৈলেন রায়ের বাসায়) চলে আসবেন। সেখান থেকে ব্রাহ্মপল্লীর হৃদয় নিবাসে রওয়ানা হয়ে যাবো। ওখানেই বিয়ে হবে।’
বললাম, ‘তা তো বুঝলাম। কিন্তু, আপনার বিয়েতে নেমন্তন্ন, আর আমরা নিজের নিজের বাসা থেকে খাওয়া-দাওয়া করে যাবো?’
‘এর মানে’- অতি পরিষ্কার। আমার হবু শ্বশুর ভদ্রলোকের অবস্থা তো জানোই। একপাল বরযাত্রীকে খাওয়ানোর সঙ্গতি তাঁর নেই। তবে, হৃদয়-নিবাস বাড়িটাতে তো বেশ বড়ো বড়ো ঘর আছে, বসতে দিতে কোনো অসুবিধে হবে না। আমরা বলে দিয়েছি-বরযাত্রী যাবে একশো জনেরও বেশি, তাদের জন্য কেবল শেফ্র এক কাপ করে চায়ের ব্যবস্থা করলেই চলবে।’
শুধু চা নয়। মহাদেব বাবুর শ্বশুর বরযাত্রীদের জন্যে প্রতি কাপ চায়ের সঙ্গে একটি করে দুধের নাড়–ও পরিবেশন করেছিলেন।
বর বেশে মহাদেব সান্যাল পিঁড়িতে বসলেন। পুরোহিত মন্ত্র আবৃত্তি করছেন, বর কিন্তু একেবারে মৌন। বিয়ের সব শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান আর স্ত্রী-আচারই পালিত হলো, কেবল বরের মুখ থেকে কোনো মন্ত্রই বেরুলো না। তবু শান্তি চক্রবর্তী নামক কুমারীটি শ্রী মহাদেব সান্যালের ধর্মপত্মী রূপে পরিণত হলেন শ্রীমতি শান্তি সান্যাল।
বিয়ের আসরে প্রচুর হৈ হুল্লোড় করে অনেক রাতে আমরা যার যার আস্তানায় ফিরে এলাম।
শৈলেন রায়ের বাসার মতোই সে-সময়ে ময়মনসিংহে কম্যুনিস্টদের আরেকটি আড্ডাখানা ছিলো ‘নয়াজামানা পুঁথিঘর’।এই বইয়ের দোকানটিকে তো অনেকে কম্যুনিস্ট পার্টির অঘোষিত অফিস বলেই মনে করতেন। বাস্তবেও অবিশ্যি এটি তা-ই হয়ে উঠেছিলো। শহরের চন্দ্রকান্ত ঘোষ রোডের যে-ভবনটিতে এই দোকনটির অবস্থান, বিশেষ সূত্রে কম্যুনিস্টরাই ছিলেন সে-ভবনটির মালিক। চুয়ান্ন সালে পাকিস্তান সরকার কম্যুনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর পার্টি-দরদী জ্ঞান বাগচি মশাইকে মালিকানা দিয়ে এখানে যে বইয়ের দোকানটি খোলা হয় তারই নাম দেয়া হয় ‘নয়া জামানা পুঁথিঘর’। জেল ফেরত কমরেড রতু রায় হন দোকানের প্রধান কর্মচারি বা ম্যানেজার। তাই, স্বভাবতই এটি হয়ে ওঠে নিষিদ্ধ ঘোষিত কম্যুনিস্ট পার্টির লোকজন ও তাদের সহযোগিদের আড্ডাস্থল। এই আড্ডায় নিয়মিত আসতেন ছাত্রনেতা কাজী আবদুল বারি, বিভূতি আচার্য, আবদুল আলী, আশুতোষ ধর, সুধীর দাস, নরেশ পাল এবং এ-রকম আরো অনেকে। আলতাব আলী, জ্যোতিষ বোস, অজয় রায়, মহাদেব সান্যাল, বেণীমাধব দেব, ওয়াহেদ আলীর মতো জেল ফেরত কমরেডদেরও বৈকালিক আড্ডা জমতো এই নয়াজামানা পুঁথিঘরেই।
শৈলেন রায়ের বাসা আর পুঁথিঘরের আড্ডায় যাদের সান্নিধ্যে এসেছিলাম তারা-অর্থাৎ কম্যুনিস্টরা-যে অন্য সকল বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন কৃতী লোকদের থেকে আলাদা-সে কথা বুঝতে আমার বিলম্ব হয়নি। জীবিকার জন্যে কমরেড শৈলেন রায় হয়েছিলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। অথচ নেত্রকোনার রামেশ্বরপুরে সম্পন্ন জোতদার-তালুকদার পরিবারের মানুষটির এমনটি করার কোনোই প্রয়োজন হতো না, তিনি কম্যুনিস্ট না হয়ে বৈষয়িক বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি হতেন। তার ভাই রতু রায় কম্যুনিস্ট হওয়ার দরুনই জেল খেটে খেটে আর আত্মগোপনে থেকে থেকে জীবনে সংসারী হওয়ার কোনো সুযোগই পেলেন না। দৃষ্টিক্ষীণতায় বহুদিন যাবত ভুগছিলেন। সাতান্ন সালে যখন তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়, তখনই দেখেছি, তিনি অনেক মোটা লেন্সের চশমা ব্যবহার করেন। তারপর জঙ্গী শাসক আইয়ুবের জেল থেকে যখন বেরিয়ে এলেন চৌষট্টি সালে, তখন দেখলাম, তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ। শৈলেন রায়ের শ্যালিকা-পুত্র অজয় রায় ছিলেন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। তার সম্পর্কে সংক্ষেপে অত্যন্ত চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন ধনঞ্জয় দাশ তাঁর আত্মকথা আমার জন্মভূমি : স্মৃতিময় বাংলাদেশ-এ। সেই অজয় রায়ও নিঃস্বের জীবন বেছে নিয়েছিলেন। উনিশশো সাতান্ন/আটান্ন সালে মহাদেব সান্যালের মতোই তাঁরও জীবিকা ছিলো ছাত্র-পড়ানো। আটান্নর আইয়ুবী আমল থেকে তাঁর পলাতক জীবন ও মাঝে মাঝে কারাবণ।
কমরেড জ্যোতিষ বোসের সঙ্গেও আমার পরিচয় সেই উনিশশো সাতান্ন সালেই। দীর্ঘদিন পরে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে কম্যুনিস্টদের মধ্যে একটা সংসারী আমেজ দেখা দিয়েছিলো। সে আমেজের মধ্যেই জ্যোতিষ বোস বিয়ে করলেন ছায়া সেনকে। ছায়া সেন তখন মাত্র ক্লাস এইটের ছাত্রী। তাকে নিয়ে সংসারও করবেন, আর পড়াশোনা করিয়ে ম্যাট্রিকটাও পাস করাবেন-এ-রকমই সংকল্প করেছিলেন কমরেড জ্যোতিষ বোস। ময়মনসিংহ রামকৃষ্ণ মিশনের কাছাকাছি অবস্থিত তার পৈতৃক বাসভবনের বৈঠকখানায় বসে আমাদের কাছে সেদিন তিনি তার সংসার-জীবনের পরিকল্পনার ছকটা তুলে ধরছিলেন। আমরা ছিলাম চারজন। আবদুল কুদ্দুস, আবদুল আলী, বাণেশ্বর দাস আর আমি। চারজনই আনন্দমোহন কলেজের বিএ ক্লাসের ছাত্র। তাঁর কথা শুনতে শুনতে আমরা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিলাম। জেলে যাওয়ার গল্প, পলাতক থাকার গল্প, এমনকি পুলিশের হাতে নির্যাতিত হওয়ার গল্পও তিনি এমনভাবে বলে যাচ্ছিলেন যে, আমাদের মনে হচ্ছিলো-এ সবই বুঝি খুব মজার ব্যাপার। আহা, এ-রকম মজা আমরাাও যদি চেখে দেখতে পারতাম।
কিন্তু এ-সব যে মোটেই মজার ব্যাপার নয়, জ্যোতিষ বোসের-এবং আমাদের পরিচিত অন্য অনেক কমরেডের-জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলো একান্ত কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করে উপলব্ধি করেছিলাম। নিজের জীবনেও এ সবের তেতো স্বাদ একেবারে কম পাইনি।
আরেক ছাত্র কম্যুনিস্টকে দেখেছিলাম-বিভূতি আচার্য যার নাম। মুক্তাগাছার জমিদার পরিবারের ছেলে। না, মুক্তাগাছার বিখ্যাত মহারাজার বাড়ির কেউ নয়। তবে ওই জমিদারিরই ছোটখাটো হিস্যা ছিলো তাদের। আর ছোট সাপও তো সাপই। ছোট হোক বড়ো হোক, জমিদার বাড়ির ছেলে বলতেই আমাদের সামনে একটা দূরত্বের ও বৃহত্ত্বের ছবি ফুটে উঠতো। কিন্তু অবাক হলাম বিভূতি আচার্যকে দেখে। সাধারণ পোশাক পরা, সাধারণ মধ্যবিত্ত ছেলেদের মতোই চলাফেরা। একাধিক বার বিএ ফেল করলেও পাঠ্যতালিকা বহির্ভূত পড়ায় ভীষণ মতোযোগ। বিশ্বরাজনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য ইত্যাদিতে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা দেখে আমরা চমৎকৃত হয়ে যেতাম।
প্রগতিশীল পত্রপত্রিকা বিক্রি করতে দেখেছি কমরেড ওয়াহেদ আলীকে। অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা মোটেই বেশি কিছু নয়। কিন্তু দেশি-বিদেশি রাজনীতির জ্ঞান খুবই পাকা। ময়মনসিংহ শহরের পুরোনো বাসিন্দাদের একজন। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খুব খারাপ ছিলো না। সে-অবস্থাকে আরো ভালো করার কোনো চেষ্টাই না করে কমরেড ওয়াহেদ কম্যুনিজমের আদর্শের বেদিমূলে জীবনের সব আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়েছিলেন। অর্থাৎ জেলখাটা, আত্মগোপনে থাকা, আর প্রকাশ্য কাজের সুযোগ পেলে তার জন্যে একেবারে সর্বস্ব সমর্পণ করা।
নয়া জমানা পুঁথিঘরের আড্ডাতেই দেখেছি সদ্য জেল-ফেরত কমরেড বেণীমাধব দেবকে। সদা প্রফুল্ল আর সদা হাস্যময় মানুষটি। অথচ একটুকুতেই রেগে যান। তাঁর এই দুর্বলতাটাকে কাজে লাগায় সবাই। সুযোগ পেলেই তাঁকে রাগিয়ে মজা দেখে। প্রৌঢ়ত্বের কোঠায় পা দিয়ে তখনো, সেই সাতান্ন সালেও, তিনি কুমার। এই কৌমার্য ঘুচানোর ব্যাপারে তাঁর অভিনব সব প্রয়াসের মধ্যে বেশ মজার মজার উপাদান মিলতো। আর প্রায়শই কৃত্রিমভাবে একেকটা রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বেণীবাবুর বন্ধুরা বেশ মজা করতেন।
অথচ, এ-সব ক্ষ্যাপামির পরও, তাঁর কম্যুনিস্ট সত্তাটি ছিলো খুবই সিরিয়াস ও নির্ভেজাল। শেরপুরের কমরড রবি নিয়োগীর রিক্রুট কমরেড বেণীমাধব দেব সমাজ বদলানোর কাজে মনপ্রাণ সমর্পণ করে দিয়েছিলেন। কম্যুনিজমের আদর্শকে অঙ্গীকার করেই দারিদ্র্যকে বরণ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু দারিদ্র্য তাঁকে মরণ কামড় দিতে ছাড়েনি। আমার সঙ্গে যখন তাঁর প্রথম পরিচয় তার বিশ বছর পর তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হলো এই দারিদ্র্যের কামড়জনিত ক্ষতের দরুনই। প্রতিক্রিয়াশীল পাক শাসকদের অমানবিক অত্যাচার-উৎপীড়নের পাশাপাশি এই দারিদ্র্যের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখেছি মহাদেব সান্যাল, জ্যোতিষ বোস, ওয়াহেদ আলীসহ আরো অনেক কমরেডকে। কিন্তু সেই সঙ্গে অবাক বিস্ময়ে এও লক্ষ করেছি যে, সমাজের বিরূপতা, রাষ্ট্রের উৎপীড়ন বা দারিদ্র্যের দংশন-কোনো কিছুই তাঁদের উঁচু মাথা নিচু করতে পারেনি। পুরাণে নীলকণ্ঠের কথা পড়েছি যিনি সমুদ্রমন্থজনজাত বিষ নিজে পান করে পৃথিবীকে বিষমুক্ত করেছিলেন। আর বাস্তবে পাকিস্তানি জামানার কম্যুনিস্টদের দেখে আমার মনে হয়েছে যে, এঁরা পুরাণকারের কল্পনার নীলকন্ঠকেও ম্রান করে দিয়েছেন।
কম্যুনিস্টদের অজস্র ভুলের কথা আমি জানি। সেই সব ভুলের কথা তুলে অন্য অনেকের মতো আমিও তাদের কম সমালোচনা করিনি। কিন্তু একান্ত কাছে থেকে যখন কম্যুনিস্টদের দেখলাম তখন বুঝলাম যে, ভুলক্রুটির চেয়ে এঁরা অনেক অনেক বড়ো। নেত্রকোনার একজন সুরসিক কম্যুনিস্ট ঠাট্টা করে বলতেন, ‘কম্যুনিস্ট কথাটার অর্থ জানো? কম+অনিষ্ট=কমানিষ্ট। এ থেকেই হয়েছে ‘কম্যুনিস্ট’। অর্থাৎ যারা কম অনিষ্ট করে তারাই হচ্ছে কম্যুনিস্ট। অন্য সবাই সমাজের অনেক বেশি অনিষ্ট করে। সারা দুনিয়ায় কম্যুনিস্টরা যদি অনিষ্ট করেও থাকে, তবে করেছে খুব কম মানুষের।’
ঠাট্টা করে তিনি বোঝাতে চাইতেন যে, বুর্জোয়া রাজনীতিকরা শতকরা পাঁচ/দশজন বুর্জোয়া পেটি বুর্জোয়ার ইস্ট করার লক্ষে শতকরা নব্বই জন মানুষের অনিষ্ট করে। আর কম্যুনিস্টরা শতকরা নব্বই জন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের ইষ্ট করতে চায় বলে দশজনের অনিষ্ট তাদের করতেই হয়। এ কাজ করতে গিয়ে তারা অনেক ‘ভুল’ করে বটে, কিন্তু ‘অন্যায়’ করে না। কম্যুনিস্ট মানেই সত্যিকারের ন্যায়নিষ্ঠ।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: