শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:১৪ পূর্বাহ্ন

নারী আন্দোলন এবং পুরুষতান্ত্রিকতা : তাহেরা বেগম জলি

পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত লড়াই সংগ্রাম হয়েছে, সে গৌরবের সিংহভাগের দাবীদারই পুরুষ সমাজ। এমনকি নারী আন্দোলনও এর ব্যতিক্রম নয়। রাজা রামমোহন রায় এবং মহান বিদ্যাসাগর এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমাদের দেশেও বর্তমানে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের দায়িত্ব প্রধানত আমাদের দেশের পুরুষ সমাজই কাঁধে তুলে নিয়েছেন। প্রগতির ধারায় এগিয়ে থাকা মানুষেরাই যুগে যুগে সমাজের যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। এবং এটাই ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম। ইতিহাস সাক্ষী দেয় দাস ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও লড়াই করেছিলো প্রধানত দাস মালিকের সন্তানেরাই। এসব ঘটনা বাড়তি কোনো প্রশংসার দাবী করেনা। কারণ এগুলো ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরেই লেখা আছে।

আমি আজ এখানে কিছু ভিন্ন ধরণের কথা বলবো। উঁকি দিয়ে দেখবো একটু নিজেদের ঘরেও। সেখানকার চিত্রটা আসলে কী বলে তা দেখা দরকার। তাছাড়া আমাদের ঘরের মধ্যে কী হচ্ছে তাও একটু খতিয়ে দেখা উচিৎ। কারণ রাজপথের আন্দোলনের সঙ্গে, ঘরের মধ্যের মানুষদের চিন্তার যোগসূত্র থাকলে, তবেই সে আন্দোলন সফল পরিণতি পায়। তাই আন্দোলনকারীদের সমালোচনা করবার আগে নিজেদের দিকে তাকানো আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, আমরাই বা কোন্‌ চোখে দেখছি নারী নির্যাতনকে, নাকি আমরা এসব নির্যাতনই মনে করছি না, আমাদের সে’সব চিন্তা ভাবনা বাইরের আলোতে তো আসতে হবে।

আমাদের দেশের অভিভাবক মাত্রই ভুক্তভোগী, নারী নির্যাতন আজ চূড়ান্ত সীমা লঙ্ঘন করার কারণে। অথচ আমরা সেই অভিভাবক সমাজ শুধুমাত্র মাত্রই চাতক পাখীর মতো ফটিক জল-ফটিক জল করে রাত দিন সময় পার ক’রে দিচ্ছি। কে কবে আমাদের মেয়েদের জীবন এবং সম্ভ্রমের নিশ্চয়তা দেবে এই আশায় আমরা পথ চেয়ে বসে আছি। আমাদের ভাবখানা এমন, আমরা বেতন দিয়ে কিছু মানুষ ঠিক ক’রে রেখেছি, ওরাই মিছিল করুক, গুলির সামনে রাজপথে দাঁড়িয়ে ওরাই মরুক। সময় মতো ফলটা আমাদের দোর গোঁড়ায় পৌঁছোলেই আমরা খুশি। এর থেকে অবিবেচনাপ্রসুত চাওয়া আর কী হতে পারে? খালেদা জিয়া সরকার যে সাতজন কৃষক হত্যা করেছিলো তার বিচার আজও তারা পাইনি। অথচ ওই সাতজন কৃষক ইয়াসমিন হত্যার বিচার চাইতে গিয়েই জীবনটা দিয়েছিলো। যে ডাক্তার (!) ইয়াসমিন হত্যার মিথ্যা ময়না তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছিলো, তাকেও বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। আমরা অভিভাবকরা ওই সাতজন কৃষক হত্যার এবং মিথ্যা রিপোর্ট দেওয়া ডাক্তারের বিচার চেয়ে রাজপথে নামতেই পারতাম। কিন্তু সে দায়িত্ব আমরা পালন করিনি। অথচ আমরা এখন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি দিনাজপুরের সাতজন কৃষকের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত ইয়াসমিন হত্যার বিচার। ভাবখানা এ’রকম, যেন আমাদের দয়াতেই ইয়াসমিন হত্যার বিচার আলোর মুখ দেখেছে! কোনোকিছু উপভোগ করবারও যে একটা সীমারেখা থাকা দরকার, আমরা বেমালুম তা ভুলে বসে আছি। এটা দিয়ে প্রমাণ হয়, ভোগবাদী চিন্তায় আমরা আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আমাদের দেশের ঘরে ঘরে এখনকার বাবা মায়েরা সন্তানের বিষয়ে খুবই সচেতন। এটা নিশ্চয় খুব ভালো লক্ষন। কিন্তু এটাও সত্য, ঘরে ঘরে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের কণ্ঠ ক্রমাগত ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়ছে। এবং সে ক্ষীণ এতোটাই যে, পাশে ভয়াবহ নারী নিপীড়ন চোখে দেখে-কানে শুনেও, পালে বাতাস লাগা নৌকার মতো উদ্দেশ্যহীন জীবনে, গন্তব্যহীন আমরা ভেসে চলেছি।

আমরা কেনা জানি,মেয়েদের মৌলিক অধিকার দিনে দিনে ঠাণ্ডা ঘরে ঢুকে পড়ছে! সম্পত্ততিতে নারীর সম অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা আজ জরুরীই শুধু নয়, এই অধিকার কার্যকরী করবার সঙ্গে সমাজে নারীর প্রতিষ্ঠা পাওয়াও অনেকখানি নির্ভর করছে। আর একটা আজব কথা না বললেই নয়, তা বিবাহ আইন। আমাদের দেশে বিবাহ আইন, ১৮ বছর না হলে মেয়েদের বিবাহ দেওয়া অন্যায় এই বক্তব্য একেবারেই প্রতিষ্ঠিত নয়। অথচ এটা প্রতিষ্ঠিত করবার বিকল্প কিছু নেই। আমাদের দেশের অধিকাংশ বাবা এবং ভাইয়েরা এগুলো কিন্তু সব জানেন। কিন্তু তার পরেও আমরা আছি উটপাখির মতো বালির মধ্যে মুখ গুজে। যেন মুখ গুজে থাকলেই ঝড় থেমে যাবে। একজন বাবা-একজন ভাই তার ঘরের লাঞ্ছিত নারী সদস্যের জন্যে সরব হবেন না, তারপরেও বলবেন আমার মেয়ে রাজকন্যা কলিজার টুকরা! আমার রাজকন্যার মধ্যেই আমার জীবন! এ রীতিমতো সোনার পাথর বাটি চাওয়া অথবা চুড়ান্ত মিথ্যাচার।

আর একটা কথা আমি বলবো, তা শুনলে খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। তারপরেও সকলের বিবেচনার জন্য কথাটা আমি বলবো। এখন সমাজে অন্তত এটুকু অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ছেলে মেয়েরা নিজেদের পছন্দের ভিত্তিতে দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করতে পারে। নিশ্চয় খুবই সুখের বিষয় এটা। কিন্তু একটা বিষয় আমাদের খেয়াল করা দরকার, যে সকল ছেলেরা নিজেদের পছন্দমতো দাম্পত্যসঙ্গী খুঁজছেন তাদের কতজন নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন বা অতিতে খুলেছেন। এই যে স্বাধীনভাবে দাম্পত্য সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতা, এটাও একটা সামাজিক আন্দোলনেরই ফল। এবং সেই সামাজিক আন্দোলন কতোটা মর্মান্তিক ছিল, তা হলিউডের রোমিও জুলিয়েট সিনেমাটা দেখলে কিছুটা বোঝা যায়। আর এখন একজন ছেলে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে অংশ গ্রহন করবেন না, কিন্তু তিনি নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অতিতের অর্জন করা সুবিধা ভোগ করবেন, এটা ওই ছেলের জন্য অবশ্যই এক ধরনের সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা। এবং এধরণের সুবিধাবাদীরা কখোনো মানুষের সামান্য দায় নেওয়ারও চিন্তা করে না। নারীর প্রকৃত মর্যাদা তো দেয়ই না। যে ছেলে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধ্বে রাজপথে দাঁড়ায় না, সে স্বাধীনভাবে দাম্পত্যসঙ্গী নির্বাচনের অধিকার কেন পাবে? আমাদের দেশের মেয়েদের অন্তত এটুকু বোঝা দরকার, যে ছেলে নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার নয়, সে কোন্‌ অধিকারে একজন স্বাধীন মেয়ের সঙ্গে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখবে? এবং এই ছেলে শেষ পর্যন্ত নারীকে সম্মান করে না। বা তা করতে পারেও না।

লেখক : কলামিস্ট এবং রাজনৈতিক কর্মী।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: