শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:১৪ পূর্বাহ্ন

তাচ্ছিল্যের শিকার রেমিটেন্স যোদ্ধাদের ঝক্কিঝামেলার অন্ত নেই : রিন্টু আনোয়ার

দুনিয়া কাঁপানো করোনাভাইরাস দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে ভালো সূচক প্রবাসীদের রেমিটেন্সকে ঝাঁকুনি দিয়েছে চরমভাবে। প্রবাসী–অধ্যুষিত দেশগুলোর কয়েকটিতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে লকডাউন। এর জেরে আক্রান্ত বাংলাদেশ। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে নতুন রেকর্ডের উঠতি সময়েই করোনার থাবায় পড়েছে বাংলাদেশ। রেমিটেন্স প্রবাহে ‘সুখবর’ নিয়েই শুরু হয়েছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরটি। সদ্য বিদায়ী বছরে প্রবাসী আয়ে বড় উল্লম্ফন ঘটেছে। পুরো বছরে প্রবাসীরা ১ হাজার ৮৩৩ কোটি মার্কিন ডলারের আয় পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালে এসেছিল ১ হাজার ৫৫৩ কোটি ডলার। সেই হিসাবে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ শতাংশ।

বাংলাশে ব্যাংকের রেমিটেন্স সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারির ১৫ দিনেই প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছে বাংলাদেশ। সবমিলিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরের সাড়ে ছয় মাসে (২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি) প্রবাসীরা পাঠিয়েছে এক হাজার ৩০ কোটি ডলারের রেমিটেন্স । গত মাস কয়েক এ খাতে করুণ দশা। গত মার্চ মাসে প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ। এই আয়ের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত বিশেষজ্ঞরা।
দেশে আদম নামে গালমন্দ শোনা রেমিটেন্স যোদ্ধারা প্রবাসে করোনায় মারা যাচ্ছে। রোগে ভুগছে। অনেকে ফেরারির মতো জীবন হাতে নিয়ে ঘুরছে। বিদেশি শ্রমবাজারে এমন আঘাতে প্রবাসী আয়ে লাগা ধাক্কা সামাল দেওয়া কঠিন।

বাংলাদেশের প্রবাসী আয় আহরণের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার, ইতালি, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া ও জর্ডান। এর মধ্যে সৌদি আরব করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। আবুধাবিতে বাংলাদেশ দূতাবাস ও দুবাইয়ে বাংলাদেশের কনস্যুলেট জেনারেল সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণ বাড়ছে। সেখানে ওয়ালমার্টসহ বড় বড় খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদের বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ কিংবা কাজের সময়সীমা কমানোর ঘোষণা করেছে। মালয়েশিয়া করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কাতার। ইতালিতে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এসব দেশের কোনোটিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে রেমিট্যান্স হাউস ও ব্যাংকগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা পড়েছে মহাবিপদে। সৌদি আরব, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রায় দেড় লাখ অভিবাসী আটকা পড়েছে। সবচেয়ে বেশি বিপদে আছেন যাদের বৈধ ভিসা নেই। এদের বড় অংশই কাজ ও আয়ের অভাবে না খেয়ে দিনাতিপাত করছে।

গার্মেন্টসসহ দেশের ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর জন্য সরকারি প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। প্রবাসীরা সেই ধরনের প্রণোদনার চেয়ে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার বেশি কাঙাল। কিন্তু, করোনা ঝড়ে দেশে এসে যে তাচ্ছিল্যের শিকার তারা হয়েছে তা ভুলবার নয়। তাদেরকেই করোনার জন্য দায়ী করে রীতিমত ভিলেনের জায়গায় নিয়ে ঠেকানো হয়েছে। কোথাও মারধর, কোথাও শত্রু চিহ্নিত করার মতো ধাওয়া দেয়া হয়েছে। বাড়িতে লাল পতাকা টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রবাসী খোঁজে। গ্রামের অতি উৎসাহী কিছু লোক শত্রু ধরিয়ে দেয়ার মতো প্রবাসীদের বাড়ি দেখিয়ে দেয়। কোনো কোনো বাড়ির প্রবাসী দেশেই আসেনি। তারপরও পরিবারটিকে শাঁসানোর ঘটনা ঘটছে। এটা চরম সামাজিক অসুস্থতা ও বিরোধের ইঙ্গিত দিচ্ছে। শুরু থেকেই ঠেকানোর চেষ্টা না করে মোটা দাগে দোষটা চাপছে দেশে ফেরত প্রবাসীদের ওপর। নষ্টের মূলে তাদের শনাক্ত করে বাদবাকিদের ছহি-শুদ্ধ থাকার এ চেষ্টা সাফল্য পেয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে করোনা মোকাবেলার চেয়েও প্রবাসীদের তুলাধুনা করাকে জরুরি এজেন্ডা করার উদ্দেশ্য-বিধেয় প্রশ্নবিদ্ধ।

প্রবাসীদের তাড়া করার বিপরীতে নেতা-মন্ত্রীদের কর্মী-সমর্থকবাহিনী বেষ্টিত হয়ে প্রেসব্রিফিং, পরামর্শ, দান-দখিনার সেশন চলছে। এতে ভাইরাস ছড়ে না। বিদেশ থেকে ঘুরে এসে নেতা, আমলাসহ বিশিষ্টজনদের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়নি। তারা দিব্যি ঘুরছেন। ফটোসেশনসহ জ্ঞান দিচ্ছেন। বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের কোয়ারিন্টনে থাকা এবং রাখার আহ্বান জানাচ্ছেন। চোরেও চোর দৌড়ানোর এ সার্কাস কষ্টপীড়িত মানুষের সঙ্গে এক ধরনের তামাশা। যে সচিব আমেরিকা থেকে ফিরেই অফিস করতে শুরু করেছেন, বালিতে ট্যুর শেষ করে চিকিৎসকদের যে দলটি একদিনও ঘরে না থেকে হাসপাতালে, ক্লিনিকে চলে গেছেন, যে ব্যবসায়ীটি, রাজনীতিক বিদেশ থেকে ফিরে একদিনও কোয়ারেন্টিনে থাকেননি, বিজনেস ক্লাশে দেশে আসা এলিট প্রবাসীদের ব্যাপারে কিন্তু কথা হচ্ছে না।

প্রবাসীদের অধিকাংশই শ্রমিক। বিপদে পড়েই তারা এই সময়ে দেশে ফিরেছে। তারা কাউকে বিপদে ফেলতে ঘুরে বেড়াচ্ছে- বিষয়টা এমন সরল নয়। এই আদমদের করোনা আমদানিতে দোষী সাব্যস্ত করার ব্যস্ততার বিপরীতে কেউ তা উৎপাদনে ভূমিকা রেখে চলছি কি-না সেটাও ভাবনায় রাখার অবকাশ রাখে। ‘নবাবজাদা বলে গালও বাদ যায়নি। এই নবাবজাদারের পাঠানো বিদেশি টাকা দিয়েই দেশে বহুজন নেতা, সম্রাট হন। তারপর আবার তা বিদেশে পাচার করেন। অনেক প্রিন্স, ক্রাউন প্রিন্সও এই টাকায় বিদেশে প্রতিপালিত হয়। আর “নবাবজাদাদের” সন্তানেরা হয় সুবিধাবঞ্চিত। অন্তহীন গল্পের মতো তৈরি হতে থাকে পরবর্তী নবাবজাদা। সরকার বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াতে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ২ শতাংশ হারে যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে এতেও ব্যাংকে হয়রানিসহ ঝক্কিঝামেলার অন্ত নেই। ভুক্তভোগী প্রবাসী ও তাদের পরিবারের কাছে এটি শুভঙ্করের ফাঁকি। তারওপর এখন তাতে আঘাত হানল করোনা।

এমন দুর্যোগ-অপমানের মধ্যেও প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ হয়নি। সারা দেশের ব্যাংক শাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং, হুণ্ডি ইত্যাদি পথে তা পৌঁছে যাচ্ছে প্রবাসীদের পরিবারের কাছে। চলতি মাসের প্রথম ১৬ দিনে প্রবাসীরা ৪৪ কোটি ২০ লাখ ডলার আয় পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৩ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। আর গত মার্চের পুরো সময়ে এসেছিল এসেছিল ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। তবে এভাবে কতদিন আসবে তা অনিশ্চিত। গত দুই মাসে ৩৬ কোটি ডলার রেমিটেন্স কমেছে। যা স্থানীয় মুদ্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। সামনের দিকে তা আরো কতো নামবে বলা যায় না। প্রবাসীরা বেকার হলে দেশে তাদের স্বজনরাও বিপদে পড়বেন। এতে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেবে। ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুসারে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৬-৭ লাখ মানুষ বিভিন্ন দেশে যায়। আর বর্তমানে বিশ্বের ১৬০টি দেশে এক কোটির বেশি প্রবাসী রয়েছে। এসব প্রবাসী বছরে ১৮ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠায়। স্থানীয় মুদ্রায় যা এক লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। যা দেশের মোট রফতানি আয়ের অর্ধেকের বেশি। প্রতি মাসে বাংলাদেশ থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ বিদেশে যায়। কিন্তু মার্চ মাস থেকে সেটি বন্ধ রয়েছে। আর এ অবস্থা তিন মাস চলতে থাকলে দেড় লাখ লোক বিদেশে যাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। দ্বিতীয় গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে আড়াই লাখ প্রবাসী বিদেশ থেকে ফেরত এসেছে। এর মধ্যে সৌদি আবর থেকে আসছে ৪১ হাজার। এছাড়াও আরব আমিরাত মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুর থেকে অনেক মানুষ আসছে। এরা আবার বিদেশে ফেরত যেতে পারবে কিনা সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
প্রবাসীদের বড় অংশই থাকে সৌদি আবর এবং সংযুক্ত আবর আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। আবার এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রবাসীর কাজের বৈধ ভিসা নেই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ভিসা জটিলতাসহ নানা কারণে প্রতিদিন ফেরত আসছেন প্রবাসীরা। তারা চাকরি ছাঁটাইয়ের আশঙ্কায় রয়েছেন। এতে ওইসব দেশ থেকে রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক ধারা দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হচ্ছে করোনাভাইরাস। মধ্যপ্রাচ্যেও এই ভাইরাস হানা দিয়েছে।

করোনার প্রভাব অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। রেমিটেন্সের অর্ধেকেরও বেশি আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এসব কারণে ঊর্ধ্বগতির রেমিটেন্স নিয়ে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কোনোভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব এড়াতে পারবে না। দেশের অর্থনীতির একমাত্র রেমিটেন্স ছাড়া সব সূচকই নিম্নমুখী। এখন করোনার প্রভাবে রেমিটেন্সের প্রবৃদ্ধির হারও হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। গত বছরও বিদেশে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ গেছেন মধ্যপ্রাচ্যে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী থাকেন মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ ও ইতালি। সব ক’টি দেশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। ছোট আকারের বিভিন্ন ব্যবসায় সম্পৃক্তরা পুঁজি হারানোর শঙ্কায়। এসব দেশের প্রবাসীরা জমানো সামান্য টাকা দিয়ে দিন পার করছে। তাদের সামনের দিনগুলো অনিশ্চিত।

লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: