মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:১৮ পূর্বাহ্ন

করোনা: সংক্রমণের দায়ভার এবার জনগণের উপর… : আবু নাসের অনীক

‘আমরা করব জয়, আমরা করবো জয় একদিন, ওহো বুকের গভীরে আমরা জেনেছি, যে আমরা করবো জয় একদিন’। আমাদের সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে এই ‘বায়োলজিক্যাল ওয়ার’-এ বিজয় অর্জন করার জন্য যখন আমরা বদ্ধপরিকর ঠিক সেই সময়টিতে সরকারের একের পর এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত জয়ের সমস্ত সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিচ্ছে। আমাদের জীবনকে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক জগতে।

ইতিপূর্বে দেশের সকল স্থানে সীমিত শব্দের আড়ালে সমস্ত শিল্প কলকারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। গার্মেন্ট কারখানা অবস্থিত এলাকায় সংক্রমণ বেড়ে গেছে। যা মোট সংক্রমণের সংখ্যায় প্রতিফলিত হচ্ছে।
গত ৫ এপ্রিল ঘোষণা করা হয়েছে দোকান শপিংমল আগামী ১০ এপ্রিল থেকে খুলে দেওয়া হবে। ঘোষণা দেওয়া মাত্রই নগরজীবনে তার প্রতিফলন দেখা গেছে। ঢাকা শহরের রাস্তায় সেই চিরচেনা জ্যাম সৃষ্টি হয়েছে। যেসব দোকানপাট বন্ধ ছিলো সবকিছুই খুলছে। হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় ঢুকছে। যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এটা তৈরি করা কি এই মুহুর্তে খুবই আবশ্যক ছিলো, মাননীয় গণ!! তৈরি করার কথা একারণে বল্লাম যে, সব কিছুই আপনারা করছেন। আর দায় চাপানো শুরু করেছেন জনগণের উপর।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দোকান শপিংমল খোলার লক্ষ্যে একটি সার্কুলার দেওয়া হয়েছে, যার ‘বিষয়’- এ লেখা হয়েছে ‘কোভিড-১৯ রোধকল্পে শর্ত সাপেক্ষে সীমিত পরিসরে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করা’। বিষয়টি যদি বস্তুগত ভাবে বিবেচনা করি এটাই প্রতিয়মান হয় যে, বরং কোভিড-১৯ বিস্তারের ক্ষেত্রে এই প্রজ্ঞাপণ ভুমিকা রাখবে। মানুষ কোন ধরনের শারীরিক দুরত্ব ছাড়াই বাইরে তার কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। গত এক সপ্তাহের যদি ফেরি ঘাট থেকে শুরু করে গার্মেন্ট কারখানার চিত্র পর্যবেক্ষন করা হয় তবে এর সত্যতা প্রকাশ পাবে। প্রশ্ন হতে পারে জনগণ স্বাস্থ্যবিধি মানছেনা সরকার কি করবে! সরকারের দায়টা এখানেই যে সরকার জানে এই পরিস্থিতিতে যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলা হচ্ছে সেটা কতোটা কার্যকর হতে পারে, সেটা বিবেচনা না করে যে সিদ্ধান্তগুলি তারা গ্রহণ করছে সেটাই উদ্ভুত পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী গতকাল জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির মিটিং থেকে বেরিয়ে সংবাদ কর্মীদের বলেন,‘আমাদের এখানে সংক্রমণ বাড়ছে, গত ৮-১০ দিন ধরে দেখছি চার থেকে পাঁচশ রোগী হতো, কিন্তু এখন ছয়শ ছাড়িয়ে গেছে, আজ সাতশ ছাড়িয়েছে। এখন মার্কেট খোলা হয়েছে, গার্মেন্ট খোলা হয়েছে, দোকানপাটে আনোগোনা বাড়ছে কাজেই সংক্রমণ যে একটু বৃদ্ধি পাবে এটা আমরা ধরেই নিতে পারি।’ তাহলে যুক্তি কি বলে! পূর্বে যেটা উল্লেখ করেছি কোভিড-১৯ বিস্তারের লক্ষ্যেই দোকানপাট খুলে দেয়া হচ্ছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে সেটাই প্রমাণিত হয়। শুধু তাই নয় গার্মেন্ট কারখানা খোলা থেকে শুরু করে গত সপ্তাহে সরকার ‘কোভিড-১৯’ রোধকল্পের বিষয়টি সামনে এনে যে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তা সবগুলোই রোধের বিপরিতে বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা: বেনজির আহমেদ বলছেন,‘যতই সীমিত আকারে হোকনা কেনো, দোকান, শপিংমল খুলে দিলে স্বাভাবিকভাবেই সংক্রমণ বেড়ে যাবে। লক্ষণ উপসর্গ নেই এমন করোনা আক্রান্ত মানুষ যতো জায়গাতে যাবেন তিনি সেখানেই মানুষকে সংক্রমিত করবেন। আর স্বাভাবিক কারণে যখন সব খুলে দেওয়া হবে তখন মানুষের চলাচল বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ ছোট একটি দেশ, তখন দেশের আনাচে-কানাচে এটা ছড়িয়ে যাবে। এবং বাংলাদেশ একটি দীর্ঘ সংক্রমণের চক্রে যাচ্ছে। এখন যতদিন সংক্রমণ আছে ততদিন যদি কষ্ট করে লকডাউন যদি করা যেত তাহলে সংক্রমণের রাশ টেনে ধরা যেত- যেটা এখন আর থাকছেনা’।

দেশের একজন শীর্ষ পর্যায়ের ভাইরোলজিষ্ট যখন এই মতামত পোষণ করছেন তখন আমরা এ ধরনের বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে ব্যবসায়ীদের মতামতকে প্রাধান্য দিতে যেয়ে সমগ্র দেশকে একটা ভয়াবহ পরিনতির দিকে ঠেলে দিচ্ছি।

মার্কেট খোলার সিদ্ধান্ত ঘোষণার সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে তীব্র সমালোচনার ঝড় ওঠে। আর সেই সমালোচনাকে সামাল দেওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে। ‘সরকার সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবন জীবিকার কথা বিবেচনায় নিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আপনি ব্যক্তিগতভাবে আপনার জন্য ভালোটি বেছে নিন।’ কি চমৎকার বয়ান! এই কথার মাধ্যমে অত্যন্ত সুকৌশলে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়ার দায়ভার এককভাবে জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়ার অপকৌশল ছাড়া আর কিছুনা। জনগণকে যদি তার ভলোটা তাকেই বুঝে নেওয়ার ব্যাপার হয় তাহলেতো আপনাদের সাধারণ ছুটি ঘোষণার প্রয়োজন নেই, লকডাউন করারও প্রয়োজন নেই, পরিবহনও বন্ধ রাখার দরকার কি? গার্মেন্ট, দোকান খুলে দিয়ে যেমন বলছেন স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, তেমনি বলেন! কে মানলো কে মানলো না এসবে আপনাদের কি যায় আসে, তাইতো!! কিন্তু বিষয়টি কি আদৌ তাই! যেকোন মহামারি পরিস্থিতিতে বিশেষ করে অধিক দ্রুততায় সংক্রমিত সময়ে কখনওই ব্যক্তি এককভাবে ভালো বা মন্দ ঠিক করতে পারেনা। প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সিদ্ধান্ত হতে হয় সামষ্টিক। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেই সামষ্টিক সিদ্ধান্তের উপর জোর দিচ্ছে, আর আমাদের এখানে ব্যক্তির উপর দায় চাপাচ্ছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত জনগণকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্ররোচনা দিচ্ছে।এই ক্রান্তিকালীন সময়ে জনগণকে সঠিক পথের দিশা দেখানোর দায়িত্ব সরকারের, অথচ তারা এই দায় অস্বীকার করে শ্রেণি স্বার্থ রক্ষার কাজটিকে বৈধতা দেওয়ার জন্য দায়টি চাপিয়ে দিচ্ছে জনগণের উপর।

একদিকে লকডাউন জারি রাখা অন্যদিকে সবকিছু খুলে দেওয়া চরম স্ববিরোধীতা। সরকার সুস্পষ্টভাবেই সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল আইন)-২০১৮ এর (৩) এবং (১১)-এর (২) ও (৩) ধারা লঙ্ঘন করছে। যা আমি গত লেখায় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছিলাম। আইন বলে, লকডাউন জারি করা এলাকায় জরুরি পরিষেবা ব্যতীত সবকিছু বন্ধ থাকবে। তারা জনস্বাস্থ্য বিবেচনার মধ্যেই আনছেনা, তাদের কাছে এখন একমাত্র মুখ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একের পর এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

এর পূর্বে সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে গার্মেন্ট কারখানা খুলেছে। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানার নমুনা আমরা দেখেছি। এখন আবার দোকান শপিংমল খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে একই কথা বলা হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলতে হবে। এফবিসিসিআই’র সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলছেন,‘ একটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বা একটি দোকানের আয়তন ১০ ফুট বাই ১০ ফুট। এর মধ্যে ফার্নিচারসহ একজন মালিক ও কমপক্ষে দুইজন কর্মচারি বসেন। এরপর বাকি জায়গায় দুইজন ক্রেতার দাঁড়ানোই কষ্টকর। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মোতাবেক সামাজিক দুরত্ব কতটা মানা সম্ভব!’ এটাই বাস্তবতা! যতোই বলবেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু করতে হবে কিন্তু বাস্তবতা বলে সেটা আদৌও সম্ভব না। এবং মজার বিষয় হচ্ছে আপনারা খুব ভালোভাবেই এই বাস্তবতা সম্পর্কে জানেন। গার্মেন্ট কারখানা খোলার আগেও এটা জানতেন। তারপরেও আত্মঘাতী সিদ্ধান্তগুলি বাস্তবায়নের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন।

গত এক সপ্তাহ ধরে দক্ষিন এশিয়াতে সংক্রমণের হার যেমন অনেক বেশি একই সাথে মৃত্যুর হারও বেশি। সারা পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো কিছু দেশ ব্যতীত বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডাঃ মোহম্মদ শহীদুল্লাহ বলছেন,‘ যেটুকু শিথিল করা হয়েছিলো এরপর আর কিছু শিথিল করার আগে অবশ্যই অ্যাপিডেমিওলজিক্যাল ট্রেন্ড অর্থাৎ সংক্রমণের ধারা কী সেটা লক্ষ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। রোগী বাড়ছে, আমরা এখনই ঢালাওভাবে দোকানপাট খোলার পক্ষে নই’। এই বক্তব্য তিনি অফিসিয়ালি সরকারকে জানানোর পরেও সরকার তাদের মতামতকে উপেক্ষা করে সমস্ত পর্যায়ে জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্বহীন করে ব্যবসায়ীক দিক গুরুত্ব দিচ্ছে। আমাদের আগামীকে ঢেকে দিচ্ছে অন্ধকারের চাঁদরে।

যারা মনে করছেন নিজে একা স্বাস্থ্যবিধির নিয়ম পালন করলেই আপনি আক্রান্ত বা সংক্রমিত হবেননা এই ধারনাটি সম্পূর্ণই ভুল। সামষ্টিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি যদি না মানা যায় তবে এই সংক্রমণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার বিকল্প অন্য কোন পথ নেই। এই দায় ব্যক্তির একার নয়, এই দায় সরকারের।

রাতের অন্ধকার পার করে চোখ মেলেই আমরা একটা ঝলমলে রৌদ্রজ্জ্বল সকাল দেখতে চাই, সতেজ বাতাসে শ্বাস নিতে চাই, সমস্ত জরা-জীর্ণকে ঠেলে সরিয়ে আনন্দময় একটা জীবন চাই। এই চাওয়াটা মানুষ হিসাবে আমার অধিকার।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: