সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৪৪ অপরাহ্ন

তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীঃ বেড়ে উঠা ও জীবনযাপন-শাহ আলম বাদশা

তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী বা ‘হিজড়া’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে আরবি হিজরত বা হিজরি শব্দ থেকে। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- Migrate/Transfer বা পরিবর্তন। আমাদের দেশসহ সারাবিশ্বে বিশেষ এক ধরনের লিঙ্গগত প্রতিবন্ধীকেই ‘হিজড়া’ বলা হয়। আমরা ‘হিজড়া’ বলে ডাকি এমন একটি শ্রেণিকে, যারা নারীও নয়, আবার পুরুষও নয়। আল্লাহর ইচ্ছায় প্রাকৃতিক নিয়মেরই তারা অস্বাভাবিক মানুষ বা শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসেবে ভূমিষ্ঠ হয়, যাতে তাদের কোনো হাত বা দোষ নেই। ‘হিজড়া’ শব্দটাকে তারা তাই অভিশাপ বা গালিই মনে করে থাকে। তবে জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সাথেই কেবল তাদের প্রতিবন্ধিতাকে তুলনা করা যায়। মূলত তারা হচ্ছে ট্রান্সজেন্ডার। তাদের প্রধান সমস্যা হলো- তাদের লিঙ্গে নারী বা পুরুষের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে না। অনেকের বেলায় লিঙ্গ নির্ধারক অঙ্গও থাকে না। লিঙ্গগত ত্রুটির ওপর ভিত্তি করে তাদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
১। শারীরিকভাবে পুরুষ কিন্তু মানসিকভাবে নারী বৈষিষ্ট্যসম্পন্ন হিজড়াদের বলা হয় ‘অকুয়া’
২। উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যবহির্ভূত হিজড়াদের বলা হয় ‘জেনানা’
৩। আর মানুষের হাতে সৃষ্ট বা ক্যাসট্রেটেড পুরুষদের বলা হয় ‘চিন্নি’ সাধারণত xx প্যাটার্নের ডিম্বানুর সমন্বয়ে কন্যাসন্তান আর xy প্যাটার্ন থেকে ছেলেসন্তানের জন্ম হয়। ক্রুটিহীন ভ্রুণের ক্ষেত্রে ক্রোমোজোমের প্যাটার্নের প্রভাবে পুত্রসন্তানের মধ্যে অন্ডকোষ বা আর কন্যাসন্তানের মধ্যে ডিম্বকোষ জন্ম নেয়। পুরুষের অন্ডকোষ থেকে নিসৃত হয় ‘এন্ড্রোজেন’ নামক পুরুষ-হরমোন আর ডিম্বকোষ থেকে নিসৃত হয় ‘এস্ট্রোজেন’। ভ্রুণের বিকাশকালে নিষিক্তকরণ ও বিভাজনের ক্ষেত্রে যখন অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সৃষ্টি হয়, তখনই ‘হিজড়া-শিশু’র জন্ম হয়। অর্থাৎ ক্রোমোজোমের প্যাটার্ন xxy হলেই একটি শিশু লিঙ্গগত ক্রুটি নিয়ে হিজড়া হিসেবে জন্ম নিয়ে থাকে। তৃতীয় লিঙ্গ বা ‘হিজড়া’ হিসেবে ভূমিষ্ঠের কারণ হিসেবে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এ জন্যই দেয়।

উপমহাদেশে হিজড়া প্রথার চল মুঘল-আমল থেকে। যৌনপেশা, বাঁধাই, ছল্লা এসবই তাদের ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে। হিজড়া জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও আবহমান কাল থেকে এ জনগোষ্ঠী অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষাব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তানিশ্চিতকরণ, সর্বোপরি সমাজের মূলস্রোতধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে সরকার ‘হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি’ শীর্ষক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপ মতে, বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার, যদিও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তালিকানুযায়ী প্রায় ১৫ হাজার হিজড়া রয়েছে। তবে আসল সংখ্যা আরও বেশিও হতে পারে- যেহেতু অনেক হিজড়া তাদের পরিচয় গোপন করতে বাধ্য হয়। হিড়াদের সামাজিকভাবে গ্রহণ না করার কারণেই চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ নানাস্থানে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয় তাদের। বাংলাদেশে সামাজিকভাবে হিজড়াদের বাঁকাচোখে দেখা হয়, এমনকি নিজ পরিবারের কাছেও তারা নিগৃহীত হয়। বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠী স্কুল ও পরিবার থেকে ঝরে পড়ায় মূলত, ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এ শ্রেণিটি এতটাই অবহেলিত যে, তাদের অবস্থা যেন- ‘না ঘরকা না ঘাটকা’। পরিবার ও সমাজে তারা অনাদর ও বৈষম্যের শিকার। ফলে, শিশু-কিশোর বয়সেই তাদের পড়ালেখা থেমে যায়। এতে করে তাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার হার সামান্যই। পরিবারের সদস্যদের সমর্থন না পেয়ে তাদের শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিতে হয় সংঘবন্ধ হিজড়াদের মাঝে। সেখানে প্রত্যেক হিজড়ার একজন করে ‘গুরু মা’ থাকেন। যিনি তাদের আশ্রয় দেন। সেখানে স্রেফ খাওয়াপরার বিনিময়ে তাদের দিয়ে ‘গুরু মারা’ এক ধরনের ব্যবসা করে থাকে। তারা মানুষের বাসা-বাড়ি, দোকানপাট এমনকি চলতিপথে গাড়ি ও পথযাত্রীদের থামিয়ে চাঁদা দিতে বাধ্য করে থাকে। চাঁদা নিতে গিয়ে অনেক সময় তারা জোরজবরদস্তিসহ বিব্রতকর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি করে। তাদের জীবনমানের উন্নয়নে দেশ-বিদেশে অনেক সংস্থা কাজ করছে। আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশছাড়াও ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের মতন দেশে হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। হিজড়াদের নিয়ে কর্মরত বাংলাদেশি সংস্থাগুলো তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে তাদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য দাবি জানিয়ে এলেও বাংলাদেশে এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি, তবে সরকারিভাবে তাদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কাজ চলছে।

বাংলাদেশে তারা ২০০৮ সালে প্রথামবারের মতো ভোটাধিকার পেলেও ভোটার আইডিকার্ডে জেন্ডার-নির্ধারণ না থাকায় সেখানেও বিভিন্ন বিড়ম্বনা রয়েছে। সরকার ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো হিজড়া শিশুদের শিক্ষা উপবৃত্তি ও প্রশিক্ষণের ওপর পাইলট প্রকল্প শুরু করে। এরপর ‘হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি নীতিমালা ২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়। এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে-স্কুলগামী হিজড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে চারস্তরে উপবৃত্তি প্রদান। প্রাথমিক স্তরে জনপ্রতি মাসিক ৭০০, মাধ্যমিকে ৮০০, উচ্চমাধ্যমিকে ১০০০ এবং উচ্চস্তরে ১২০০ টাকা হারে, ৫০ বা তদূর্ধ্ব বয়সের অক্ষম ও অস্বচ্ছল হিজড়াদের জনপ্রতি মাসিক বিশেষভাতা ৬০০ টাকা করে প্রদান করাসহ বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম হিজড়া জনগোষ্ঠীর দক্ষতাবৃদ্ধি ও আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে তাদের সমাজের মূলস্রোতধারায় সম্পৃক্ত এবং প্রশিক্ষণোত্তর আর্থিক সহায়তা দশ হাজার টাকা প্রদান করা এ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে।

২০১২-২০১৩ অর্থবছর হতে পাইলট কর্মসূচি হিসেবে দেশের ৭টি জেলায় হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, পটুয়াখালী, খুলনা, বগুড়া এবং সিলেটে এ কর্মসূচি চালু করা হয় প্রথম। ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল বাহাত্তর লক্ষ সতের হাজার টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নতুন ১৪টি জেলাসহ মোট ২১টি জেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে ঢাকা, গাজীপুর, নেত্রকোণা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্ণীপুর, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, কুমিল্লা, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, সিলেট। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল চারকোটি সাতলক্ষ একত্রিশ হাজার ছয়শত টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ ছিল চারকোটি বাহাত্তর হাজার টাকা। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ৬৪ জেলায় এ কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৪ জেলায় বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ১১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। আর ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা। হিজড়া শিশুদের জন্য ২০১২-২০১৩, ২০১৪-২০১৫, ২০১৫-২০১৬, ২০১৬-২০১৭, ২০১৭-২০১৮, ২০১৮-২০১৯ ও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে শিক্ষা উপবৃত্তি বিতরণ করা হয়েছে যথাক্রমে ১৩৫, ৭৬২, ৭৮৯, ১৩২৯, ১৩৩০, ১৩৫০ ও ১২৪৭ টি।

সরকারি-বেসরকারি সহায়তাসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও স্বীকৃতির ফলে হয়তো তারা সামাজিক সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে, কিন্তু হিজড়াদের প্রতি সমাজের মানুষের জীবনবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না ঘটলে, সমাজের মূলধারায় তাদের সম্পৃক্ত করা কঠিন হবে। কাজেই আমরা যদি সকলে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ভেদাভেদহীনতার মূল্যবোধ ধারন করতে পারি, তবেই শুধু সম্ভব হবে হিজড়াদেরও সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করার। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা আমাদেরই একজন – আমরা ভুলে গেলে মানুষ হিসেবে আমরা আমাদের নিজেদেরও সম্মানিত করতে পারব না।

লেখক :
সিনিয়র তথ্য অফিসার
জেলা তথ্য অফিস, পিরোজপুর।

পিআইডি- শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম (৫ম পর্যায় প্রকল্প কার্যক্রম)


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: