সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:১৬ পূর্বাহ্ন

ভ্যাট আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ এনবিআর

নিউজ ডেস্ক :: করোনার মধ্যে মূল্যসংযোজন কর (ভ্যাট) আদায় বেড়েছে কিছুটা। অনলাইনে ভ্যাট পরিশোধের সুযোগ সৃষ্টিসহ নানান পদক্ষেপ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে আদায় করা ভ্যাটের ৮০ শতাংশই আসছে মাত্র ১০টি খাত থেকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পূর্ণাঙ্গভাবে ডিজিটালাইজেশন ও জনবল বাড়ানো না গেলে এ চিত্র বদলানো সম্ভব নয়। ভ্যাট ফাঁকি ঠেকাতে কৌশলগত পরিবর্তনের কথাও বলছেন তারা।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে এক লাখ ২৬৭ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। যার মধ্যে ভ্যাট থেকে আদায় হয়েছে ৩৬ হাজার ৬০৫ কোটির রাজস্ব। এ সময় ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪২ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে।

৮০ শতাংশ ভ্যাটই দিচ্ছে ১০ খাত

যে পরিমাণ ভ্যাট আদায় হচ্ছে, তার ৮১ শতাংশ সিগারেট এবং তামাকজাত পণ্যসহ ১০টি খাত থেকে এসেছে। অন্যান্য খাত থেকে এসেছে বাকি ১৯ শতাংশ। বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে সিগারেট ও তামাকজাত পণ্য থেকে আট হাজার ৮০০ কোটি টাকা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক (এসডি) এসেছে, যা ওই বছর সংগৃহীত মোট ভ্যাটের ৩০ শতাংশ। গত অর্থবছর ভ্যাট থেকে আদায় হয়েছিল ৯৭ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা।

মোবাইল ও এর পরিষেবা, প্রাকৃতিক গ্যাস, নির্মাণ, অগ্রিম ভ্যাট, সরবরাহকারী, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং পরিষেবা এবং খুচরা ও পাইকারি খাত থেকে এসেছিল বাকি ৫১ শতাংশ ভ্যাট।

তথ্য বলছে, ভ্যাট দেওয়া খাতের সংখ্যা বেড়েছে। তারপরও আদায় হচ্ছে না প্রত্যাশিত ভ্যাট। প্রতি বছর কী পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে, রাজস্ব বোর্ডের কাছে তার কোনো তথ্যও নেই।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ জাগো নিউজকে বলেন, ভ্যাট আদায়ের পুরো ব্যবস্থা ডিজিটাল না করা গেলে অনেক খাত থেকেই ভ্যাট আদায় করা সম্ভব হবে না। অটোমেশন না করা গেলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। ডাটা বা তথ্য যখন থাকবে, তখন ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া কঠিন হবে।

একই সঙ্গে ভ্যাট আদায় বাড়াতে খুচরা পর্যায়ে ব্যাপকহারে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল সিস্টেম বা ইএফডির ব্যবহার বাড়ানো ও রাজস্ব বোর্ডের লোকবল বাড়ানোর তাগিদ দেন সাবেক এনবিআরের এই চেয়ারম্যান।

ভ্যাটফাঁকি ঠেকাতে কিছু নীতিমালা দরকার বলে মনে করেন রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (ভ্যাট বাস্তবায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তি) আবদুল মান্নান শিকদার।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, কিছু খাতে ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব দেয় এনবিআর। তবে অনেকেই এর অপব্যবহার করেছে। ছোট ব্যবসার জন্য নীতিমালা প্রণয়নের চেষ্টা করছি। আমরা এমন ব্যবসা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি, যেগুলো ভ্যাট দেওয়ার যোগ্য কিন্তু এখনো নিবন্ধিত হয়নি।

ইএফডি যন্ত্রের বেহাল দশা

খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট আদায়ে ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিপণিবিতানে ইএফডি যন্ত্র বসানোর শুরু করে এনবিআর। গত বছরের জুলাইয়ের মধ্যে ১০ হাজার ও চলতি বছর আরও ১০ হাজার যন্ত্র বসানোর কথা ঘোষণায়ই সীমাবদ্ধ রেখেছে সংস্থাটি। গত আগস্ট পর্যন্ত মাত্র তিন হাজার ৩৯৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে ইএফডি বসিয়েছে এনবিআর।

রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দুই লাখ ৮৮ হাজার প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় নিবন্ধন বা ভ্যাট নিবন্ধন আছে। নতুন ভ্যাট আইন চালুর সময় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে ইএফডি বসানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে সম্প্রতি মেশিনটি সাড়ে ২০ হাজার টাকায় বিক্রির ঘোষণা দেয় এনবিআর। দাম বেশি হওয়ায় এ যন্ত্র খুচরা ব্যবসায়ীরা কিনতে আগ্রহী নন।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলালউদ্দিন বলেন, ইএফডি দোকানে বসানো হোক, তাতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। ভ্যাট দেবে জনগণ, আমরা পৌঁছে দেবো। কিন্তু কিছু দোকানে বিনামূল্যে দেবে, কিছু দোকানে দেবে না এটা তো ভালো জিনিস নয়। এখন আবার বেশি দামে ভ্যাট মেশিন কিনতে বলছে রাজস্ব বোর্ড।

ভ্যাট আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ এনবিআর

‘ব্যবসায়ীদের হয়রানি কমাতে উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যবসায়ীরা ভ্যাট দিতে ইচ্ছুক। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ঠুনকো অজুহাতে হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া বন্ধ করতে হবে।’

জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম জাগো নিউজকে বলেন, রিটেইল সেক্টর থেকে ভ্যাট সংগ্রহ করা, তা কোষাগারে জমা করা অনেক বড় সম্ভাবনার জায়গা। ইএফডির পাইলট প্রকল্প থেকে এ পর্যন্ত এটা সাকসেসফুলি রান (সফলভাবে পরিচালনা) করছে। আমরা চাচ্ছি এটাকে আরও এক্সপান্ড (ছড়িয়ে দিতে) করতে।

তিনি বলেন, ইএফডি কার্যকর হলেও আমরা লক্ষ্য করলাম এটা টেকসই হবে না। আগের বিভিন্ন পদক্ষেপের মতো এটা ইফেক্টিভ, ইফিশিয়েন্ট হলেও সাকসেসফুল হবে না। আমাদের চিন্তা, এটাকে কীভাবে টেকসই করা যায়। তাই এটার বিকল্প পথ চিন্তা করা হচ্ছে। সেটা হলো অনেক মেশিন রিটেইল সেক্টরে ছড়িয়ে দেবো। কিন্তু সেটা যেন হয় খুব সহজ সিস্টেমে। ইএফডিকে টেকসই করতে আমরা পরিকল্পনা করেছি, যা পুরো ব্যাপারটাকে টেকসই করতে পারবে।

ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর প্রস্তাব

শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম বা জেলাভিত্তিক না থেকে উপজেলা পর্যায়ে ভ্যাট আদায় বাড়াতে বলছেন ব্যবসায়ীরা।

জানতে চাইলে এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট মো. জসিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ভ্যাট অফিস স্থাপন করা জরুরি। ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন এবং রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জেলা চেম্বার ও খাতভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশনগুলোর সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করা প্রয়োজন। ভ্যাটের জন্য ঢাকায় এলটিইউ আরেকটি বাড়িয়ে দুটি এবং চট্টগ্রামে একটি এলটিইউ স্থাপন করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতা বাড়ানোর কাজ চলমান। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অফিস ও স্থাপন করা হবে।

‘বাস্তবতা হচ্ছে সবাই ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিতে চান। যে যে পর্যায়ে থাকেন না কেন, ফাঁকি দিতে চান। এই ফাঁকির জায়গাটা বন্ধ করা আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। আস্থার সংকট আছে, উভয়পক্ষের মধ্যেই এটা কমিয়ে সচেতন করে ভ্যাটের আওতা বাড়াতে চাই।’


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: