রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৩৮ অপরাহ্ন

নবজাতক ও শিশুদের সংক্রামক রোগঃ আমাদের করণীয়-ডা. মোহাম্মদ হাসান জাফরী

আইনগতভাবে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত একজন মানুষকে শিশু বলা হলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত আমরা শিশু হিসেবে বিবেচনা করি। আর জন্মের পর থেকে ২৮তম দিন পর্যন্ত শিশুকে আমরা নবজাতক বলে থাকি। নবজাতকসহ অন্যান্য শিশুদের সংক্রামক রোগ বিশেষভাবে পরিবারের জন্য দুশ্চিন্তাদায়ক। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের রোগ ও মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এদের তিন ভাগের একভাগ মারা যায় ডায়রিয়া রোগে, এক ভাগ ছয়টি প্রতিরোধযোগ্য সংক্রামক রোগে এবং বাকী এক ভাগ অন্যান্য রোগে। তাই সংক্রামক রোগসমূহ প্রতিরোধ করতে পারলে শিশুমৃত্যু অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। শিশুদের সংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শিশুদের যক্ষ্মা, পোলিও মাইলাইিটস, ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, নবজাতকের ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি জনিত রোগসমূহ, হাম, রুবেলা, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া ইত্যাদি।

যক্ষ্মা একটি মারাত্মক রোগ, যা মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। নবজাতক ও শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অপরিপক্ব থাকে বলে তাদের ক্ষেত্রে এ রোগ আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ট সংস্পর্শ, আক্রান্ত ব্যক্তির কাশি ও থুথুর মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। এ রোগে আক্রান্ত হলে অল্প অল্প জ্বর ও কাশি হয়, ক্ষুধা কমে যায়, শিশু দুর্বল হয়ে যায়, গ্রন্থি ফুলে যায়, পরে পেকে গিয়ে সে গ্রন্থি বগল বা ঘাড়ে ক্ষতের সৃষ্টি করে। অনেক দিন ধরে ধীরে ধীরে ওজন কমে যায়। যেকোনো হাড়ের জোড়া ফুলে যায় এবং অচল হয়ে যায়। মেরুদণ্ডে যক্ষ্মার ফলে মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যায় এবং ব্যাথা হয়। মস্তিষ্ক আক্রান্ত হলে তাকে টিবি মেনিনজাইটিস বলে, শিশুর মারাত্মক মাথা ব্যথা, অচেতনতা, ঘাড় শক্ত ও খিঁচুনি হয়। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না করলে আক্রান্ত শিশুর মৃত্যু হতে পারে এবং রোগ ছড়াতে পারে। জম্মের পরপরই যত শীঘ্র সম্ভব বিসিজি টিকা দিলে, তা শিশুর দেহে যক্ষ্মার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জন্মের পর পর বিসিজি দেয়া না হলে, শিশুর এক বৎসর বয়সের মধ্যেই এই টিকা গ্রহণ করা উচিত ।

পোলিও রোগটি বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া থেকে প্রায় বিলুপ্ত হলেও এ রোগের ব্যাপারে সকলের সচেতনতা খুবই প্রয়োজন, কারণ এটি শিশুদের ভাইরাসজনিত পঙ্গুত্বের জন্য দায়ী। আক্রান্ত শিশুর মল দ্বারা দূষিত পানি খেলে বা আক্রান্ত শিশুর সংস্পর্শে এলে এ রোগ হতে পারে। শুরুতে এ রোগে আক্রান্ত শিশুর সর্দি, কাশি এবং সামান্য জ্বর হয়। এরপর মাথা ব্যাথা করে, ঘাড় শক্ত হয়ে যায়, জ্বর থাকে, শিশুর হাত অথবা পা অবশ হয়ে যায়, শিশু দাঁড়াতে চায় না, উঁচু করে ধরলে আক্রান্ত পায়ের পাতা ঝুলে পড়ে, দাঁড়া করাতে চাইলে শিশু কান্নাকাটি করে এবং নড়াচড়া করতে পারে না, শিশুর আক্রান্ত অঙ্গ ক্রমশ দুর্বল হয় এবং পরে স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। শ্বাস প্রশ্বাসের পেশী অবশ হয়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে শিশু মারাও যেতে পারে। এক মাস পর তিন ডোজ এবং হামের টিকা দেওয়ার সময় আরো একবার অর্থাৎ মোট চার বার পোলিও টিকা শিশুর এক বছর বয়সের ভিতরে খাওয়ানো হলে তা শিশুর দেহে পোলিও রোগ প্রতিরোধ করে। প্রথম ডোজ দেয়ার সবচেয়ে ভালো সময় শিশুর ৬ সপ্তাহ বয়স।

ডিপথেরিয়া রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়ার নাম করাইনেব্যাকটেরিয়াম ডিপথেরি। ডিপথেরিয়া রোগাক্রান্ত শিশুর হাঁচি কাশির মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ঐ জীবাণু যখন সুস্থ শিশুর শরীরে প্রবেশ করে তখন এই রোগ দেখা দিতে পারে। শিশু খুব সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এ রোগে আক্রান্ত শিশু ঠিকমতো খায় না এবং খেলাধুলা করে না, শিশুর জ্বর, সর্দি ও কাশি দেখা দেয়, গলা ফুলে যায় এবং কণ্ঠনালী বা গলদেশের ভিতরে সাদা আস্তরণ পড়ে। পরবর্তীতে শিশু খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে, কণ্ঠনালীর গ্রন্থিগুলি খুব বেশী ফুলে যায়, কণ্ঠনালীতে ধূসর রং এর সুস্পষ্ট আস্তর পড়ে এবং আস্তরটি শ্বাসনালীতে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং শ্বাসকষ্টের সৃষ্টি করে। এ রোগ হৃদপিণ্ড এবং স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করতে পারে এবং শিশুর মৃত্যু ঘটাতে পারে। শিশুর জম্মের এক বৎসরের মধ্যে ২৮ দিন বা একমাস পর পর তিন ডোজ টিকা দিলে তা শিশুকে ডিপথেরিয়া থেকে রক্ষা করে। বাংলাদেশ সরকারের ইপিআই কর্মসূচিতে পেন্টা ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। প্রথম ডোজ টিকা দেয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হলো শিশুর ছয় সপ্তাহ বয়সে।

বড়ডেটলা পারটুসিস নামক ব্যাকটেরিয়া শিশুর হুপিংকাশির জন্য দায়ী। হুপিংকাশিতে আক্রান্ত শিশু হাঁচি কাশি দেওয়ার সময় বাতাসের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় এবং আক্রান্ত শিশুর সংস্পর্শেও এ রোগ ছড়ায়। ১ম সপ্তাহে আক্রান্ত শিশুর জ্বর হয়, নাক দিয়ে পানি পড়ে, চোখ মুখ লাল হয়ে যায়, কাশি দেখা দেয়। ২য় সপ্তাহে কাশি মারাত্মক আকার ধারণ করে । শিশু যখন কাশে, তখন তার খুব কষ্ট হয় এবং চোখ স্ফীত ও লাল হয়ে যায় । কাশির পর শিশু হুপ শব্দ করে শ্বাস নেয়। অনেক সময় বমিও হয়। ছয় মাসের কম বয়স্ক শিশু হুপ শব্দ ছাড়াও কাশতে পারে এবং বমি করতে পারে । যদি কাশি তিন সপ্তাহের বেশী সময় ধরে চলে, তাহলে হুপিংকাশি বলে অনুমান করা যেতে পারে। হুপিংকাশির ফলে শিশু দুর্বল হয়ে যায় এবং অপুষ্টিতে ভোগে । শিশুর নিউমোনিয়া হতে পারে শিশুর চোখে রক্ত জমাট বেঁধে অন্ধ হয়ে যেতে পারে । শিশুর মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে। শিশুর এক বছর বয়সের মধ্যে ২৮ দিন বা এক মাস অন্তর তিন ডোজ টিকা দিয়ে শিশুকে হুপিংকাশি থেকে রক্ষা করা যায়।

বাংলাদেশ সরকারের ইপিআই কর্মসূচিতে পেন্টা ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। ৬ মাস বয়সের মধ্যেই শিশু মারাত্মকভাবে হুপিংকাশিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে সে কারণে ৬ সপ্তাহ বয়স থেকেই এ টিকা দেয়া শুরু করা অত্যন্ত জরুরি।

ধনুষ্টংকার শিশু ও নারীদের একটি মারাত্মক রোগ। ও রোগের জীবাণূর নাম ক্লষ্ট্রিডিয়াম টিটানি। পশুর মলের মাধ্যমে নির্গত এই রোগের জীবাণু মাটির সাথে থাকে। এই রোগের জীবাণু কাটাস্থান দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। শিশুর জন্মের পর অপরিষ্কার জীবাণুযুক্ত ছুরি বা ব্লেড দিয়ে নাড়ী কাটলে বা নাড়ীতে গোবর বা ময়লা কাপড় ব্যবহার করলে নবজাতক শিশুর ধনুষ্টংকার রোগ হয়ে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত শিশু জন্মের ৩-২৮ দিনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং বুকের দুধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়, শিশুর মুখ ও চোয়াল শক্ত হয়ে যায় এবং জোরে কাঁদতে পারে না। শিশুর খিঁচুনি হয় এবং শরীর পেছনের দিকে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে যায়। নবজাতকের ধনুষ্টংকার শিশুমৃত্যুর একটি প্রধান কারণ। এ রোগের চিকিৎসা করা অত্যন্ত কষ্টকর। এ রোগে আক্রান্ত নবজাতক প্রায়ই মারা যায়। তাই প্রতিরোধই উত্তম। গর্ভবর্তী ও সন্তান ধারণক্ষম সকল মহিলাকে যথাশীঘ্র সম্ভব ৫ ডোজ টিটি টিকা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে দিয়ে নবজাতকের ধনুষ্টংকার রোধ করা যায়। এছাড়া নিরাপদ প্রসব ও নাভী কাটার জন্য জীবাণুমুক্ত ব্লেড ব্যবহার করতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকারের ইপিআই কর্মসূচিতে পেন্টা ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।

শিশুদের হাম একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা মিসেলস ভাইরাস দিয়ে হয়। হামে আক্রান্ত শিশুর কাছ থেকে এই রোগের জীবাণু বাতাসের মাধ্যমে সুস্থ শিশুর শরীরে প্রবেশ করে এবং হাম রোগ সৃষ্টি করে। এ রোগে আক্রান্ত শিশুর বেশি জ্বর, সর্দি, কাশি হয়। চোখ লাল হয়ে যায় এবং চোখ দিয়ে পানি পড়তে পারে। জ্বর কমে আসার পর মুখে এবং শরীরে লালচে দানা দেখা দেয়। হামের ফলে শিশু নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও পুষ্টিহীনতায় ভোগে। কান পাকা রোগ হতে পারে। শিশুর রাতকানা রোগ দেখা দিতে পারে, এমনকি চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। হামের নানা জটিলতার কারণে অনেক শিশু মারাও যায়। শিশুর ৯ মাস বয়স পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে তাকে এক ডোজ হামের টিকা দিলে সে হাম রোগের হাত থেকে রক্ষা পাবে। পুষ্টিহীন শিশুরা হামের পরে মারাত্নক রোগ পরবর্তী জটিলতার সম্মুখীন হয়। পুষ্টিহীন শিশুদের পুষ্টিকর পরিপূরক খাবার দিলে তা তাদেরকে হাম পরবর্তী অন্যান্য রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে।

বর্তমান বিশ্বে হেপাটাইটিস-বি একটি পরিচিত রোগ। মূলত বড়দের রোগ হলেও নবজাতক বা শিশুদের এ রোগ হতে পারে এবং জীবনে নানারকম জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। হেপাটাইটিস-বি লিভারের একটি মারাত্মক রোগ, যা হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়। এমনকি অনেক বছর পরও লিভারে মারাত্মক প্রদাহের সৃষ্টি হতে পারে। হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত রোগীর রক্ত এবং দেহ রসের মাধ্যমে ছড়ায়। জন্মের সময় নবজাতক তার মায়ের কাছ থেকে সংক্রমিত হতে পারে। মা যদি পূর্বে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত থাকে সেক্ষেত্রে শিশুটি যখন তার মায়ের রক্ত বা জরায়ু হতে নিঃসরিত রসের সংস্পর্শে আসে, তখনই সংক্রমিত হয়। বুকের দুধের মাধ্যমে এই ভাইরাস সংক্রমিত হয় না। খেলাধুলার সময় আঘাতের কারণে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত শিশু হতে রক্তের মাধ্যমে সুস্থ শিশুতে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে। ইনজেকশন দেবার সময় জীবাণুমুক্ত সরঞ্জামাদি ব্যবহার না করলে বা দূষিত রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে একজন হতে আরেকজন সংক্রমিত হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুদের মধ্যে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণ প্রতিফলিত হয় না। এছাড়া কিছুক্ষেত্রে শিশুর চামড়া, চোখ ও প্রস্রাব হলুদ হয়ে যায়, পেটে ব্যথা এবং সেই সাথে জ্বর হয়, ক্ষুধামন্দা এবং বমি বমি ভাব বা বমি হয়ে থাকে, মাংসপেশী এবং হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা হয়। হেপাটাইটিস-বি ছাড়াও অন্যান্য হেপাটাইটিস ভাইরাস, বিশেষত হেপাটাইটিস-এ ভাইরাস দ্বারাও শিশু আক্রান্ত হতে পারে। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুরাই ভবিষ্যতে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের দীর্ঘ মেয়াদী বাহক হওয়ার ক্ষেত্রে বেশী ঝুঁকিপূর্ণ এবং অন্যদের মাঝে ভাইরাস সংক্রমিত করে, যার ফলে লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের কারণে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের ইপিআই কর্মসূচিতে পেন্টা ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।

হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি এক ধরনের ব্যাকটিরিয়া, যা শিশুদের দেহে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটায়। এ রোগের জীবাণু রোগাক্রান্ত শিশুর হাঁচি কাশির মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। সুস্থ শিশু আক্রান্ত শিশুর সংস্পর্শে এলে এমনকি আক্রান্ত শিশুর ব্যবহৃত সামগ্রী যেমন তোয়ালে, খেলনা ইত্যাদি মাধ্যমে এ জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে এবং রোগের সৃষ্টি করে। সংক্রমণের মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাকটেরিয়াল ম্যানিনজাইটিস যা ব্যাকটেরিয়াজনিত মস্তিষ্কের সংক্রমণ এবং মারাত্মক নিউমোনিয়া। এছাড়া এ ব্যাকটেরিয়া রক্ত, অস্থি সন্ধি, হাড়, গলা, কান এবং হৃৎপিন্ডের আবরণের সংক্রমণ ঘটায়। সময়মত সঠিক চিকিৎসা না করলে আক্রান্ত শিশু প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সঠিক চিকিৎসার পরেও শিশু মৃত্যুবরণ করতে পারে। হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি রোগটি সাধারণত ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের হয়ে থাকলেও ৪ থেকে ১৮ মাসের শিশুরাই এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশী ঝূঁকিপূর্ণ। শিশুর জন্মের পর পর মায়ের দুধের মাধ্যমে এ রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জন্মালেও ২-৩ মাসের মধ্যে তা কমে যায়,তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে এ রোগের বিরুদ্ধে টিকা দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের ইপিআই কর্মসূচিতে পেন্টা ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।

এগুলো ছাড়াও শিশুদের নানারকম সংক্রামক ব্যাধি হতে পারে। যেমন নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, সাধারণ সর্দি-কাশি, চোখের প্রদাহ ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমান সময়ে বহুল আলোচিত ডেঙ্গু ও করোনা ও শিশুদের আক্রান্ত করতে পারে। শিশুদের সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে টিকার পাশাপাশি মা-বাবার সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নিউমোনিয়া, করোনা, ডেঙ্গু ইত্যাদি নিয়ে সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফিচার, জনসচেতনতামূলক বার্তা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়, এগুলো আরও প্রচার করতে হবে। এছাড়া শিশুর পুষ্টির দিকটাও খেয়াল রাখা জরুরি, যেন তার নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভালো থাকে। ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। যে শিশুর বয়স ছয় মাসের বেশি, তাদের বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার হিসেবে দেশীয় পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে, যাতে তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সুগঠিত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের আপামর জনগণের কাছে মাতৃদুগ্ধের প্রয়োজনীয়তা, নারী ও শিশু স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে জনগণকে বিশেষভাবে সচেতন করছে।

তাছাড়া সুস্থ শিশুকে আক্রান্ত শিশুর কাছ থেকে দুরে রাখতে হবে। হাঁচি-কাশি আক্রান্ত মানুষ এবং ধুলাবালি থেকে শিশুদের দূরে রাখতে হবে। সবসময় শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা চাই। বাসায় মুক্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে, কারণ বদ্ধ পরিবেশে নানা ধরণের সংক্রামক অসুখ হতে পারে। বাসা বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাইরে থেকে এসে হাত-মুখ সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এ অভ্যাসগুলো করোনা প্রতিরোধেও সহায়ক। এছাড়া খাবার খাওয়ার আগে অবশ্যই হাত ধুতে হবে। শীতকালে শিশুর গোসল, পান করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করা উচিত। বর্ষাকালে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশার কামড় থেকে শিশুকে রক্ষা করতে হবে। অপরিণত বা স্বল্প ওজনের শিশুরা পরবর্তীতে খুব সহজেই নানা রোগে আক্রান্ত হয় তাই গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শিশু অপরিণত বা স্বল্প ওজনের না হয়। আর যদি কোনো শিশু অপরিণত বয়সে জন্ম নেয়, তাহলে তাদের ব্যপারে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

বর্তমানে করোনা মহামারি প্রতিরোধে ১৮ বছর বা তদোর্ধ্ব বয়স্কদের টিকা প্রদান করা হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বিষয়টি তদারক করছেন। সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে কীভাবে শিশুদের এ টিকার আওতায় আনা যায়, তা নিয়ে সরকার আন্তরিকভাবে পর্যালোচনা করছেন। শুধু করোনাই নয়, শিশুদের সকল সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকার খুবই আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, মানুষকে প্রতিনিয়ত সচেতন করে যাচ্ছেন। সরকারই সব করে দিবে, বিষয়টি এমন নয়, আমাদের সাধারণ জনগণকেও সচেতন হতে হবে। আমরা সকলে মিলেমিশে কাজ করবো, সুস্থ সবল উন্নত জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবো, এটাই আমাদের কাম্য এবং অঙ্গীকার।
#
লেখকঃ চিকিৎসক।
পিআইডি- শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম (৫ম পর্যায়) প্রকল্প কার্যক্রম।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: