বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৫১ পূর্বাহ্ন

কভিড -১৯ পরবর্তী খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি ভাবনা ও করণীয় : ড. মোঃ মনিরুল ইসলাম

bty

বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ সামগ্রিক অর্থনীতিতে কৃষির উপখাতসমূহ যথা শস্য বা ফসল উপখাত, প্রাণী সম্পদ উপখাত, মৎস্য সম্পদ উপখাত বন সম্পদ উপখাত প্রত্যেকটিরই খাদ্য পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য গুরুত্ব অপরিসীম সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ,কৃষি বিজ্ঞানীদেরনব নব প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষকের ঘাম ঝরানো পরিশ্রম বেসরকারী খাতের কৃষিতে বিনিয়োগ সামগ্রিক কৃষির সফলতার অন্যতম কারণ বাংলাদেশ এখন দানাদার খাদশস্য উৎপাদনে স্বয়ংবর তাছাড়া ইতোমধ্যে ধান উৎপাদনে এক ধাপ এগিয়ে বিশ্বে ৩য় উৎপাদনকারী দেশ হিসাবে স্থান করে নিয়েছে তবে নানা ধরণের প্রাকৃতিক দূর্যোগ, খরাবন্যা, অতিবৃষ্টিঅনাবৃষ্টি, ঝড়জ্বলোচ্ছাস কৃষি উৎপাদনে বড় অন্তরায় উপরন্ত এবছর বিশ্বব্যাপী করোনার আঘাত দেশের কৃষির জন্য অশনীসংকেত হয়ে দাড়িয়েছে সামনের চ্যালেঞ্জ হলো নির্বিঘ্ন খাদ্য উৎপাদন সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, পণ্যের নায্যমূল্য পাশাপাশি সবার জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতকরণ কোভিড১৯ বা করোনার কারনেলক ডাউন ঘোষণা করায় খাদ্য উৎপাদনে ব্যাঘাত না ঘটলেও পরিবহণ সমস্যাও ক্রেতার অভাব উৎপাদিত পণ্য বিশেষ করেপোল্ট্রি, দুধ, ফলশাকসব্জি প্রতিটি পণ্য পরিবহণের জটিলতায় বাজারজাতকরণ সমস্যা, ক্রেতাশূণ্য বাজারেপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য হ্রাস এর কারণে উৎপাদিত ফসল কৃষকের গলায় ফাঁস হয়ে দাড়িয়েছে যদিও সরকারের তাৎক্ষনিক বিভিন্ন পদক্ষেপ বিশেষ করে কৃষি খাতে প্রণোদণা সুযোগ্য কৃষি মন্ত্রীর সার্বক্ষনিক মাঠ পর্যায়ে তদারকি ওসমস্যা চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে এসব সমস্যা সমাধানেদ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়েছে বোরো ধানের বাম্পার ফলন, সঠিক সময়ে ধান কাটা সম্পন্ন করার ফলে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা অনেকটাই সামাল দেয়া গেছে কিন্তু তার বিপরীতে হঠাৎ করে ঘুর্ণিঝড়আমফানের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অর্থকরী মৌসুমী ফল আম লিচুর ব্যাপক ক্ষতি (ক্ষেত্র বিশেষে ১০৭০ ভাগ) হয়ে গেল ফলে, এতে এককভাবে চাষীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নয়, এধরণের ক্ষয়ক্ষতিরফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উপর বিরাট চাপ সৃষ্টি হয়েছে তাই করোনা পরবর্তী সময়ে খাদ্য পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সরকারের অগ্রাধিকার এজেন্ডা চ্যালেঞ্জ

জীবন ধারণের জন্য যেমন খাদ্য অত্যাবশ্যক। আবার সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ, পুষ্টিমান সম্পন্ন সুষম খাবার গ্রহণ প্রয়োজন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বিষয়টি বেশ ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন পুষ্টিহীন জাতি মেধাশূণ্য, আর মেধাশূণ্য জাতি যে কোন দেশের জন্য বিরাট বোঝা। তাই ১৯৭৩ সানে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের পুষ্টিমান উন্নয়নে Bangladesh National Nutrition Council (BNNC) গঠন করেছিলেন। মাঝপথে এরকার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি সরকার গঠন করার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তা আবার পুনুরজ্জীবিত করেন

আমরা সকলেই জানি খাদ্যের প্রয়োজনীতা অনুযায়ী বিভিন্ন খাদ্যকে সাধারনতঃ তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছেঃ . শক্তিদায়ক খাবার, যেমন শর্করা বা কর্বোহাইড্রেট; যা আমরা ভাত, গম, ভুট্রা, আলু ইত্যাদি হতে পাই; . শরীর বৃদ্ধিকারক ক্ষয়পূরক খাবার, যেমন প্রোটিন বা আমিষ, যা আমরা ছোট মাছ, বড় মাছ, মাংস, দুধ ইত্যাদি হতে পাই . রোগপ্রতিরোধকারী খাবার, যেমন ভিটামিনস মিনারেলস, যা আমরা একমাত্র শাকসব্জি ফলমূল হতে পেয়ে থাকি (চিত্র ) সে প্রেক্ষিতে সমাজের সকল স্তরের মানুষের মাঝে পুষ্টিকর সুষম খাবার গ্রহণে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে পুষ্টি ইউনিট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলফুড প্লেট’ (চিত্র ) তৈরী করেছে যা অব্যাহতভাবে প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও) ডায়েটারি গাইডলাইনস অব বাংলাদেশের এর সুপারিশ অনুযায়ী একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ১০০ গ্রাম শাক, ২০০ গ্রাম অন্যান্য সব্জি ১০০ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। অথচ এখনও গড়ে দেশের মানুষ প্রতিদিন মাত্র ১২৫ গ্রাম সব্জি প্রায় ৮০ গ্রাম ফল খেয়ে থাকে (এফএও স্ট্যাট, ২০১২) অথচ, কর্মক্ষম সুস্থভাবে বাচাঁর জন্য ফল সব্জি প্রাত্যহিক খাবার তালিকায় অপরিহার্য। কেননা ফল শাকসবজিতে প্রচুর পরিমানে পানি, অত্যাবশকীয় ভিটামিন, মিনারেল, ডায়েটারী ফাইবার, ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট কিছুু পরিমান শর্করা বিদ্যমান


চিত্র : সুষম, পুষ্টিকর নিরাপদ খাবার জনসচেতনতা সৃষ্টিতে তৈরীকৃতফুড প্লেট

তাছাড়া, প্রতিদিন পরিমানমত শাকসবজিও ফল খাওয়ার ফলে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ যেমন: ক্যান্সার, হার্ট ডিজিস্, টাইপ ডায়াবেটিস, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব কমায়। শাকসব্জি হতে প্রাপ্ত ভিটামিন মিনারেল দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউনিটি) বৃদ্ধি করে, ফলে পরিমিত পরিমানে নিয়মিত ফর শাকসবজি খেলে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের যেমনি বছরে সুস্থ দিনের সংখ্যা বেড়ে যায়, তেমনি বাড়ে বাৎসরিক আয়

বলা অত্যাবশ্যক যে পটাশিয়াম মানবদেহের রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ করে; আঁশ শরীরের কোলেস্টেরলসহ অন্যান্য দূষিত পদার্থ শরীর থেকে বের করে আনতে সহায়তা করে রক্তের গ্লকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলেট শরীরের লোহিত রক্ত কণিকা (হিমোগ্লোবিন) তৈরী করে এবং শিশুদের জন্মগত ত্রুটি রোধ করে। ভিটামিন চোখের জ্যোতি মসৃন ত্বক এর জন্য অতি প্রয়োজনীয় কার্যকর। ভিটামিন বার্ধক্য রোধে, ভিটামিন সি শরীরের রক্তপাত রোধ, স্বাস্থ্যকর দাতের মাড়ি শরীরে অয়রণ শোষণে ভুমিকা রাখে

বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ। পাশাপাশি দেশের সার্বিক পুষ্টি পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটলেও বিরাট জনগোষ্ঠি এখনও অপুষ্টির শিকার। যা করোনা পরবর্তীতে আরও ব্যাপকতালাভ করতে পারে। অপুষ্টিজনিত সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো রক্তস্বল্পতা; যা মূলতঃ আয়রণ জনিত ঘাটতিকেই বুঝায়। প্রয়োজনীয় পরিমাণমত খাবার, বিশেষ করে আয়রণ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের স্বল্পতায় শিশু, কিশোরকিশোরী, গর্ভবতী প্রসুতি মায়েরা বেশী আক্রান্ত।
তাই কভিড পরবর্তী পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে কিছু পরিকল্পনার মাধ্যমে এগোতে হবে। ইতোমেেধ্য বিভিন্ন দেশের তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে অন্যান্য যত কারনই থাকুক না কেন? কোভিড প্রতিরোধে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের বেশী তাদের ক্ষেত্রে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভানা বেশ কম এবং অথবা কেউ আক্রান্ত হলেও তা জটিল আকার ধারণ করেনি বা করেনা। বিগত দশকে মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি, সর্বোপরি পেশাগত কর্মব্যস্ততার ফলে মানুষের খাদ্যাভাসের ব্যাপক পরিবর্তন গঠেছে। অনেকেরই ধারণা দামী খাবার ছাড়া পুষ্টি পাওয়া যায়না, যা সম্পূর্ণ ভুল। আমাদের দেশের কৃষি খুবই বৈচিত্র্যময়। প্রতিটি নানা জাতের প্রচলিতঅপ্রচলিত ফলসব্জি কোন না কোন ধরণের পুষ্টির আধার। বিশ্বের প্রায় ৮০ ভাগ খাবার এখন প্রক্রিয়াজাত, যা খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়। তবে এটা ঠিক প্রক্রিয়াজাত খাবার স্বাভাবিক কারণেই পুরোপুরি বাদ দেওয়াও অসম্ভব। তবে পরিমিত খাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়টি হলো, বর্তমানে প্রায় ৮০৯০ ভাগ ছেলেমেয়ে ফলসবজি খেতে চায়না বা খেতে অনীহা, এমনকি মাছও অনেকেরই অপছন্দ। সারা বিশ্বে ফাস্ট ফুড খাওয়ার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, স্থুলতা, ডায়াবেটিস, হার্ট এটাক, উচ্চ রক্তচাপ এর মতো অসংক্রামক রোগগুলো হু হু করে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশও এর ব্যাতিক্রম নয়। অপরদিকে অধিকতর পরিস্কারপরিচ্ছন্নথাকার অভ্যাসের ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছাড়াও এলার্জির মতো অসুখে ভোগা মানুষের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। সেজন্য সুষম পুষ্টিকর তথা বৈচিত্র্যময় খাবার খাওয়ার কোন বিকল্প নেই

সেজন্য পরিবার পর্যায়ে, স্কুলকলেজ, বিশ্বদ্যিালয়, মাদ্রাসা, এতিমখানা, মসজিদমন্দিরে পুষ্টিকর খাবার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর নিমিত্ত ব্যাপক কার্যকর কর্মসূচী বা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অন্যদিকে নিম্ন আয়েরও কর্মহীন মানুষদের কোভিড১৯ পরবর্তী পুষ্টির বিষয়টি সরকার কর্তৃক বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। নতুবা কর্মশক্তির ঘাটতি সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে তাই বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের জন্য বিভিন্ন প্রকার খাবার তালিকা বা মেন্যু নির্ধারণ করে প্রচার প্রচারণা চালানোসহ সচেতন করতে হবে। করোনা পরবর্তী নিম্ন আয়ের লোকদেরআপদকালীন সময়ে বা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পুষ্টি সুরক্ষায় কর্মক্ষম রাখতে দামে সস্তা, সহজলভ্য অথচ পুষ্টিগুনে ভরপুর এধরণের খাবার আমলে বা নির্বাচনে পরামর্শ প্রদান করতে হবে, যা থেকে সর্বোচ্চ পুষ্টি উপাদান পাওয়া যাবে। যেমনঃ
মেন্যু
পন্তা ভাত, ডাল ভর্তা, ডিম ভর্তা;

মেনু পন্তা ভাত, মিষ্টি আলুভর্তা, ডাল ভর্তা (সংগে টুকরো লেবু রাখতে পারলে ভাল, এতে আয়রণ শোষণ ভাল হবে)

এগুলো সস্তা, সহজলভ্য অথচ পুষ্টি সমৃদ্ধ (প্রয়োজনীয় শর্করা সহ পান্তা ভাত হতে প্রচুর পরিমান আয়রণ, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম পাওয়া যাবে এবং পান্তা ভাত হচ্ছে বি ভিটামিনের আধার (ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৫, বি৬, বি৯ বি১২ উল্লেখযোগ্য) গবেষণাগারে পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, ১০০ গ্রাম পান্তা ভাতে চালের প্রকারভেদে সাধারন ভাতের চেয়ে সর্বোচ্চ ৫৫.৮৩% আয়রন এবং ৪৯২% ক্যালসিয়াম বেশী পাওয়া যায়। তাছাড়া ভর্তায় ব্যবহৃত তেল, ডিম, পেঁয়াজ হতে প্রয়োজনীয় চর্বি, ফাইবার, ফলেট, জিংক, ভিটামিনডি, ভিটামিন, বি সহ অন্যান্য অণু পুষ্টি কণা মিলবে।ডাল হতে প্রয়োজনীয় প্রোটিনও মিলবে। এমনকি আপদকালীস সময়ে শাকসব্জি পাতে যোগ না করতে পারলেও প্রায় বেশীরভাগ প্রয়োজনীয় পরিমান শর্করা, প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ অণু পুষ্টি উপাদানসমূহ উল্লেখিত মেন্যু হতে পাওয়া যাবে। তাই দামী খাবার নয় প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষের জন্য খাদ্য নির্বাচনে সর্তকতা জরুরী

অপরদিকে মাননীয় প্রধাণমন্ত্রী যথার্থই ঘোষণা দিয়েছেন খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে এক ইঞ্চি জমিও পতিত রাখা যাবেনা। ঠিক তেমনিভাবে খাদ্য অপচয় পুষ্টি অপচয় রোধ করতে ভোক্তা সাধারণেরও কৌশলী বা সচেতনতা জরুরী। আমরা যা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করি যেন সর্বোচ্চ পুষ্টির ব্যবহার হয়, সেজন্য সচেষ্ট হতে হবে। অনেকেরই জানা নেই অনেক ফলসব্জির খোসাতে বেশী পরিমান পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। সেজন্য যেসব ফলসব্জি খোসাসহ খাওয়া যায় তা খোসা না ফেলে খেতে হবে বিভিন্ন ফলসব্জি যেমন আপেল, কলা, শসা, বেগুন, লাউ, কুমড়া, আলু পুষ্টিতে ভরপুর; তেমনি এসব স্বাস্থ্যকর ফল বা সবজির খোসাও অনেক উপকারী। এখন দেখে নেওয়া যাক উল্লেখযোগ্য ফলসব্জির খোসার পুষ্টি গুনাগুন

আপেলের খোসার গুনাগুন:
আপেলের অভ্যান্তরাংশের চেয়ে আপেলের খোসায় বা ছালে ফাইবারের পরিমান বেশী। ফাইবার বা আঁশ দীর্ঘ সময়ের জন্য পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে, এতে বারবার খাওয়ার প্রবণতা কমে ক্যালরিও কম খাওয়া হয় তাছাড়া ফাইবার হাড়, যকৃত সুস্থ রাখতে সাহায্য করে (কৃষি বিভাগ, ইউএসএ)এছাড়া আপেলের খোসায় কুয়েরসেটিন নামের একটি এন্টি অক্সিডেন্ট আছে, যা হৃদপিন্ড, ফুসফুস মস্তিস্কের জন্য খুবই উপকারী

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে আপেলের খোসায় থাকে প্রচুর পরিমানে পলিফেনল যেমনপেকটিন। এই পেকটিন হল এক ধরনের ফাইবার যা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। একই সঙ্গে পেকটিন রক্তে সুগার আর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতেও সাহায্য করে। আপেলের খোসায় ভিটামিন , সি এবং কে রয়েছে তাছাড়া পটাশিয়াম, ফসফরাস ক্যালসিয়ামের মতো অপরিহার্য খনিজও রয়েছে, যা শরীরের জন্য খুবই উপকারী

শসার খোসা :
শসার খোসায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান, পটাসিয়াম আর ভিটামিনকে। তাই শসার খোসা য়েলে না দিয়ে খোসাসহ খাওয়া বেশী উপকারী

লাউ বা কুমড়ার খোসা:
লাউয়ের খোসায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক, যা ত্বককে সতেজ রাখে। বাড়ায় ত্বকের উজ্জ্বলতাও। লাউয়ের খোসা আলাদা করে ভাজি হিসাবেও খাওয়া যায়

বেগুনের খোসা:
বেগুনের খোসায় রয়েছেনাসুনিননামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা অ্যান্টিএজিং সহায়ক। ছাড়াও বেগুনের খোসা ত্বককে সতেজ রেখে উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে

কলার খোসা :
কলার খোসায় রয়েছে লুটেন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা দৃষ্টিশক্তি ভাল রাখতে সাহায্য করে। কলার খোসায় থাকা ট্রিপটোফ্যান শরীরে সেরোটনিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। আর এই সেরোটনিন মন মেজাজ ভাল রাখতে সাহায্য করে

তরমুজের খোসা :
রসাল তরমুজের পুরু শক্ত খোসায়এল সাইট্রলিননামের অ্যামাইনো এসিড আছে। এই অ্যামাইনো এসিড শরীর চর্চা খেলাধুলায় দক্ষতা বাড়াতে এবং বিশেষতঃ মাংসপেশীর ব্যাথা কমাতে বা এর নমনীয়তা বাড়াতে সহায়তা করে। রক্ত থেকে নাইট্রোজেন দূর করতেও সহায়তা করে এইসাইট্রলিন’ (যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসডিএকৃষি গবেষণা সংস্থা ২০০৩)

আলুর খোসার গুণাগুন :
আলু এমন একটি সবজি যে কোন তরকারীতেই ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা আলুর খোসা ফেলে দেই। কিন্তু অনেকের ধারনা নেই যে আলুর খোসায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন আর পটাসিয়াম। এছাড়াও এতে রয়েছে ভিটামিন বি, সি এবং প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান।তাই সর্বোচ্চ পুষ্টি পেতে আলু খেতে হবে খোসাসহ।
প্রথম উপকারিতা : আলুর খোসায় প্রচুর পরিমানে পটাশিয়াম এবং মিনারেল রয়েছে। যা শরীরের রাসায়ানিক প্রক্রিয়াকে উন্নত করে। পটাশিয়াম আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে সচল রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপকারি। এক একটি আলুর খোসা থেকে আমরা ৬০০ গ্রাম পটাশিয়াম পেতে পারি। যা আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে

দ্বিতীয় উপকারিতা:
মানুষের প্রতিদিন অত্যন্ত পক্ষে ১৬ মিলিগ্রাম করে নিয়াসিন শরীরের জন্য প্রয়োজন।শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় এই নিয়াসিন সহজেই পাওয়া যেতে পারে আলুর খোসা থেকে। নিয়াসিন শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে

তৃতীয় উপকারিতা:
আলু থেকে আমরা প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল এবং কার্বোহাইড্রেট পাই। তেমনি আলুর খোসাতেও এসব উপাদান থাকে। তাই আলুর খোসা না ছাড়িয়ে খাওয়া হয়, তাহলে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল এবং কার্বোহাইড্রেট বেশি পরিমানে পাওয়া যাবে। এতে শরীর আরও শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধী হয়ে উঠবে।

চতুর্থ উপকারিতা :
আয়রন হল শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। আয়রণ দেহের রক্ত কণিকার স্বাভাবিক কার্যপ্রণালীকে সক্রিয় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক দিন ৫টি খোসা সহ আলু খেলে শরীরে মিলিগ্রাম লোহা বা আয়রন যোগান দিবে

পঞ্চম উপকারিতা:
যাদের হজমশক্তি দুর্বল তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে আলুর খোসা খাওয়া অত্যন্ত উপকারী। কারণ, আলুর খোসায় প্রচুর পরিমানে ফাইবার আছে। ফাইবার শরীরের হজমশক্তি বৃদ্ধি করে। আলুর খোসা গুরুপাক খাবারও সহজে হজম করতে সাহায্য করে

ষষ্ঠ উপকারিতা:
আলুর খোসায় প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকার ফলে হজমশক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি শরীরের অতিরিক্ত গ্লোকোজ শুষে নেয়। এতে আলুর খোসা শরীরের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রিত করতে সাহায্য করে যদিও ডায়াবেটিস রোগীদের আলু খেতে নিষেধ; তবে আলু যদি খোসা সমেত সিদ্ধ করে পানি ফেলে দিয়ে রান্না করা হয় বা খাওয়া হয় তাতে খুব একটা ক্ষতি হয় না

ফল পুষ্টি : রাসায়নিক প্রাকৃতিক দূর্যোগ
অন্যদিকে কোন গবেষণালব্ধ ফলাফল বা বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যউপাত্ত ব্যতিরকে কিছু গনমাধ্যম এক শ্রেণীর সংগঠন বা ব্যক্তি কর্তৃক দুধ, মৌসুমি ফল, শাকসব্জিসহ মাছে ফরমালিন ব্যবহারের নেতিবাচক প্রচারণার ফলে কিছু মানুষ শুধু ফল খাওয়াই ছেড়ে দেয়নি, চাষী পর্যায়ে আর্থিক ক্ষতিসহ রপ্তানী বাণিজ্যে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে। সেজণ্য জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে জানোনো যাচ্ছে আপনারা নির্ভয়ে ফল খান, দেশীবিদেশী ফল (যেমন : আম, কলা, আনারস, লিচু, আফেল, কমলা, মাল্টা ইত্যাদি) সংরক্ষণে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়না। তাছাড়া কীটনাশক নিয়েও ভ্রান্ত ধারণা আছে, আধুনিক কৃষিতে কীটনাশক ব্যবহার ব্যতীরকে চাষাবাদ কল্পনাতীত। কীটনাশক এর শুধূ ক্ষতিকর দিক নিয়েই বেশী আলোচনা করি, মনে রাখা দরকার কীটনাশক কিন্তু ফসলের অনেক ধরণের ক্ষতিকর ফাংগাসসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান বিনষ্ট করে খাদ্য নিরাপদ করার মাধ্যমে আমাদেরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। তাই নীরোগ সুস্থ থাকতে রোগপ্রতিরোধ খাবার হিসাবে ফলমুল, শাকসব্জির কোন বিকল্প নেই

আমে রাসায়নিকের ব্যবহার :
প্রতিটি আমের পরিপক্কতার একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। তবে, এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বিশ্ব জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তনশীল; তাই বছরভিত্তিক জলবায়ুর এরুপ আচরণগত বৈশিষ্ট্যের কারণে/প্রভাবে উপরে উল্লেখিত পরিপক্কতার সময় দিন আগে বা পরে হতে পারে। উল্লেখ্য যে আম একটি ক্লাইমেকট্রিক ফল অর্থাৎ গাছ থেকে আহরণ/পারার পর পাঁকে। তাই বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে সব আম গাছে পাকে এগুলোর চেয়ে পূর্ণ পরিপক্কতা লাভকারী আম সমূহ যদি দিন পূর্বে গাছ থেকে আহরণ করা হয় অপেক্ষাকৃত সেসব আম গাছে পাকা আমের চেয়ে অধিক মিষ্ট হয়, সাথে কোন প্রকার স্বাস্থ্য ঝুঁকিও নেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন অষ্ট্রেলিয়া. মিশর, ভারত, ফিলিপাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুদান, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র, সেনেগাল ইয়েমেন মরক্কো প্রভৃতি দেশ বিভিন্ন ফল পাকাতে ইথোফেন ব্যবহার করে থাকে। তবে তারা ইথিলিন বা রাইপেনিং চেম্বার ব্যবহার করে থাকে। আমাদের দেশেও ইথিলিন চেম্বার স্থাপন অতীব জরুরী সময়ের দাবী

বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রেও পরিপূর্ণ পাকা আম শিপমেন্ট করা প্রায় অসম্ভব। তবে বেশী অপরিপক্ক আম আহরণ করে বাজারজাত করা হলে জরিমানা করা যুক্তিযুক্ত; কিন্তু আম ধ্বংস করা কোনক্রমেই ঠিক নয়। কেননা অনেকে ক্ষেত্রেই পাকা আমের চেয়ে কাঁচা আম অধিকতর পুষ্টি সমৃদ্ধ

তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিপদ আসবেই, হয়তো এক এক সময় এক রুপে বা নানারুপে। দূর্যোগ মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়াই হলো সফলতা বা কৃতিত্ত্ব। যেমনঃ আম ঝড়ে পরবেই, কিন্তু এসব মোকাবেলায় যাতে কিছুটা হলে তাৎক্ষনিক ক্ষতি কাটানো যায় সেজন্য কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যেমন ফল বা আম উৎপাদন এলাকার চাষীসহ স্থানীয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নিয়মিত প্রত্রিয়াজাতকরণ (যেমন: আচার, আমসত্ত্ব, ম্যাংগোবার, মোরোব্বা তৈরী ইত্যাদি) বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া বিজ্ঞানীদের বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম বাড়াতে হবে

আমে ক্যালসিয়াম কার্বাইডের ব্যবহার
ইথোফেন যেমন ইথিলিন গ্যাস নির্গমন করে , কার্বাইড তেমনি এসিটিলিন গ্যাস নির্গমন করে এবং একইভাবে ফল পাকায়। তবে কার্বাইড মুলতঃ নিষিদ্ধ একটি রাসায়নিক। শিল্পকারখানায় ব্যবহারের জন্য সীমিত আকারে কার্বাইড আমদানি করা হয়।এনালাইটেকেল বা ল্যাবেরটরী গ্রেড কার্বইিড এর উচ্চ মুল্যের কারনে চোরাই পথে আসা ইনডাষ্ট্রিয়াল গ্রেড কার্বাইড আমে ব্যবহার করা হয় এবং এতে সামান্য পরিমানে ভারী ধাতু আর্সেনিক কিছু ফসফরাস থাকে। যেহেতু আর্সেনিক দেহের জন্য ক্ষতিকর বলে গন্য করা হয় সেজন্য মৌসুমের পূর্বে বাজারজাতকৃত আম ক্রয় করা অনুচিত। মার্চএপ্রিল সময়ে যে সমস্ত আম পাওয়া যায় তার শতভাগ কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়। সেজন্য রাসায়নিক মুক্ত(কার্বাইড) মুক্ত পাকা আম খেতে ২৫ মের পূর্বে ক্রয় পরিহার করতে হবেএবং সরকার কর্র্তৃক মার্চএপ্রিল মাসে কোন প্রকার আম যেন আমদানি না হয় সেজন্য উক্ত মাস এলসি বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে।কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম খেলে তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় মুখে ঘা ঠোট ফুলে যাওয়া, শরীরে চুলকানি, পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, পেপটিক আলসার, শ্বাসকষ্ট, মস্তিকে পানি জমা জনিত প্রদাহ, মাথা ঘোরা, ঘুম ঘুম ভাব, মহিলাদের বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে

ফলে ফরমালিনের ব্যবহার
প্রকৃতপক্ষে, ফরমালিন হচ্ছে অতি উদ্বায়ী অতি দ্রবণীয় একটি বর্ণহীন ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত রাসায়নিক। ফলমুল শাক সব্জি হচ্ছে ফাইবার অর্থাৎ আঁশ (Fibre) জাতীয় খাবার, তাই ফরমালিন ফল সংরক্ষণ বা পাঁকাতে কোন ভূমিকা রাখেনা ফলসব্জিতে খুবই সামান্য প্রোটিন থাকায় ফরমালিন প্রয়োগ করা হলে কোন বন্ডিং সৃষ্টি করেনা, তা উবে চলে যায়। তাছাড়া ফলমূলে প্রাকৃতিকভাবেই নির্দিষ্ট মাত্রায় ফরমালিন (৬০ মিলিগ্রাম/কেজি) বিদ্যমান থাকে। ইউরোপিয়ান ফুড সেফইট অথোরটি (EFSA)এর মতে একজন মানুষ দৈনিক ১০০ পিপিএম পর্যন্ত ফরমালিন কোন প্রকার স্বাস্থ্য ঝুঁকি ছাড়াই গ্রহণ করতে পারে।অপরদিকে বহুল ব্যবহৃত জেড৩০০ ফরমালডিহাইড মিটারটি ছিল প্রকৃতপক্ষে বাতাসে ফরমালডিহাইড পরিমাপক। যদিও ক্রটিপূর্ণ বা অনুপযুক্ত মিটারের মাধ্যমে ফরমালিন পরীক্ষা করে সে সময় হাজার হাজার টন আমসহ অন্যান্য ফল ধ্বংস করা হয়েছিল

ফল পাকানো এবং সংরক্ষণে ইথোফেনের ব্যবহার
ইথোফেন বিভিন্ন নামে পাওয়া যায়। তবে যে নামেই পাওয়া যাক না কেন এর মূল উপাদান হচ্ছে ক্লোরো ইথাইল ফসফনিক এসিড। তবে আমাদের দেশে রাইপেনিং চেম্বার বা ইথিলিন চেম্বার না থাকায় ফলে পাকাতে উক্ত রাসায়নিক ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে বা স্প্রে করে ব্যবহার করা হয়। ফলে দেখা যায় যে এক্ষেত্রে সমভাবে টমেটো, কলা, পেঁপে বা আম একই রং ধারন করেনা। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বে রাইপেনিং চেম্বার ব্যবহার করে ইথোপেন গ্যাস আকারে ব্যবহারের ফলে সেসব ফল পুরোপুরি একই রংয়ের বা জমজ ভাইবোনের মতো দেখতে মনে হয়। তবে পাকানোর পদ্ধতিগত পার্থক্য থাকলেও এতে কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই

ইথোফেন একটি বিশ্ব সমাদৃত বহুল ব্যবহৃত অত্যন্ত নিরাপদ রাসায়নিক. যা ফলে প্রাকৃতিক ভাবেই বিদ্যমান থাকে। সেজন্য, ফল পরিপক্কতা লাভের সময়ে বিভিন্ন ফলে সামান্য পরিমান ইথোফেন গ্যাস তৈরী হয়; ফলশ্রুতিতে ফলের অভ্যান্তরে বিদ্যমান অনেকগুলো জিন তড়িৎ সচল হয়। তখন ফলের রং পরিবর্তন, মিষ্টতা গঠনবিন্যাস (Texture) পরিবর্তন আসে এবং ফল পাকতে শুরু করে। কৃষকের মাঠ হতে সংগ্রহকৃত নমুনা. বাজারজাত পর্যায়ের নমুনা গবেষণাগারে বিভিন্ন মাত্রায় ইথোফেন (২৫০১০০০০ পিপিএম) সরাসরি স্প্রে করার পর সকল পরীক্ষায় দেখা গেছে যে ইথোফেন প্রয়োগের অব্যাহতি পর হতেই প্রয়োগকৃত ফলের দেহ থেকে তা দ্রুত বের হয়ে যায় এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যেই তা Codex Allimentary Commission (FAO/WHO) কর্তৃক মানব দেহের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ গ্রহনীয় মাত্রার (MRL ২পিপিএম ) বেশ নীচে চলে আসে। আরও উল্লেখ্য যে , শুধুমাত্র মানবদেহের জন্য নির্ধারিত গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা (MRL) ছাড়াও ADI(Acceptable Daily Intake) এর মাত্রার ওপরেও ইথোফেনের ক্ষতিকর প্রভাব নির্ভর করে। CODEX/FSSAI এর সুপারিশ মোতাবেক একজন মানুষ কোন প্রকার স্বাস্থ্য ঝুঁকি ছাড়া তার প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের বিপরীতে প্রতিদিন .০৫ পিপিএম গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ যদি একজন মানুষের ওজন ৬০ কেজি হয় তাহলে সে সর্বোচ্চ (৬০ x .০৫) পিপিএম ইথোফেন প্রতিদিন গ্রহণ করতে পারবে। উদাহরনস্বরুপ বলা যায়, যদি কোন ফলে প্রতি কেজিতে .৫০ পিপিএম ইথোফেন অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়, তাহলে কোন ব্যাক্তিকে নুন্যতম দৈনিক কেজি ফল খেতে হবে

আমদানীকৃত আপেল
অন্যান্য ফলের ন্যায় আপেলেও ফরমালিন ব্যবহার করা হয়না। তবে আমদানিকৃত আপেল দীর্ঘদিন সতেজ রাখার জন্য সাধারণত ফুড গ্রেড বা ইডিব্ল (তরল কঠিন) প্যারাফিন প্রয়োগ করা হয় কঠিন বা তরল প্যারাফিন যে কোন মাত্রায় খাদ্যের সাথে মানবদেহে প্রবেশ করলেও তা কোন ক্ষতিকর বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না বা হজম প্রক্রিয়ায় অর্র্ন্তভুক্ত হয় না, ফলে এটি সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত অবস্থায় পুনরায় শরীর হতে বেরিয়ে যায়। সুতরাং এসব মোমযুক্ত/প্যারাফিনযুক্ত আমদানিকৃত আপেল ভক্ষণ নিরাপদ। আরও উল্লেখ্য যে বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত নব নব উদ্ভাবনের মাধ্যমে শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পণ্যের মান বৃদ্ধি পঁচনকে দীর্ঘায়িত করার জন্য নব নব বিভিন্ন প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করে চলেছে। বর্তমানে প্যারাফিন ওযাক্সের পাশাপাশি কৃষিজ উপজাত যেমন : ফলমূলের খোসা, কান্ড, পাতা, গাছের প্রাকৃতিক নির্যাস ব্যবহার করে অত্যন্ত পাতলা অবরণ সমৃদ্ধ ফিল্ম তৈরী করে আপেল সহ অন্যন্য ফলের গায়ে ওয়াক্স হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এধরণের ওয়াক্স একদিকে যেমন ফলকে সতেজ রাখতে সাহায্য করছে তেমনি পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করছে

চিত্র : প্যারাফিন ওয়াক্স প্রলেপণ যুক্ত আপেল

হর্টিকালচার ক্রপস তথা ফলসব্জিতে ক্ষেত্রভেদে ৪০৯৮ ভাগ পানি বিদ্যমান থাকে। তাই ব্যাপকভাবে যাতে ওজন হ্রাস না হয়, সেজন্য ওয়াক্স ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য যে প্রকার/জাত ভেদেহরটিকালচার ক্রপএর ক্ষেত্রে প্রতিদিন ১০ গ্রাম ওজন কমে। তাছাড়া চকচকেতকতকে ভাব বজায়, ফাংগাস/ছত্রাক এর আক্রমন থেকে রক্ষা, দীর্ঘদিন সংরক্ষণ, কোল্ড ষ্টোরেজ সংরক্ষণকালীন সংবেদনশীলতা রোধ, আর্দ্রতার অপচয় রোধ অন্যান্য বাহ্যিক আঘাত রোধসহ রোগ সৃষ্টিকারী জীবানু রোধ করার জন্য ইডিব্ল প্যারাফিন ওয়াক্সবা ইডিপিল ব্যবহার করা হয়।আপেলে ব্যবহৃত ওয়াক্স একটি খাওয়ার যোগ্য মোম, এতে কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই

বাজারে প্রাপ্ত আঙ্গুর
বাজারে প্রাপ্ত আমদানীকৃত আঙ্গুর নিয়েও মানুষের মাঝে অস্থিরতা বিরাজমান। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আধুনিক কৃষি কৃষি পণ্য কীটনাশক প্রিজারভেটিবস ব্যবহার ছাড়া উৎপাদন, বাজারজাতকরণ সংরক্ষণ করা প্রায় অসম্ভব মানুষ জ্বরসর্দিকাশি বা জীবাণূ দ্বারা আক্রান্ত হলে যেমনি ঔষধ খাওয়ার প্রয়োজন হয়; তেমনি ফসলের পোঁকামাকড় দমন, ছত্রাকের আক্রমন রোধ নির্দিষ্ট সময়ান্তে সতেজ রাখার জন্য প্রিজারভেটিবস প্রয়োজন। আঙ্গুরে মূলতঃ ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা হয়; এর কার্যক্ষমতা বেশী সময় থাকেনা, খাওয়ার পূর্বে ভালভাবে ধুয়ে নিলে কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকিও থাকেনা। তাছাড়া শিপমেণ্টের পূর্বে সালফার ডাই অক্সাইড ব্যবহারে বাস্পশোধণ করা হয় পরিবহণের সময় কার্টুনে সালফার ডাই অক্সাইড প্যাড ব্যবহার করা হয়

অনেকেই আংগুরের গায়ে বা ত্বকের বাইরের অংশে সাদা পাউডার জাতীয় পদার্থ দেখে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে করে অজানা অস্বস্তিতে ভোগেন।প্রকৃতপক্ষে আংগুরের গায়ে সাদা পাউডার জাতীয় যে পদার্থ দেখা যায়, তা একেবারেই প্রাকৃতিক এবং তাওল্ড ডাস্ট’, ’ব্লম বা ব্লাস’, এসিডোফাইলাস (ব্যাকট্রেরিয়াম) নামে পরিচিত, যা একটি প্রাকৃতিক প্রলেপ।এটা আর্দ্রতা রোধসহ আংগুরকে পঁচন পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করে তাছাড়া মদ তৈরীর প্রাথমিক পর্যায়ে ফারমেন্টশেন সহায়তা করে। এধরনের ব্লম পাম জাতীয় ফলেও দেখা যায়

সব্জিতে কীটনাশক এর ব্যবহার
একদিকে আমাদের দেশে দিনদিন কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে, অপরদিকে জনসংখ্যার চাপ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে বহুমাত্রায় বেড়েছে শাকসব্জির চাহিদা। আবার চাহিদা বৃদ্ধির সাথে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে শাকসবজির ফলন বাড়াতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে নানাবিধ কীটনাশক। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার একদিকে পরিবেশের অনেক প্রয়োজনীয় কীটপতঙ্গ ধ্বংস করে পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে, ঠিক তেমনি কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ মানুষের দেহে প্রবেশের মাধ্যমে মানবদেহের বিভিন্ন ক্ষতিসাধন করছে বলে জনমনে এক ধরণের আতঙ্ক বিরাজ করছে।
গবেষণা ফলাফলে দেখা যায় যে, বিভিন্ন সব্জি উৎপাদন এর ক্ষেত্রে প্রয়োগকৃত বালাইনাশক এর বিষক্রিয়া বিষয়ে অহেতুক আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফসলে প্রয়োগকৃত বিভিন্ন কীটনাশক/বালাইনাশক/ছত্রাকনাশক সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। দেখা গেছে যে, সব্জি ভালভাবে ধৌত করলে গড়ে ১০০০ সেঃ তাপমাত্রায় রান্না করা হলে / টি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশীরভাগ কীটনাশকের মাত্রা সহনীয় মাত্রার মধ্যে চলে আসে বা কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ সম্পূর্ণভাবে দূরীভুত হয়। তবে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার বা গ্রহণের পূর্বে ভোক্তাদের অবশ্যই সর্তকর্তা অবলম্বন করতে হবে যেমন :
. বেশীরভাগ কীটনাশক পানিতে দ্রবনীয়, তাই রান্নার পূর্বে চলমান বা প্রবাহমান পানিতে এবং অথবা পানি কয়েকবার অদলবদল করে শাকসব্জি ধৌত করে নিতে হবে ;
. যে সমস্ত ফল/সব্জি ফাংগাস বা ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত তা ক্রয় করা থেকে বিরত থাকতে হবে বা বা ফেলে দিতে হবে; তাছাড়া রাসায়নিকের তীব্রতা রোধে পাতা জাতীয় সব্জির বাইরের পাতা ফেলে দিতে হবে। যেমন : বাঁধাকপি, লেটুস ইত্যাদি;
. অধিকতর সতর্কতা স্বরূপ বাজার বা বাগান হতে সংগ্রহকৃত যে কোন সব্জি বা ফসল ইত্যাদি খাদ্য হিসেবে গ্রহণের পূর্বে সম্ভব হলে বাজার হতে ফল/সবজি ক্রয়ের পর দিন সাধারন তাপমাত্রায় খোলা জায়গায় রেখে দিয়ে অতঃপর খেতে হবে।
. বেশীরভাগ কীটনাশক জটিল যৌগের সংমিশ্রণ, ফলে উচ্চ তাপে স্থায়ী হয়না; সেজন্য কীটনাশক ঝুঁকি এড়াতে ১০০০ সেন্টিগ্রেড বা এর উপরের তাপমাত্রায় রান্না করা নিশ্চিত করতে হবে

শেষ কথা
প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। অতীতে যেমনি প্রতিটি দূর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সক্ষমতা দেখিয়েছে। তাই এবারও নিঃসন্দেহে বলা যায়, কৃষি প্রিয় মাননীয় প্রধাণমন্ত্রীর দিক নির্দেশনায় সমযের সাহসী যোদ্ধা সুযোগ্য কৃষি মন্ত্রীর সার্বিক তত্ত্বাবাধানের কৃষি আবার প্রাণ ফিরে পাবে। ইতোমধ্যে মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর সার্বক্ষণিক তদারকি সময়মত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে হাওর এর ধান কাটা সহ অন্যান্য বিষয়গুলো দ্রত সমাধান সম্ভব হয়েছে। আশা করা যায়, কৃষকদের সময়মত সার, বীজ প্রণোদণা যথাসময়ে যথাযথভাবেকৃষকদের কাছে পৌঁছানো গেলে দেশেরকৃষি কৃষক আবার ঘুরে দাড়াবে দেশের অর্থনীতিসহ খাদ্য পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। ব্যাপারে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ

লেখক : . মোঃ মনিরুল ইসলাম
পরিচালক (পুষ্টি)
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: