বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৫৬ অপরাহ্ন

বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত পোল্ট্রি ফিডের গুনগতমান ও স্বাস্থ্য ঝুকি : ড. মোঃ মনিরুল ইসলাম

কৃষি হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির মুল চালিকা শক্তি। আর পোল্ট্রি শিল্প কৃষি খাতের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনায় একটি উপখাত। বর্তমানে পোল্ট্রি শিল্পে বিনিয়োগের পরিমান প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশী। আর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ শিল্পে নিয়োজিত ৬০ লাখেরও অধিক মানুষ। দেশের প্রয়োজনীয় প্রাণীজ আমিষের ৪০ ভাগ আসে প্রানীজ উৎস অর্থাৎ পশু-পাখি থেকে; বাকী ৬০ ভাগ আসে আভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ থেকে। আবার পশু-পাখি থেকে আসা মোট প্রাণীজ আমিষের এক তৃতীয়াংশ আসে পোল্ট্রি থেকে। দেশে বর্তমানে পোল্ট্রির সংখ্যা কম-বেশী প্রায় ৩১ কোটি, এর ৪০ ভাগ হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশে গ্রামীণ চড়ে খাওয়া পাখি। আর বাকি ৬০ ভাগই হলো নিয়ন্ত্রিত অর্থাৎ নিবিড় ও আধা নিবিড় পদ্ধতিতে প্রতিপালিত খামারের পাখি।

অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও খাদ্য হিসাবে পোল্ট্রির চাহিদা দিনদিন বেড়েই চলেছে। কারন গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ প্রভৃতি হতে প্রাপ্ত লাল মাংসে অপেক্ষাকৃত ক্যালরি ও চর্বির মাত্রা অনেক বেশী। পাশাপাশি পোল্ট্রির চেয়ে দামও অনেক বেশী। প্রতি ১০০ গ্রাম গরুর মাংসে ক্যালরি পাওয়া যায় ১৮০-২১৭; ছাগলে ২৯৪; ভেড়ায় ২৫৮; ও মহিষে ১৪০ । আর প্রতি ১০০ গ্রাম গরুর মাংসে চর্বি থাকে ১৪-১৬ গ্রাম; খাসিতে ২১ গ্রাম; ভেড়ায় ১৭-২১ গ্রাম; ও মহিষে ৭.২ গ্রাম। অন্যদিকে প্রতি ১০০ গ্রাম মুরগীর মাংসে ১২১ গ্রাম ক্যালরি ও চর্বি থাকে মাত্র ৪ গ্রাম। এমনকি মাছেও ক্যালরি ও চর্বি কম, কিন্তু মাছের দামও পোল্ট্রির চেয়ে বেশী। সারা বিশ্বে মানুষ এখন সাদা মাংসের দিকে ঝুঁকছে।

উল্লেখ্য যে, মাংসে মায়োগ্লোবিন নামক এক ধরণের প্রোটিন থাকে এবং মুলতঃ মায়োগ্লোবিনের উপর ভিত্তি করে মাংসকে দু’শ্রেণীতে ভাগ করা হয় : রেড মিট ও হোয়াইট মিট । সাধারনতঃ যেসব মাংসের মায়োগ্লোবিন বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে লাল অক্স্যিহিমোগ্লোবিন তৈরী করে থাকে, এদের মাংস লালচে বর্ণ ধারণ করে। তাই এদের রেড মিট বলা হয়। গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ অর্থাৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীর সব মাংসই রেড মিট শ্রেণীর অর্ন্তভূক্ত অন্যদিকে মুরগীর মাংস হচ্ছে হোয়াইট মিট।

এটা অনস্বীকার্য, সারা বিশ্বে এনটিবায়োটিক ও হরমোন মুক্ত পোল্ট্রি উৎপাদন বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ; বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও উৎপাদিত পোল্ট্রির মাত্র ৫০% এর অধিক এন্টিবায়োটিক ও হরমোন মুক্ত (April 2019, National Chicken Council, USA)। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, পোল্ট্রিতে এন্টিবায়োটিক পাওয়া গেলেই সেটাকে অনিরাপদ বলা যুক্তিযুক্ত হবে না। কেননা প্রতিটি এন্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে মানব দেহের জন্য গ্রহণীয় সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। পাশাপাশি পোল্ট্রির জন্য অননুমোদিত কোন প্রকার এন্টিবায়োটিক বা হরমোনের ব্যবহারও গ্রহণযোগ্য হবেনা।

বর্তমান সরকার যেমনি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, ঠিক একইভাবে সবার জন্য পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাবার নিশ্চিতকরণে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে পোল্ট্রি ফিডে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও মুরগীর মৃত্যুর হার কমানো, পাখির দ্রুত বৃদ্ধি ও অধিক মুনাফা লাভের আশায় গুটিকয়েক কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এন্টিবায়োটিক ও গ্রোথ হরমোন খাবারের সাথে মিশিয়ে পোল্ট্রি ফিড বাজারজাত করে যাচ্ছে। অন্যদিকে খাবারে ভারী ধাতু বা হেভি মেটাল মেশানো হয়না, ভারী ধাতু সাধারনতঃ মাটি, পানি ও পরিবেশে থাকে, ফলে সহজেই খাবারে মিশে যায়। উন্নত বিশ্বেও পুরোপুরি হেভি মেটাল দূর করা প্রায় অসম্ভব। আবার ট্যানারি বর্জ্য দিয়ে পোল্ট্রি খাবার তৈরী করা নিয়ে আছে নানামত। তবে গবেষণা জরীপে দেখা গেছে যে, মোট পোল্ট্রি ফিডের কম বেশী ১ ভাগ পশু খাদ্যে ট্যানারীর বর্জ্য মেশানো হয়। তাছাড়া ট্যানারি প্রক্রিয়াজাতে মূলতঃ বেসিক ক্রোমিয়াম/ক্রোমিয়াম-৩ ব্যবহৃত হয়, মানব দেহের জন্য ক্রোমিয়াম-৬ অধিকতর ক্ষতিকর। তবে গবেষণায় কোন কোন নমুনায় ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া গেলেও তা মানব দেহের জন্য নির্ধারিত সহনীয় মাত্রার অনেক নীচে ।

একইভাবে পশু বা মুরগীর খাবারে লিড ও ক্রোমিয়াম এর ন্যায় কিছু কিছু নমুনায় আর্সেনিক এর উপস্থিতি নিয়ে উৎকন্ঠিত। বিশ্লেষণকৃত পোল্ট্রি ফিডের ২টি নমুনায় অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য যে প্রকৃতিতে আর্সেনিক জৈব (Organic) ও অজৈব (Inorganic) অবস্থায় থাকে। তবে মনে রাখা দরকার পশু খাদ্যসহ অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীতে আর্সেনিক পাওয়া গেলেও তার ৯৮%-ই হচ্ছে জৈব আর্সেনিক, শুধুমাত্র অজৈব আর্সেনিক হচ্ছে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর।

এন্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স
রোগ সারাতে বা মানবদেহেরে সংক্রমন রোধে মূলতঃ এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। তবে প্রয়োজন ব্যতীরকে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে বা খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে এর রেসিডিউ দেহে প্রবেশ করলে মানবদেহে এন্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স তৈরি হয়। ফলে পরবর্তীতে এসব এন্টিবায়োটিক দেহের নির্দিষ্ট রোগ সৃষ্টিকারী জীবানু ধ্বংস করতে পারে না, যার ফলশ্রুতিতে স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্ভাবনা বাড়ে। তাছাড়া মেডিকেল বর্জ্য, পারিবারিক অব্যবহৃত বা মেয়াদোত্তীর্ণ এন্টিবায়োটিক অনেক সময় দেখা যায় কোন নিয়ম নীতি না মেনে যথেচ্ছভাবে যেখানে সেখানে ফেলা হয়, যা পরবর্তীতে পরিবেশ ঘুরে মানুষের খাবারে অবশিষ্টাংশ হিসাবে আসতে পারে। সেজন্য এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানো জরুরী ।

পোল্ট্রি শিল্পে বিশ্বে সবচেয়ে কম এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করে ডেনমার্ক, হলান্ডে সহনীয় পর্যায়ে, আর সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হয় স্পেনে। হলান্ড পোল্ট্রি উৎপাদনে শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম। হলান্ডের বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে শুধুমাত্র বায়োসিকিউরিটির নিয়মকানুনগুলো অনুসরন নয়, এন্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যিান্স রোধে কিছুু পদক্ষেপ জরুরী, বিশেষ করে ধীর গতিতে উৎপাদন, খামাওে মুরগীকে খাওয়ানোর জন্য ব্যবহৃত পানির বিশুদ্ধতা নিশ্চিতকরণ।

তাছাড়া, বিশ্বখ্যাত জার্নাল ’ন্যাচার’ এ প্রকাশিত অতি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে আইব্রোফেন (বাত/ব্যথাানাশক) জাতীয় ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহারও এন্টিবায়োটিক সংবেদনশীলতা বা রেসিস্ট্যান্স সৃষ্টির একটি অন্যতম কারণ। তাই ভোক্তাদের উচিত হবে প্রয়োজন ব্যতীরকে এন্টিবায়োটিকসহ আ্ইব্রোফেন জাতীয় ওষুধ ব্যবহারে অধিকতর সাবধনতা অবলম্বন করা। খাবারের মাধ্যমে দেহে এন্টিবায়োটিক অবশিষ্টাংশ শোষণ যাতে না হয় সেজন্য পোল্ট্রি গ্রহণের সময় উচ্চ আশঁ জাতীয় খাবার যেমন: ব্রাউন রাইস/ব্রেড, বাদাম, বীজ, মটরশুটি, ব্রকলি, ডাল, কলা ইত্যাদি বেশী করে গ্রহণ করা । কারণ খাবারে বিদ্যমান এসব আঁশ অন্ত্রে স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করে ও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি কমায়। ফলস্বরুপ, আঁশ জাতীয় খাবার এন্টিবায়োটিক শোষণে বাধা দেয়।

বর্তমানে চাহিদা বাড়ায় বিকাশ ঘটছে পোল্ট্রি ফিড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের। নিয়মিত মনিটরিং, সচেতনতার অভাব এবং কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফালোভী হওয়ায় পোল্ট্রি ফিডের মান নিয়ে জনমনে দেখা যায় সংশয়। বিভিন্ন সময়ের গবেষণা থেকে মিলেছে এর সত্যতাও। সে প্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বিবেচনায় পুষ্টি ইউনিট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল কর্তৃক দেশের বিভিন্ন স্থান হতে পোল্ট্রি শিল্পে ব্যবহৃত বানিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ও বাজারজাতকৃত মোট ৮টি ব্রান্ড ব্রয়লার ফিড, ৮টি ব্রান্ড লেয়ার ফিড ও বাজারে প্রাপ্ত ৩টি হাউজ ফিড সংগ্রহ করতঃ এন্টিবায়োটিক অবশিষ্টাংশ, ভারী ধাতুর উপস্থিতি ও পুষ্টিমানের পরিমানগত ও গুনগত মান বিশ্লেষণ করা হয়। উল্লেখ্য যে সংগ্রহকৃত এসব নমুনাসমূহের রাসায়নিক বিশ্লেষণ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এক্রিডেটেড ল্যাবোরেটরী হতে সম্পন্ন করা হয়।

পোল্ট্রি ফিডের বিশ্লেষণকৃত প্যারামিটার সমূহ
মোট ৫ ধরনের এন্টিবায়োটিক যেমন : Lincomycine,Chlortetracycline, ৪ Epichlortetracycline,Oxytetracycline ও ৪ Epioxytetracycline; ৩ ধরণের হেভি মেটাল যেমন: লিড, ক্রোমিয়াম ও আর্সেনিক এর অবশিষ্টাংশসহ ফিডে আমিষের পরিমান ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যথা: ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস এর পরিমানগত ও গুনগত মান পরীক্ষা করা হয়।

টেবিল ১ : ব্রয়লার (গ্রোয়ার) ফিডের এন্টিবায়োটিক, হেভি মেটাল অবশিষ্টাংশ ও পুষ্টিমানের তুলনামূলক চিত্র

টেবিল-১ এ প্রদর্শিত ব্রয়লার ফিডের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় যে মোট ৮টি ব্রান্ডের ফিডের মধ্যে ৫টি ফিডের নমুনায় সর্বনিম্ন প্রতি কেজিতে ১০.৮ মাইক্রোগ্রাম ও সর্বোচ্চ ১১৫৩৬ মাইক্রোগ্রাম এন্টিবায়োটিক রেসিউিউ বা অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি রয়েছে, অর্থাৎ প্রায় ৬২.৫ ভাগ ফিড এন্টিবায়োটিকযুক্ত। তবে নমুনাসমূহে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া গেলেও কেবলমাত্র ২টি কোম্পানির ফিডে সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার উপরে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে বিশ্লেণষণকৃত ফিডের নমুনা-২ এ ChlortetracyclineI ৪ – Epichlortetracycline প্রতি কেজিতে যথাক্রমে ৫০৬৬.৯ ও ২৬০৮.৭ মাইক্রোগ্রাম এবং নমুনা-৭ Oxytetracycline ও 4 Epioxytetracycline প্রতি কেজিতে যথাক্রমে ৩৮৬১ ও ১১৫৩৭ মাইক্রোম অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায় (টেবিল-১)।

অন্যদিকে বিশ্লেষণকৃত ব্রয়লার ফিডের মোট ৮টি নমুনার মধ্যে ৭টিতে প্রতি কেজিতে সর্বনিম্ন ০.০৯ ও সর্বোচ্চ ১.০৯ মিলিগ্রাম লিড এর উপস্থিতি পাওয়া যায় । বিশ্লেষণকৃত ফিডসমূহের মধ্যে মোট ৩টি কোম্পানির (নমুনা-৩ (গ্রোয়ার) ; নমুনা-৪ (ফিনিসার) ও নমুনা-৬ (গ্রোয়ার) ফিডে যথাক্রমে ১.০৯, ০.৫৯ ও ০.৮৮ মিলিগ্রাম/কেজি পাওযা যায়, যা মানব দেহের জন্য সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা (০.৫ মিলিগ্রাম/কেজি) অপেক্ষা বেশি। অন্যদিকে বিশ্লেষণকৃত ৮টি ফিডের সবগুলো নমুনায় ক্রোমিয়াম এর উপস্থিতি থাকলেও তা ছিল সহনীয় মাত্রার নীচে। আর আর্সেনিকের উপস্থিতি সকল নমুনায় পাওয়া গেলেও শুধুমাত্র নমুনা-১ (গ্রোয়ার) (১৯.৬৩ মিলিগ্রাম ) ও নমুনা-৬ (গ্রোয়ার) (১১.৮৩ মিলিগ্রাম ) এর নমুনায় মানবদেহের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার উপরে পাওয়া যায়।

ব্রয়লার ফিডে প্রোটিনসহ অন্যান্য মাইক্রোনিউট্রেন্ট এর পরিমান মোটামুটি আদর্শ মাত্রার মধ্যেই পাওয়া যায় (টেবিল-১) ।

পাদপংক্তিঃ
ড় বাজারে প্রাপ্ত ৮টি ব্রান্ডের ব্রয়লার মুরগীর খাদ্য পরীক্ষা করে তন্মধ্যে ২টি কোম্পানির ফিডেযতাক্রমে নমুনা ২ ও নমুনা-৭ ফিডে এন্টিবায়োটিক রেসিডিউ বা অবশিষ্টাংশ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার উপরে পাওয়া যায়। নমুনা-২ এর ফিডে Chlortetracycline ও 4 Epichlortetracycline প্রতি কেজিতে যথাক্রমে ৫০৬৬.৯ও ২৬০৮.৭ মাইক্রোগ্রাম এবং নমুনা-৭-ও ফিডে Oxytetracycline ও 4 Epioxytetracycline প্রতি কেজিতে যথাক্রমে ৩৮৬১ ও ১১৫৩৭ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া যায় (টেবিল -১)।
ড় পশু বা মুরগীর খাবারে আর্সেনিক, লিড/সীসা ও ক্রোমিয়াম এর উপস্থিতি নিয়ে জনমনে উৎকন্ঠা প্রবল। প্রকৃতিতে আর্সেনিক জৈব (Organic) ও অজৈব (Inorganic) অবস্থায় থাকে। তবে পশু খাদ্যসহ অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীতে আর্সেনিক পাওয়া গেলেও তার ৯৮%-ই হচ্ছে জৈব আর্সেনিক, শুধুমাত্র অজৈব আর্সেনিক হচ্ছে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর।

  • তাছাড়া শিল্প কারখানার বিস্তৃতি, প্রক্রিয়াজাত কারখানায় ইটিপি না থাকায় আর্সেনিক ছাড়া ও অন্যান্য হেভি মেটাল/ভারী ধাতু যেমন সীসা, ক্রোমিয়াম প্রাকৃতিকভাবেই মাটি ও পানিতে স্থিত হয় বা পাওয়া যায়, যেটা উন্নত বিশ্বেও সম্পূর্ণভাবে রোধ করা অসম্ভব।
  • সকল নমুনায় প্রাপ্ত ক্রোমিয়াম এর অবশিষ্টাংশ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার মধ্যেই পাওয়া যায়।

টেবিল ২ : হাউজ ফিড (ব্রয়লার) এর এন্টিবায়োটিক, হেভি মেটাল অবশিষ্টাংশ ও পুষ্টিমানের তুলনামূলক চিত্র

হাউজ ফিড (ব্রয়লার) এর ক্ষেত্রে মোট ৩টি কোম্পানির (নমুনা-১, ২ ও ৩ ) উৎপাদিত ও বাজারজাতকৃত ফিডের নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়। ফলাফল বিশ্লেষণে কোন নমুনাতেই এন্টিবায়োটিক রেসিডিউ বা অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি (টেবিল – ২)।

বিশ্লেষণকৃত ব্রয়লার হাউস ফিডের সবগুলো নমুনায় কোন না কোন মাত্রায় লিড, ক্রোমিয়াম ও আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তবে শুধুমাত্র ২টি কোম্পানির (নমুনা-১ ও ৩) বিশ্লেষণকৃত ফিডে যথাক্রমে প্রতি কেজিতে ৩.৩২ ও ১১.৭৬ মিলিগ্রাম/কেজি লিড এর উপস্থিতি সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার উপরে (০.৫ মিলিগ্রাম/কেজি) পরলিক্ষিত হয় (টেবিল – ২)।

অপরদিকে, নমুনা-৩ এর ফিডে ক্রোমিয়ামের মাত্রা ছিল ৩২.৭১ মিগ্রা:/কেজি, যা মানব দেহের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার (২০-৩০ মলিগ্রাম/কেজি) সামান্য উপরে । তবে কোন কোন দেশে প্রতি কেজিতে ২০০-৩০০ মিলিগ্রাম ক্রোমিয়াম এর উপাস্থতি গ্রহনযোগ্য হিসাবে গন্য করা হয়।

ব্রয়লার হাউস ফিডের ৩টি ফিডের নমুনায় ক্রুড প্রোটিনের মাত্রা সর্বোচ্চ ১২.২২% ও সর্বনিম্ন ১০.৫৪% পাওয়া যায়, যা আদর্শ মাত্রার বেশ নীচে। ক্যালসিয়ামের পরিমান গ্রহণ যোগ্য মাত্রায় পাওয়া গেলেও (সর্বোচ্চ ২.৫১% ও সর্বনিম্ন ১.২৩%), পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফসফরাসের পরিমান (সর্বোচ্চ ১.০৬% ও সর্বনিম্ন ০.৫১%) আদর্শ মাত্রার (৩-৫%) অনেক নীচে পরিলক্ষিত হয় (টেবিল – ২)।

পাদপংক্তিঃ

  • বিশ্লেষণকৃত ৩টি হাউজ ফিডে কোন প্রকার এন্টিবায়োটিক অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়নি।
  • পুষ্টিগুন (প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস) এর আদর্শ মাত্রার অভাব পরিলক্ষিত হয়। সেটা নিম্ন মানের উপকরণ এর ব্যবহার, ত্রুটিপূর্ণ পরিবহন ও দূর্বল সংরক্ষণ ব্যবস্থার কারণেও হতে পারে।
  • পূর্বেই বলা হয়েছে, পশু বা মুরগীর খাবারে আর্সেনিক, সীসা ও ক্রোমিয়াম এর উপস্থিতি পাওয়া গেলেও তার ৯৮%-ই হচ্ছে জৈব আর্সেনিক, শুধুমাত্র অজৈব আর্সেনিক হচ্ছে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর।
  • তাছাড়া শিল্প কারখানার বিস্তৃতি, প্রক্রিয়াজাত কারখানায় ইটিপি না থাকায় আর্সেনিক ছাড়া ও অন্যান্য ভারী ধাতু যেমন সীসা, ক্রোমিয়াম প্রাকৃতিকভাবেই মাটি ও পানিতে স্থিত হয় বা পাওয়া যায়, ফলে কিছু কিছু নমুনায় এসব ভারী ধাতু থাকাটা স্বাভাবিক, তবে এতে উৎকন্ঠিত হওয়ার মতো কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই।

টেবিল ৩ : লেয়ার ফিডের এন্টিবায়োটিক, হেভি মেটাল অবশিষ্টাংশ ও পুষ্টিমানের তুলনামূলক চিত্র

৮টি কোম্পানির লেয়ার ফিডের নমুনায় এন্টিবায়োটিক অবশিষ্টাংশ বিশ্লেষণ করা হয়। পরীক্ষায় ৩ টি কোম্পানির নমুনা ফিডে অর্থাৎ নমুনা-১ ফিডে প্রতি কেজিতে Chlortetracycline ৩১৯.৫ মাইক্রোগ্রাম ও ৪ 4Epichlortetracycline ১৫৬.৮ মাইক্রোগ্রাম; নমুনা-৪ ফিডে Oxytetracycline ৯.১২ মাইক্রোগ্রাম ও ৪ Epioxytetracycline ১২.৪০ মাইক্রোগ্রাম এবংনমুনা-৬ ফিডে, Chlortetracyclin ১৭.১৯ মাইক্রোগ্রাম ও ৪ Epichlortetracycline ৫.১৮ মাইক্রোগ্রামএর উপস্থিতি পাওয়া যায়। তবে সকল ক্ষেত্রেই প্রাপ্ত এন্টিবায়োটিক অবশিষ্টাংশের মাত্রা মানব দেহের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার নিচে ছিলো (টেবিল – ৩)।

পরীক্ষাকৃত ৮টি ফিডের ৭টিতে-ই লিড/সীসা এর উপস্থিতি ছিল, তবে এসব নমুনার শুধুমাত্র তিনটি কোম্পানির ফিডের নমুনায় (নমুনা-২ এ ৩.৩১; নমুনা-৪ এ ৩.৬২ ও নমুনা-৫ এ ৩.১৫ মিলিগ্রাম/কেজি) অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার উপরে পাওয়া যায়। বিশ্লেষণকৃত নমুনাসমুহে অন্যান্য ভারী ধাতু: ক্রোমিয়াম ও আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেলেও তা নির্ধারিত সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করেনি।

বিশ্লেষণকৃত লেয়ার ফিডের সকল নমুনায় ক্রুড প্রোটিনের পরিমান সর্বোচ্চ ১৬.৪১ % ও সর্বনিম্ন ১৪.২৬% পাওয়া যায়, অর্থাৎ কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রোটিনের পরিমান আদর্শ মাত্রার (সর্বনিম্ন ১৬%) নীচে পরিলক্ষিতি হয়। সকল ক্ষেত্রেই ক্যালসিয়ামের পরিমান আদর্শ মাত্রায় বজায় ছিল। তবে সকল নমুনায় ফসফরাসের নিম্ন মাত্রা (সর্বোচ্চ ০.৮৮ % ও সর্বনিম্ন ০.৫১%) পরিলক্ষিত হয়, ফসফরাসের আদর্শ মাত্রা হলো সর্বনিম্ন ৩-৫%।

পাদপংক্তি :

  • বিশ্লেষণকৃত কয়েকটি নমুনায় এন্টিবায়োটিক রেসিডিউ পাওয়া গেলেও সকল ক্ষেত্রেই মানব দেহের জন্য নির্ধারিত সহনীয় মাত্রার মধ্যেই ছিল।
  •  বিশ্লেষণকৃত প্রায় সকল নমুনায় কোন না কোন মাত্রায় লিড এর উপস্থিতি থাকলেও তিনটি কোম্পানির ফিডের নমুনায় (নমুনা-২ এ ৩.৩১; নমুনা-৪ এ – ৩.৬২ ও নমুনা-৫এ ৩.১৫ মিলিগ্রাম/কেজি) অবশিষ্টাংশের পরিমান সহনীয় মাত্রার উপরে পাওয়া যায়(টেবিল-৩)।
  •  ক্রোমিয়াম ও আর্সেনিক অবশিষ্টাংশ সহনীয় মাত্রার মধ্যে পাওয়া যায়।
  • কিছু নমুনায় প্রোটিন ও সকল ক্ষেত্রে ফসফরাসের পরিমান আদর্শ মাত্রার নীচে পরিলক্ষিত হয়।

উপসংহার :
পুুষ্টি ইউনিট, বিএআরসি-র ধারাবাহিক গবেষণা ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে খামার পর্যায়ের চেয়ে মার্কেট পর্যায়ে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের হার বেশী পরিলক্ষিত হয় । আবার বিভিন্ন ফিডে এন্টিবায়োটিক অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেলেও বিগত কয়েক বছরের চেয়ে ব্যবহারের হার অনেকটা কমেছে। তবে এর জন্য খামারীদের ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে ‘ Withdrawl Period’ যেন খামারীরা কঠোরভাবে অনুসরন করে সে লক্ষ্যে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি নিয়মত মনিটরিং করতে হবে। পাশাপাশি উৎপাদন পর্যায়ে পোল্ট্রি ও পশু খাদ্যে যাতে কোন ধরণের এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য অব্যাতভাবে মনিটরিংসহ সময় সময় বাজার হতে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতে হবে।

গবেষণা জরীপে প্রাপ্ত ফলাফলে আরও দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন না কোন মাত্রায় বিভিন্ন ভেজাল উপকরণ মিশিয়ে পশু খাদ্য তৈরী করা হয়। এদের মধ্যে সরিষার খৈল, আঁশযুক্ত উপকরণ, কাঠের গুড়াঁ, সয়াবিন মিল, ইউরিয়া, কুড়াঁ/ভূষিতে কাঠের গুঁড়া, মৎস্যচূর্ণ, লবণ, বালি, মার্বেল পাউডার, পাথর চূর্ণ, চিটাগুড়া, পানি, নুড়ি পাথর মেশানো ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

তাই, বাংলাদেশের বিভিন্ন বাণ্যিজিক প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক উৎপাদিত পশু খাদ্য সামগ্রীর উপকরণসমূহের মান বজায় রেখে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানোর জন্য উৎপাদন ও বাজারজাত পর্যায়ে কঠোর তদারকী প্রতিষ্ঠাসহ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা, আইন প্রনয়ণ ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্র্ণ। এছাড়াও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণসহ অনুমোদিত কাঠামোর স্লটার হাউস/কসাইখানা ও মাংস/দুধ ইত্যাদি বিক্রয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, খাদ্যমান ও ভেজাল সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে খোলা বাজার থেকে পশু খাদ্য/মাংস/দুধ ব্যবহার বা ক্রয় থেকে বিরত থাকতে হবে। তাছাড়া কাচা, অর্ধ-সিদ্ধ ডিম খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।

ইতোপূর্বে পুষ্টি ইউনিট, বিএআরসি-সহ অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে যে মাংসের চেয়ে অঙ্গ-প্রতঙ্গ যেমন মুরগীর গিলা, কলিজা, মাথা ও হাড়ের মজ্জা প্রভৃতিতে এন্টিবায়োটিক রেসিডিউ অপেক্ষাকৃত বেশী সঞ্চিত হয়। তাই সম্ভব হলে ব্রয়লার মুরগীর গিলা, কলিজা, মাথা ও মুরগীর হাড় চিবিয়ে ভেতরের মজ্জা যথা সম্ভব না খাওয়া ও দেহে এন্টিবায়োটিক শোষণ কমাতে যথাসম্ভব অপেক্ষাকৃত বড় আকারের (কম পক্ষে ১.৫ কেজি; ২ কেজি বা এর বেশী ওজনের) মুরগী ক্রয় করা/খাওয়া শ্রেয়। তবে করোনা পরিস্থিতিতে দেহের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সামর্থ্যবানদের অবশ্যই মুরগী খাওয়া উচিত। মুরগী শুধু প্রোটিন নয়, জিংকেরও একটি ভাল উৎস।

আবার দেখা যায় যে ক্রেতাগন বাজার হতে ব্রয়লার মুরগী কেনার পর মেশিন দিয়ে ড্রেসিং করে থাকে, কিন্তু লক্ষনীয় যে বিক্রেতা সারাদিন প্রায় একই গরম পানিতে অব্যাহতভাবে বহুসংখ্যক মুরগী চুবিয়ে/ভিজিয়ে ড্রেসিং করে থাকে; ফলে নানা প্রকার রোগজীবানু সংক্রমিত হয়ে মারাত্বক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষে একই গরম পানি ব্যবহার করে ৫টির বেশী মুরগী ড্রেসিং করা একবারেই অনুচিত। এব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক নজরদারি করা সহ উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী।

তবে বায়োসেফটি, বায়োসিকিউরিটির যত কথাই বলি না কেন, শুধুমাত্র যদি ’ স্লোয়ার গ্রো’ অর্থাৎ ২৮ দিনে মুরগী বাজারজাত না করে ৩৫-৩৮ দিনে বাজারজাত করা হয় এবং পাখিকে ’ক্লিন ড্রিকিং ওয়াটার’ সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এন্টিবায়োটিক বা হরমোনের অবশিষ্টাংশ কখনই ক্ষতিকর মাত্রায় পাওয়া যাবেনা বা মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

লেখক :
ড. মোঃ মনিরুল ইসলাম
পরিচালক (পুষ্টি)
বংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: