শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৩৩ অপরাহ্ন

শিরোনাম
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে  প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে- সুবর্ণচর উপজেলা আ.লীগ হাতিয়ার উন্নয়নে সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ কর্মসূচিকে কাজে লাগানো হবে – মোহাম্মদ আলী এমপি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ৩৯ বছর পর জমি ফিরে পেলেন যদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার শিবালয়ে ১৫তম  মাই টিভির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত  ক্রীড়াবিদরা দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনছে- ধর্মমন্ত্রী উজিরপুরে সৎসঙ্গ ফাউন্ডেশনের সেমিনার অনুষ্ঠিত শিবালয়ে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠিবাড়ি খেলা অনুষ্ঠিত লঞ্চের দড়ি ছিঁড়ে ৫ জনের মৃত্যু : আসামিদের তিন দিনের রিমান্ড ঈদের দিনে সদরঘাটে দুর্ঘটনায় ঝরল ৫ প্রাণ সৌদির সাথে মিল রেখে নোয়াখালীর ৪ গ্রামে ঈদ উদযাপন

পুষ্টি নিরাপত্তার বাঁধাঃ পুষ্টিকর খাদ্যাভাব না পুষ্টি জ্ঞানের অভাব ও অসচেতনতা : ড. মোঃ মনিরুল ইসলাম

সম্প্রতি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ব্রাকসহ অন্যান্য মাধ্যম থেকে ভবিষৎ বাংলাদেশে শর্করা খাবারের অভাব না হলেও পুষ্টিকর খাবার নিয়ে শঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। তবে আলোচনা-সমালোচনা যাই হোক না কেন বিগত দশক হতে বাস্তবে দেশে শুধু চাল নয়, পাল্লা দিয়ে শাক-সবজি, ফল, মাছ মাংস, দুধ ও ডিমের উৎপাদনও লক্ষণীয়ভাবে ক্রমবর্ধমান। একমাত্র ডাল, তেল ফসল ও দুধ ছাড়া অন্য প্রতিটি কৃষি পণ্যেরই চাহিদা ও যোগান এর মধ্যে তেমন ভারসাম্যতা অছে বলে একজন বিজ্ঞানী হিসাবে আমি মনে করিনা। তবে ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থার কারণে অনেক সময় বাজারে পণ্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়, এবং ভর মৌসুমে কৃষকরা পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। উপরন্তু ফসল সংগ্রহত্তোর উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ক্ষতি অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনও তুলনামুলকভাবে অনেক বেশী। ফলে ফি বছর উৎপাদিত ফসলের বিরাট অর্থিক ক্ষতি ছাড়াও পরিবেশের ক্ষতি সাধিত হয়। সেজন্য কৃষি পণ্যের সংরক্ষণ মান উন্নয়ন ও বহুমাত্রিক প্রক্রিয়াজাতের কোন বিকল্প নেই। এখানে উল্লেখ্য যে কৃষি বান্ধব সরকার কর্তৃক সর্বজন শ্রদ্ধেয় কৃষিবিদ ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, এম.পি কৃষি মন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে কৃষির বিভিন্ন সেক্টর: যেমন গবেষণা, কৃষি পুষ্টি, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সম্প্রাসারণ, প্রক্রিয়াজাত, মার্কেটিংসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি খাত-উপখাতে উন্নয়ন ও গতিশীলতা দৃশ্যমান এবং আশা করা যায় মাননীয় কৃষি মন্ত্রীর নেতৃত্বে আগামী দিনের কৃষি হবের্ প্তানীমুখী, নিরাপদ ও পুষ্টি সমৃদ্ধ, বহুমুখী ও বানিজ্যিক। যার সুফল ভোগ করবে গোটা দেশ ও জাতি।

অন্যদিকে, সরকারের সদিচ্ছা ও যথাযথ সহযোগিতার ফলে আফ্রিকা ও এশিয়ার তুলনায় পুষ্টি পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি ঘটলেও বিরাট জনগোষ্ঠি এখনও অপুষ্টির শিকার। অপুষ্টির কারণে বিশেষ করে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের এখনও ২২ শতাংশ খর্বাকায় (অর্থাৎ বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম) ও ৮ শতাংশ কৃশকায় (উচ্চতার তুলনায় ওজন কম) (বিবিএস ২০১৯) । পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্রাক কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভবষিৎ পুষ্টিকর খাবারের সঙ্কট অর্থাৎ পুষ্টি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্ভেগ প্রকাশ করা হয়েছে। উপরন্তু বর্তমানে যোগ হওয়া করোনা পরবর্তীতে আরও ব্যাপকতা লাভ করতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। অপুষ্টিজনিত সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো রক্তস্বল্পতা; যা মূলতঃ আয়রণ জনিত ঘাটতিকেই বুঝায়। প্রয়োজনীয় ও পরিমাণমত খাবার, বিশেষ করে আয়রণ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের স্বল্পতায় শিশু, কিশোর-কিশোরী, গর্ভবতী ও প্রসুতি মায়েরা বেশী আক্রান্ত। সাধারনভাবে আমরা যা ধারন করি, পুষ্টি ঘাটতির জন্য মূল বাঁধা পুষ্টিকর খাবারের অভাব, আসলে তা সঠিক নয় এবং আস্থার সাথে একজন পুষ্টি বিজ্ঞানী হিসাবে তা মনে করি। বরং বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মাঝে খাদ্যাভাসে অসচেতনতা ও পুষ্টি বিষয়ক জ্ঞানের অভাব এর কারনে পুষ্টি উন্নয়নে একটি বড় বাধা। তাই সবার জন্য পুষ্টি নিশ্চিতকরণে সুনির্দিষ্ট পরিকলপনা গ্রহণ করা হলে, পুষ্টি সমস্যার উন্নয়ন কঠিন কিছুু নয়।

জীবন ধারণের জন্য যেমন খাদ্য অত্যাবশ্যক। আবার সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ, পুষ্টিমান সম্পন্ন ও সুষম খাবার গ্রহণ প্রয়োজন । অপুষ্টি শুধূ বাংলাদেশে নয়, উন্নত বিশ্বেও একটি সমস্যা। তাই পরবর্তী পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে কিছু পরিকল্পনার মাধ্যমে এগোতে হবে। বিগত দশকে মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি, সর্বোপরি পেশাগত কর্মব্যস্ততার ফলে মানুষের খাদ্যাভাসের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। অনেকেরই ধারণা দামী খাবার ছাড়া পুষ্টি পাওয়া যায়না, যা সম্পূর্ণ ভুল। আমাদের দেশের কৃষি খুবই বৈচিত্র্যময়। প্রতিটি নানা জাতের প্রচলিত-অপ্রচলিত ফল-সব্জি কোন না কোন ধরণের পুষ্টির আধার। কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়টি হলো, বর্তমানে প্রায় ৮০-৯০ ভাগ ছেলে-মেয়ে ফল-সবজি খেতে চায়না বা খেতে অনীহা, এমনকি মাছও অনেকেরই অপছন্দ। । রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সেজন্য সুষম ও পুষ্টিকর তথা বৈচিত্র্যময় খাবার খাওয়ার কোন বিকল্প নেই। বিশ্বের প্রায় ৮০ ভাগ খাবারই প্রক্রিয়াজাত। সময় সাশ্রয়ী, সহজে বহনযোগ্য ও সহজে খাওয়া যায় এমন প্রক্রিয়াজাত খাবার এর চাহিদা সারা বিশ্বে দিনদিন বেড়েই চলেছে। সেজন্য আমাদেরকেও ফল-সব্জি, মাছ, মাংসও দুধ প্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এতে অর্থ, পুষ্টি সবই মিলবে, সংগে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে।

পুষ্টি নিরাপত্তায় করণীয় বিষয়/পদক্ষেপসমূহঃ

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব বা ঘাটতির চেয়ে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মাঝে সচেতনতা ও পুষ্টি বিষয়ক জ্ঞানের অভাব ও খাদ্যের ব্যবহার কৌশলের দূর্বলতার কারণে সামগ্রিক পুষ্টি উন্নয়নে একটি বড় বাধা । সেজন্য সামগ্রিক পুষ্টি উন্নয়নে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে নিম্ন বর্ণিত উদ্যোগসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে:

১. পরিবার পর্যায়ে, স্কুল-কলেজ, বিশ্বদ্যিালয়, মাদ্রাসা, এতিমখানা, মসজিদ-মন্দিরে পুষ্টিকর খাবার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর নিমিত্ত ব্যাপক কার্যকর কর্মসূচী বা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অন্যদিকে নিম্ন আয়ের ও কর্মহীন মানুষদের পুষ্টির বিষয়টি সরকার কর্তৃক বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। নতুবা কর্মশক্তির ঘাটতি সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে তাই বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য বিভিন্ন প্রকার খাবার তালিকা বা মেন্যু নির্ধারণ করে প্রচার প্রচারণা চালানোসহ সচেতন করতে হবে। উদাহরনস্বরুপ নিম্ন আয়ের লোকদের আপদকালীন সময়ে বা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পুষ্টি সুরক্ষায় ও কর্মক্ষম রাখতে দামে সস্তা, সহজলভ্য অথচ পুষ্টিগুনে ভরপুর এধরণের খাবার আমলে বা নির্বাচনে পরামর্শ প্রদান করতে হবে, যা থেকে সর্বোচ্চ পুষ্টি উপাদান পাওয়া যাবে। যেমনঃ-
ক. মেন্যু-১
পান্তা ভাত, ডাল ভর্তা, ডিম ভর্তা;
খ. মেনু- ২
পান্তা ভাত, মিষ্টি আলু ভর্তা, ডাল ভর্তা (সংগে টুকরো লেবু রাখতে পারলে ভাল, এতে আয়রণ শোষণ ভাল হবে)।
এগুলো সস্তা, সহজলভ্য অথচ পুষ্টি সমৃদ্ধ (প্রয়োজনীয় শর্করা সহ পান্তা ভাত হতে প্রচুর পরিমান আয়রণ, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম পাওয়া যাবে এবং পান্তা ভাত হচ্ছে বি ভিটামিনের আধার (ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৫, বি৬, বি৯ ও বি১২ উল্লেখযোগ্য)। গবেষণাগারে পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, ১০০ গ্রাম পান্তা ভাতে চালের প্রকারভেদে সাধারন ভাতের চেয়ে সর্বোচ্চ ৫৫.৮৩% আয়রন এবং ৪৯২% ক্যালসিয়াম বেশী পাওয়া যায়। তাছাড়া ভর্তায় ব্যবহৃত তেল, ডিম, পেঁয়াজ হতে প্রয়োজনীয় চর্বি, ফাইবার, ফলেট, জিংক, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-এ, বি-২ সহ অন্যান্য অণু পুষ্টি কণা মিলবে। ডাল হতে প্রয়োজনীয় প্রোটিনও মিলবে। এমনকি আপদকালীস সময়ে শাক-সব্জি পাতে যোগ না করতে পারলেও প্রায় বেশীরভাগ প্রয়োজনীয় পরিমান শর্করা, প্রোটিন ও গুরুত্বপূর্ণ অণু পুষ্টি উপাদানসমূহ উল্লেখিত মেন্যু হতে পাওয়া যাবে। তাই দামী খাবার নয় প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষের জন্য খাদ্য নির্বাচনে সর্তকতা জরুরী।
২. রাইস আমাদের প্রধান খাদ্য। তাই রাইস বা চালের ভ্যালু এডিশান (যেমন: রাইস কেক) বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণও জরুরী। উল্লেখ্য যে মানুষের একটা বদ্ধমূল ধারনা, ওজন কমাতে বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখতে রুটি খাওয়া ভাল। তবে, সাম্প্রতিক বেশ কিছু গবেষণা বলছে তার উল্টো অর্থাৎ ভাতের চেয়ে রুটিতে বিপদ বেশী; এমনকি গবেষণা বলছে হোল-গ্র্রেইন বা গোটা শস্য দানা থেকে তৈরী গমের খাবারের চেয়েও ভাত খাওয়া অপেক্ষাকৃত ভাল। প্রক্রিয়াজাত গমে থাকে প্রোটিন গ্লিয়াডিন, অ্যামাইলোপেকটিন ও গ্লটেন । ফলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ওবেসিটি’র ঝুঁকি বা রিক্স ফ্যাক্টর বাড়ে । গমের খাবার হু হু করে বাড়িয়ে দেয় ব্লাড সুগার; একটা স্লিকার্স বার যতটা না ব্লাড সুগার বাড়ে, ২ টা আটার রুটিতে তার চেয়ে অনেক বেশী বাড়ে।
৩. ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে এক ইঞ্চি জমিও পতিত রাখা যাবেনা। ঠিক তেমনিভাবে খাদ্য অপচয় ও পুষ্টি অপচয় রোধ করতে ভোক্তা সাধারণেরও কৌশলী বা সচেতনতা জরুরী। আমরা যা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করি যেন সর্বোচ্চ পুষ্টির ব্যবহার হয়, সেজন্য সচেষ্ট হতে হবে। অনেকেরই জানা নেই অনেক ফল- সব্জির খোসাতে বেশী পরিমান পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। সেজন্য যেসব ফল-সব্জি খোসাসহ খাওয়া যায় তা খোসা না ফেলে খেতে হবে । বিভিন্ন ফল-সব্জি যেমন আপেল, কলা, শসা, বেগুন, লাউ, কুমড়া, আলু পুষ্টিতে ভরপুর; তেমনি এসব স্বাস্থ্যকর ফল বা সবজির খোসাও অনেক উপকারী। সেজন্য যেসব সব্জি খোসাসহ খাওয়া যায় সে বিষয়ে অব্যাহতভাবে বিভিন্ন মাধ্যম বা উপায়ে প্রচার প্রচার চালানো এর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪. পুুষ্টি উন্নয়নে একটি পূর্ণাঙ্গ ’ফুড কম্পোজিশান টেবিল’ এর প্রয়োজনীতা অনস্বীকার্য; এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে;
৫. পুষ্টি অপচয় রোধ ও নিরাপদতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় বাজারসহ প্রতিটি কিচেন মার্কেট আধুনিকায়ন জরুরী;
৬. আলু, পেঁয়াজ সংরক্ষনের জন্য আলাদা তাপমাত্রা/আর্দ্রতার প্রয়োজন হয়, সেজন্য এসব পণ্যসহ অন্যান্য পঁচনশীল পণ্য সংরক্ষেণে আলাদা হিমাগার স্থাপনে পদক্ষেপ নিতে হবে:
৭. আম উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও মানুষ যে পরিমান ভক্ষণ করে, তার চেয়ে বেশী অপচয় হয় (বিশেষ করে বর্তমানে বেশীরভাগ কিশোর কিশোরীদের মধ্যে আম/ফল খেতে অনীহা লক্ষণীয়, সেজন্য বহুমাত্রিক ভেলু এডিশান এর ব্যবস্থা নিতে হবে। আম সরাসরি রপ্তানির পাশাপাশি পাল্প উৎপাদনে উৎসাহ প্রদাণ বা ব্যবস্থা গ্রহণসহ রপ্তানী বাজার সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় পদেেক্ষপ নিতে হবে;
৮. আমাদের দেশটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবন, দূর্যোগ আসে এক এক সময় এক রুপে বা নানারুপে। দূর্যোগ মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়াই হলো সফলতা বা কৃতিত্ব। যেমনঃ আম ঝড়ে পরবেই, কিন্তু এসব মোকাবেলায় যাতে কিছুটা হলে তাৎক্ষনিক ক্ষতি কাটানো যায় সেজন্য কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যেমন ফল বা আম উৎপাদন এলাকার চাষীসহ স্থানীয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নিয়মিত প্রত্রিয়াজাতকরণ (যেমন: আচার, আমসত্ত্ব, ম্যাংগোবার, মোরোব্বা তৈরী ইত্যাদি) বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে অর্থ, পুষ্টি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। তাছাড়া বিজ্ঞানীদের এ বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম বাড়াতে হবে;
৯. স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে নিরাপদ উপায়ে আম পাকানোর জন্য ইথিলিন চেম্বার/রাইপেনিং চেম্বার তৈরীর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে;
১০. ’হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট’ এর মান উন্নয়ন এর লক্ষ্যে অধিকতর গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে; উল্লেখ্য যে বর্তমানে দেশে প্রচলিত ’হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট’ এর মাধ্যমে আমের এনথ্রাক্র ও বোটা পঁচা রোগ দমন সহ প্রায় ৭ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ মেয়াদ বাড়ানো যায়। কিন্তু ’পাকিস্তান’ এর বিজ্ঞানীরা ’হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট ও ওয়াক্রিং’ এর মাধ্যমে আমের সংরক্ষণকাল ৩০-৪৫ পর্যন্ত বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। সেজন্য এ সংক্রান্ত গবেষণায় বিশেষভাবে মনযোগ দিতে হবে;
১১. বিশ্বব্যাপি আমসহ অন্যান্য ফল এর সংরক্ষণ মেয়াদ বৃদ্ধির নানা প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন বলা যায় : Ionized Sodium Chloride and beeswax সমন্বয়ে তৈরী স্টিকার ব্যবহার করে ফলের সংরক্ষণ মেয়াদ ১৪ দিন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যায়। তাই এধরনের নতুন নতুন প্রযুক্তি হয় ‘Adapt or Adopt’ করতে হবে;
১২. বিভিন্ন ফল বিশেষ করে উৎপাদিত আনারস ও কাঁঠাল একটি পুষ্টিকর খাবার। কিন্তু প্রক্রিয়াজাত বা ভেল্যু এডিশান এর ব্যবস্থা না থাকায় অর্থ ও পুষ্টির অপচয় লক্ষনীয়। তাই, এগুলো প্রক্রিয়াজাত এর যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতঃ পুষ্টি চাহিদা মেটানো ও বৈদেশিক অর্থ উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে;
১৩. ভর মৌসুমে টমেটোর দাম একবারেই কমে যায়, সেজন্য প্রক্রিয়াজাতের ক্ষেত্র বাড়াতে হবে; বিশেষ করে পাল্প তৈরীর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানীর সুযোগ সৃষ্টির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে;
১৪. রাস্তার ধারে বা পাশে বা বিভিন্ন খালি জায়গায় সরকার কর্তৃক যখন বনায়ন করা হয় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বনজ গাছকে প্রাধান্য দেওয়া হয়: সেক্ষত্রে ৩০% ফলদ বৃক্ষ রোপণে সরকার কর্তৃক নিশ্চিতকরণের প্রযোজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে অর্থ ও পুষ্টি দু’টোই মিলবে;
১৫. অন্যান্য ডাল উৎপাদনের পাশাপাশি, বিশেষ করে অরহর ডাল উৎপাদনে উৎসাহ প্রদান বা কর্মসূচী প্রণয়ন করতে হবে, এটা খুব সহজেই রাস্তার ধারে লাগানো যায়। অরহর ডাল অত্যন্ত পুষ্টিকর – প্রোটিন ও ক্যালসিয়ামের একটি ভাল উৎস;
১৬. ফল-সব্জি সমন্ধে নেতিবাচক প্রচারণা বন্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; যেমন ফরমালিন দিয়ে ফল পাঁকানো ও সংরক্ষণ করা হয়। এসব নেতিবাচক প্রচারণা বন্ধে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে। প্রকৃত সত্য হলো ফল-সব্জিতে প্রাকৃতিকভাবেই প্রতি কেজিতে ৩-৬০ মিলিগ্রাম ফরমালিন থাকে। তাছাড়া ফল-সব্জি হলো আঁশ জাতীয় খাবার, তাই ফরমালিন দিয়ে ফল পাকানো বা সংরক্ষণ করা যায়না;
১৭. টেকসই ও পর্যাপ্ত কৃষি ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক গৃহীত চলমান বিভিন্ন পদক্ষেপ/সুবিধা : সার, উন্নত বীজ, বিদ্যুৎসহ, কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে প্রণোদনা অব্যাহত রাখা এবং যাতে প্রকৃত চাষিরা সুফল প্রায় সে বিষয়টি সরকার কর্র্তৃক নিশ্চিতকরণে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা;
১৮. শস্য/ফসল সংগ্রহত্তোর ক্ষতি কমাতে যথাযথ সংগ্রহ/আহরণ ব্যবস্থা, উপযুক্ত অস্থায়ী সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন বা সৃষ্টি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভ্যানের মাধ্যমে পঁচনশীল পণ্যের পরিবহণ নিশ্চিতকরণ করতে হবে;
১৯. ঔষধি গাছ চাষাবাদ এ উৎসাহ প্রদানসহ এর ভেষজ গুনাগুন নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণে উদ্যোগ গ্রহণ;
২০. যে কোন আপদকালীন বা বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রতিটি পণ্যের জন্য ব্যাকআপ জরুরী । যেমন করোনায় পরিস্থিতিতে দুধ ও পোল্ট্রিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি প্রতীয়মান। সেজন্য দুধ প্রক্রিয়াজাত বিশেষ করে আপদকালিন সময়ে যাতে দুধ-কে পাউডার এ রুপান্তরিত করা যায়, সে ধরণের উদ্যোগ বা প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে; এবং একই সাথে পোিল্ট্রর হরেক রকম প্রক্রিয়াজাত পণ্য উৎপাদনসহ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় হিমাগারের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ;
২১. ফি বছর সরকারীভাবে ব্যাপক সংখ্যায় খাল-বিল, হাওর-বিল,নদী-নালাতে মাছের পোনা অবমুক্তকরণ এর ব্যবস্থা নিতে হবে;
২২. সামুদ্রিক সম্পদ বিশেষ করে আগামী দিনের সম্ভাবনাময় খাদ্য ’সামুদ্রিক শৈবাল’ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত বিষয়ে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে; তাছাড়া সামুদ্রিক মাছে দেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় অণুু পুষ্টি কণার (যেমন; আয়োডিন) আধিক্য স্বাদু পানির মাছের চেয়ে বেশী, সেজন্য খাদ্যাভাস পরিবর্তনে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে;
২৩. দেশে উৎপাদিত মাছ সংরক্ষনের জন্য কোন হিমাগার নেই; এতে প্রাণীজ প্রোটিন এর একটা বিরাট অংশের অপচয় হয় ও নিরবিচ্ছিন্ন প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে ব্যঘাত সৃষ্টি হয়; তাই সরকার কর্তৃক এক্ক হিমাগার বা মাল্টিপারপাস (বিভিন্ন পণ্যের জন্য আলাদা) হিমাগার ক্লাস্টার আকারে স্থাপনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া জরুরী;
২৪. হাঁস-মুরগী ও গবাদিপশুর রোগবালাই দমনে যথাযথ টিকা প্রদান,চিকিৎসা সহজীকরণও নিশ্চিতকরণ এ আরও অধিকতর কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে;
২৫. গবেষণা জরিপে দেখা গেছে যে দেশের প্রায় ৮০-৯০ ভাগ মেয়েরা (বিশেষ করে হোস্টেলে) সকালের নাস্তা না খেয়ে শ্রেণীকক্ষে যোগদান করে, যা অপুষ্টির জন্য বাড়তি বোঝা; সেজন্য পরিবার পর্যায়ে ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে;
২৬. গৃহিণী ও কর্মজীবি মায়েদের পুষ্টি বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে;
২৭. কৃষকদের প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করতে হবে;
২৮. শিশুরা শিক্ষকদের আদেশ, উপদেশ ও নির্দেশ বিশেষভাবে অনুসরন করে থাকে। সেজন্য পুষ্টি উন্নয়নে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের নিয়মিতভাবে পুষ্টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে;
২৯. তাছাড়া পুষ্টি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা যেমন- বৃহত্তর সিলেট ও উত্তরাঞ্চল) সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম জোরদারসহ পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে;
৩০. সৃজনশীল, সহজে বোধগম্য ও সচিত্র নানা ধরণের Behaviour Change Communication Tools (BCC) যেমন : ফুড প্লেট, স্টিকার লিফলেট, পোষ্টার সৃষ্টি ও বিতরনের মাধ্যমে পুষ্টি বিষয়ক জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে;
৩১. নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতকরণে স্বীকৃত গবেষণাগার স্থাপনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৩২. বংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রবণ দেশ, সেজন্য উপকুলীয় এলাকায় (বিশেষ করে আইলা, সিডর কবলিত এলাকা) সুবিধাজনক উচু স্থানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দুর্গত মানুষকে আপদকালীন পানিশূণ্যতা/পানিবাহিত রোগ যেমন: ডায়েরিয়া, কলেরা থেকে রক্ষার নিমিত্ত নিকটবর্তী উঁচু স্থানে আখ রোপণ কর্মসূচী গ্রহণ।

সর্বোপরি প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা দূরীকরণে ও অর্ন্তজাতিক বাজারে সহজে প্রবেশের নিমিত্ত কৃষি পণ্যের ’প্রক্রিয়াজাত বা ভেল্য এডিশান’ বিষয়ে দেশী-বিদেশী কোম্পানীর যৌথ উদ্যোগে কারখানা স্থাপনে সরকার কর্তৃক প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

লেখক :
ড. মোঃ মনিরুল ইসলাম
পরিচালক (পুষ্টি)
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: