রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১২ অপরাহ্ন

যোগের মহিমা – শচীন্দ্র নাথ হালদার

যোগ মানব জাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। এটি মানব জাতির অনেক কল্যাণ সাধন করতে পারে। যোগের মহিমা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। চার হাজার বছরের বেশি আগে ঋষি পতাঞ্জলি এ যোগ আবিষ্কার করেন। তাঁর এ আবিষ্কার “পাতাঞ্জল সূত্র” নামে পরিচিত। এ মহৎ আবিষ্কার অধিকারিক যোগীদের কৃপণ মানসিকতার জন্য জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেনি। যোগীরা সাধারণত উপযুক্ত পুত্র বা শিষ্য ছাড়া অন্য কাউকে এ যোগ শিক্ষা দিতেন না। কালক্রমে এ যোগ প্রায় বিলুপ্ত হবার কারণে জনসাধারণ যোগের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আধুনিককালে স্বামী বিবেকানন্দ মানব কল্যাণের জন্য যোগকে জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ নেন। এর ধারাবাহিকতায় ২১ জুন বিশ্বব্যাপী “আন্তর্জাতিক যোগ দিবস” হিসেবে পালিত হচ্ছে। যোগ অনুশীলনে প্রধাণতঃ নিযোগ, সবল, কর্মক্ষম দেহ এবং দীর্ঘজীবন লাভ, মনের নিয়ন্ত্রণ শক্তি অর্জন, জ্ঞানার্জন, ধার্মিক হওয়া, ধর্মের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা প্রদান এবং মুক্তি লাভ করা সম্ভব।

যোগ বলতে আমরা সাধারণতঃ রাজযোগ বুঝে থাকি। রাজযোগকে আট ভাগে ভাগ করা যায় যথা : যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান, ধারনা ও সমাধি। যম বলতে অহিংসা, সত্য, অন্ত্রেয়, অচৌর্য, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহকে বুঝায়। এ যম ধারা চিত্তশুদ্ধ হয় এবং দেহ, মন ও আত্মা আনন্দে ভরে উঠে। অন্য কোনো প্রাণীকে ক্ষতি না করাকে অহিংসা বলে। অহিংসা অপেক্ষা মহত্তর কোনো ধর্ম নেই। সত্যের মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের কর্মের ফল লাভ করে থাকি। এ সত্যের ভিতর থেকে সব কিছু পাওয়া যায়। সবকিছু সত্যেই প্রতিষ্ঠিত। চুরি বা বলপূর্বক অন্যের জিনিস গ্রহণ না করাকে অস্তেয় বলে। কায়মনোবাক্যে সর্বদা সকল অবস্থায় পবিত্রতা রক্ষা করাকে ব্রহ্মচর্য বলে। অপরের দান গ্রহণ না করাকে অপরিগ্রহ বলে। নিয়ম শব্দের অর্থ নিয়মিত অভ্যাস বা ব্রত পালন। অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সকল প্রকার শৌচই সাধনের জন্য প্রয়োজন। যম ও নিয়ম চরিত্র গঠনের সহায়ক। আসন বলতে আমরা ধ্যানাসন এবং স্বাস্থ্যাসন এ দুই ধরনের আসন বুঝে থাকি। বুক, গ্রীবা ও মাথা সমান রেখে দীর্ঘক্ষণ আরামে বসে থাকার অবস্থাকে আসন বলে।

প্রাণায়াম শক্তি অর্জনের উপায়। শ্বাস-প্রশ্রাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টাই প্রাণায়াম। প্রাণায়াম ফুসফুসের ক্রিয়ার সাথে সম্পর্কীত। প্রাণায়ামে মনশক্তিরূপ প্রাণের বিকাশসমূহকে মানসিক উপায়ের ধারা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। দীর্ঘদিন প্রাণায়াম অনুশীলনের মাধ্যমে যোগী অষ্টসিদ্ধি লাভ করতে পারেন। অষ্টসিদ্ধি হলো অনিমা, লঘিমা, গরিমা, মহিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাল্য, বশিত্ব ও ঈশিত্ব। বিষয়াভিমুখী মনের গতি ফিরিয়ে অন্তর্মুখী করাকে প্রত্যাহার বলে। চিন্তার একমুখীতাই ধ্যান। এ ধ্যানাবস্থাই মানব জীবনের সর্বোচ্চ অবস্থা। যতক্ষণ আমাদের কামনা বাসনা থাকে ততক্ষণ আমরা প্রকৃত সুখ পাই না। কেবলমাত্র ধ্যানভাবে স্বাক্ষীরূপে সবকিছু পযালোচনা করতে পারলেই আমরা প্রকৃত সুখ লাভ করতে পারি। ইতর প্রাণীর সুখ ইন্দ্রিয়ে, মানুষের সুখ বুদ্ধিতে এবং দেবমানব ধ্যানেই সুখ লাভ করে থাকে। মনের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে স্থায়ীভাবে ধারন করাকে ধারণা বলে। দীর্ঘস্থায়ী গভীর ধ্যানকে সমাধি বলে।

মানবদেহ একটি জটিল বায়োক্যামিক্যাল সংমিশ্রণে পরিচালিত হয়। দেহের অসংখ্য গ্রন্থি বা অর্গান থেকে অসংখ্য প্রকার রস নির্গত হয়ে দেহকে পরিচালিত করে। সঠিকভাবে এবং সঠিক পরিমাণে রস নির্গত হলেই আমরা স্বাস্থ্যবান থাকি এবং এর অন্যথা হলেই আমরা রোগাক্রান্ত হই। যেমন প্যানক্রিয়াস থেকে প্রয়োজনের কম ইসনুলিন নির্গত হলে আমরা ডায়াবেটিক রোগে আক্রান্ত হই। আবার প্যানক্রিয়াস থেকে অতিরিক্ত ইনসুলিন নির্গত হলে আবার দেহে খাবারের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। ফলে দেহে নানাপ্রকার অসামঞ্জস্য দেখা যায় এবং দেহে নানা প্রকার ব্যাধির সৃষ্টি হয়। সমতাই যোগ এবং অসমতাই রোগ। যোগের মাধ্যমে আমরা আমাদের দেহকে অক্সিজেন ভরে ফেলি। সাধারণভাবে আমরা প্রতিটি শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে ৫০০ থেকে ১০০০ মিলিলিটার অক্সিজেন গ্রহণ করি। কিন্তু যোগী প্রতিটি গভীর শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে ৫০০০ থেকে ১০০০০ মিলিলিটার অক্সিজেন গ্রহণ করেন। ফলে যোগীর দেহের প্রতিটি কোষ অক্সিজেনে ভরে উঠে। কোষগুলি শক্তিশালী হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, অক্সিজেনের মধ্যে কোনো জীবানু বা বিজানু রাখলে তা শীঘ্রই মারা যায়। ফলে যোগীর দেহ সর্বদা সুস্থ, সবল এবং কর্মক্ষম থাকে এবং যোগী দীর্ঘজীবন লাভ করেন।

যোগ মন নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। মন আত্মার যন্ত্রস্বরূপ এবং এ মন দ্বারাই আত্মা বাহিরের সাথে সংযোগ রক্ষা করে থাকে। মনের আবার অর্ন্তদৃষ্টি আছে এবং এ শক্তির সাহায্যে সাধন নিজ অন্তরের গভীরতম বিষয়সমূহ দেখতে পারে। এ অর্ন্তদৃষ্টি শক্তি লাভ করাই যোগীর উদ্দেশ্যে। মনের সমুদয় শক্তিকে একত্র করে ভিতরের দিকে ফিরিয়ে ভিতরে কি হচ্ছে তা যোগী জানতে চায়। যোগীরা বিশ্বাস করেন যে মনের একটি উচ্চাবস্থা আছে। যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে এ জ্ঞানাতীত অবস্থা। এ উচ্চাবস্থায় যোগী তর্কের অতীত এক পরমার্থ জ্ঞান বা অতিন্দ্রিয় জ্ঞান লাভ করেন। যোগীরা বিশ্বাস করেন মানব মনের শক্তি অসীম।

সাধারণ মানুষের মন বহির্মুখী। পঞ্চ ইন্দ্রিয় এবং ষড়রিপুর তাড়নায় অনবরত বানরের মতো লাফাচ্ছে। বানরকে মদ খাওয়ালে, বিছুটিকায় কামড়ালে এবং তার মধ্যে অশরীরী প্রভাবে যে ধরনের চঞ্চলতা দেখা দেয় মানুষের মনও তেমনি অহংকার, লোভ এবং পরশ্রীকাতরতার কারণে সর্বদা অস্থির থাকে। এ মনকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। কিন্তু যোগী দীর্ঘ সময় যোগসাধনার দ্বারা বহির্মুখী মনকে অর্ন্তমুখী করে মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যোগীরা বিশ্বাস করেন যে মনের শক্তি অপরিসীম। এ মনঃশক্তি প্রয়োগ করেই যোগী নিজেকে সুস্থ করতে পারেন। শক্তির অসামঞ্জস্যতাই রোগ। অন্তঃমুখী মনের মাধ্যমে যোগী শরীরের যে অংশে শক্তির অভাব আছে তা পূরণের ফলে তার দেহ সুস্থ হয়ে ওঠে।

জ্ঞানার্জন মানব জীবনের অন্যতম একটি সেরা কাজ। যোগী ধ্যানের মাধ্যমে এ জ্ঞানার্জন করে থাকেন। গভীর ধ্যানকে সমাধি বলে এবং এ সমাধিতে গিয়েই যোগী জগতের সত্যসমূহ দর্শন করে থাকেন। মূর্খও যদি সমাধিতে যায় তবে সমাধি ভঙ্গের পর তিনি মহাজ্ঞানী হয়ে উঠতে পারেন। যোগী সাতটি পর্যায়ে এ উচ্চতর জ্ঞান লাভ করে থাকেন। যখন জ্ঞান লাভ হতে থাকে তখন একটির পর আর একটি করে সাতটি স্তরে এ জ্ঞান আসতে থাকে। প্রথম পর্যায়ে যোগী বুঝতে পারেন যে তিনি জ্ঞান লাভ করছেন। তখন সমস্ত অসন্তোষের ভাব চলে যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে সকল দুঃখ চলে যাবে। তৃতীয় পর্যায়ে যোগী পূর্নজ্ঞান লাভ করবেন। চতুর্থ পর্যায়ে বিবেক সহায়ে সকল কর্তব্যের অবসান হবে। পঞ্চম অবস্থায় চিত্তবিমুক্তি অবস্থা আসবে এবং যোগী বুঝতে পারবেন যে তার বাধাবিপত্তি সবে চলে গিয়েছে। ষষ্ঠ অবস্থায় চিত্ত বুঝতে পারবে যে, ইচ্ছামাত্রই উহা স্ব-কারণে লীন হয়ে যাচ্ছে। সপ্তম অবস্থায় যোগী বুঝতে পারবেন যে তিনি নিজ স্বরূপে আছেন। মন বা শরীরের সাথে আত্মার কোনো সম্পর্ক নেই। এরা আত্মার সাথে কখনও যুক্ত ছিল না। আত্মা একাকী, নিঃসঙ্গ, সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপী এবং সদানন্দ। আত্মা এত পবিত্র এবং পূর্ণ যে, তার আর কিছুই প্রয়োজন ছিল না। কারণ আত্মা পূর্ণস্বরূপ। ইহাই যোগীর চরম অবস্থা। যোগী তখন ধীর ও শান্ত হয়ে যান। তিনি আর কোনো প্রকার কষ্ট অনুভব করেন না এবং দুঃখ আর তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি জানতে পারেন যে, তিনি নিত্যানন্দস্বরূপ এবং নিত্যপূর্ণস্বরূপ। এ জীবনেই তিনি মুক্তি লাভ করেন।

মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আধ্যাতিক সাধনা। শক্তির দুটি রূপ। পাশবিক রূপ এবং আধ্যাত্মিক রূপ। পাশবিক শক্তির গতি নির্ম্নমুখী এবং আধ্যাতিক শক্তির গতি ঊর্ধ্বমুখী। মেরুদণ্ডের নির্মাংশের সামান্য নীচে কুলকুণ্ডলিনী বা মূলাধারের অবস্থান এবং দেহের শক্তির কেন্দ্র এ মূলাধার। মূলাধারে দেহের সমস্ত শক্তি সুপ্তাবস্থায় সঞ্চিত থাকে। আমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যে তিনটি নাড়ী আছে। মেরুদণ্ডের বামদিকে ইড়া (চন্দ্রনাড়ী) এবং ডানদিকে পিঙ্গলা (সূর্যনাড়ী) এবং মেরুদণ্ডের মাঝখানে সুসুর্মা নাড়ীর অবস্থান। ইড়া এবং পিঙ্গল আজ্ঞাবাহী নাড়ী এবং মস্কিষ্কের আদেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেহের মধ্যে এগুলি কাজ করে। সাধারণ মানুষের দেহে সুসুর্মা নাড়ীর কোনো কার্যকারিতা নেই এবং এর নিম্নাংশ বদ্ধ থাকে। যোগীরা যোগসাধনার দ্বারা সুসুর্মা নাড়ীর নির্মাংশ খুলে ফেলেন এবং শক্তি ঊর্ধ্বমুখে চালিত করেন।

আজ ২১ জুন “আন্তর্জাতিক যোগ দিবস”। পৃথিবীর সকল দেশেই এ দিবস পালিত হচ্ছে। যোগের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করাই আন্তর্জাতিক যোগ দিবসের উদ্দেশ্য। এ বছর সৌদি আরবের সরকার তাদের দেশের স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যোগ অনুশীলন বাধ্যতামূলক করেছে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে যোগ অনুশীলনে মানুষের আগ্রহ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর সকল মানুষ যোগ অনুশীলনের মাধ্যমে দিব্য, যোগ্যময় জীবনযাপন করে সুস্থ, সবল, কর্মক্ষম দেহ এবং দীর্ঘজীবন লাভ করুক- “আন্তর্জাতিক যোগ দিবস”-এ এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভস।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: