রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৫৬ অপরাহ্ন

কোরবানির বর্জ্য পরিবেশ সম্মতভাবে অপসারণ – সেলিনা আক্তার

ধর্মপ্রাণ মানুষ সবসময়ই সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের আশায় থাকে। প্রত্যেক মুসলমান ওয়াজিব হিসেবে কোরবানিতে অংশগ্রহণ করে থাকে। কোরবানি মহিমার বিষয়, শুধু পশু জবাই নয়, এর সাথে ত্যাগ এবং পরিচ্ছন্নতার বিষয় জড়িত। মুসলমানগণ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহার দিন বা পরবর্তী দুদিন পশু কোরবানি দিয়ে থাকে।

ঈদুল আজহার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি করা। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী কোরবানির জন্য এ বছর দেশে কোরবানিযোগ্য মোট গবাদিপশুর সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখের ও বেশি রয়েছে। এ বছর কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর মধ্যে ৪৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৫২ টি গরু- মহিষ, ৭৬ লাখ ৯০ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং ২ হাজার ৫৮১ টি অন্যান্য প্রজাতির গবাদিপশু। এসব কোরবানির একটা বড়ো অংশ ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় সম্পন্ন হবে।

পশু কোরবানির পর সৃষ্ট বর্জ্য পরিষ্কার করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয় সুষ্ঠুভাবে কোরবানি না দিলে প্রতিবছরই পরিবেশের দূষণ ঘটে যা ধর্মীয় এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য। যত্রতত্র কোরবানি দেওয়া; চামড়া, রক্ত, ব্যবহৃত চাটাই ইত্যাদি যাবতীয় আবর্জনা যেখানে-সেখানে ফেলে দেওয়ার ফলে খুব দ্রুত জীবাণু সংক্রমণসহ দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। এতে বায়ু, পানি ও মাটি- তিনটি প্রাকৃতিক উপাদানই দূষিত হয় যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে।

বর্জ্য অপসারণ করার একটি উপায় হলো কোরবানির আগেই বাড়ির পাশে কোনো মাঠে কিংবা পরিত্যক্ত জায়গায় একটা গর্ত খুঁড়ে রাখা। কোরবানির পর পশুর বর্জ্য সেখানে ফেলে মাটিচাপা দেওয়া। তবে শহরাঞ্চলে গর্ত খোঁড়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, যাতে পানি ও গ্যাসের পাইপ, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের তার ইত্যাদি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার একটি উপায় হলো গ্রামাঞ্চলে অনেকের পশু একত্রে কোরবানি করা এবং পশুর বর্জ্য মাটির নিচে পুতে রাখা, যা পরবর্তী বছর কোরবানির আগেই জৈবসার হিসেবে শস্যক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী হয়ে যায়। পশু জবাই করার পর রক্ত সাথে সাথে ধুয়ে ফেলতে হবে। রক্ত ধোয়া পানি যেন রাস্তা বা বাড়ির আঙ্গিনায় জমে না থাকে সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। প্রবাহমান নর্দমায় বইয়ে দিতে হবে। এ পানি স্থির হয়ে জমে থাকলে তাতে দুর্গন্ধ ছড়াবে, মশা ও জীবাণু জন্মাবে এবং এক সময় শুকিয়ে ধুলা-বালির সাথে উড়ে মানুষের খাদ্যের সাথে দেহে প্রবেশ করবে। এসব থেকে বাঁচতে একটু ত্যাগ স্বীকার করে পশুর রক্ত ভালো করে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করে ফেলতে হবে।

সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুফল এবং অব্যবস্থাপনার কুফল সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। তবে যেসব এলাকায় গর্ত খোঁড়ার উপযুক্ত জায়গা নেই, সেসব এলাকার বর্জ্য প্রচলিত উপায়ে অপসারণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে করে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার দায়িত্বভার কিছুটা হলেও কমবে। পাশাপাশি বর্জ্যগুলো নষ্ট না হয়ে কাজেও লাগবে। যারা শহরে থাকেন, তাদের বিচ্ছিন্ন স্থানে কোরবানি না দিয়ে কয়েকজন মিলে একস্থানে কোরবানি দেওয়া ভালো। এতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাজ করতে সুবিধা হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, কোরবানির জায়গাটি যেন খোলামেলা হয়। আর জায়গাটি রাস্তার কাছাকাছি হলে বর্জ্য অপসারণের গাড়ি পৌঁছানো সহজ হবে। কুকুর বা বিড়াল যেন বর্জ্য নিয়ে আশপাশে ফেলতে না পারে, সেদিকেও সবার খেয়াল রাখা উচিত। যেসব এলাকায় সিটি করপোরেশনের গাড়ি পৌঁছানো সম্ভব নয়, সেসব স্থানের বর্জ্য ব্যাগ বা বস্তায় ভরে ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে রাখা উচিত।

যত্রতত্র কোরবানি না দিয়ে কর্তৃপক্ষের নির্বাচিত নির্দিষ্ট জায়গায় কোরবানি দেয়া হলে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। এসব জায়গায় কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই সব ধরনের সহায়তার ব্যবস্থা করে থাকে। ফলে কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই কোরবানি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মোট ৭৫টি ওয়ার্ড রয়েছে। এগুলোকে ১০টি জোনে ভাগ করা আছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মোট এলাকা প্রায় ১১০ কিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি ২০ লাখ। এখানে অনুমোদিত ডাস্টবিন আছে চার হাজার ১৫৫টি। পরিচ্ছন্নতা কর্মী আছে পাঁচ হাজার ৪০০। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণের জন্য এরই মধ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করে সম্মানিত নাগরিকদের করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার শুরু করেছে। যদিও তিন দিনের মধ্যে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণের কথা বলা হয়, তবে কোরবানির দিনই অধিকাংশ বর্জ্য অপসারণের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মোট ৫৪টি ওয়ার্ড রয়েছে। এগুলোকে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। উত্তর সিটি করপোরেশনে মোট জনসংখ্যা কমবেশি এক কোটি। মোট আয়তন ১৯৬ বর্গকিলোমিটারের ও বেশি। পশু কোরবানি কার্যক্রম ছাড়াও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গেল বছরের ন্যায় এবারও উত্তর সিটির নির্ধারিত স্থানে কোরবানি দেওয়ার জন্য নগরবাসীর প্রতি আহবান জানিয়েছে। সেই সঙ্গে নগরবাসীর সুবিধায় থাকবে সিটি করপোরেশনের পরিবহণ ব্যবস্থাও। এছাড়াও পশু কোরবানির পরবর্তী বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। কোরবানির বর্জ্য দ্রুত সময়ে অপসরণে প্রায় ১০ হাজার কর্মী কাজ করবে। এরমধ্যে ডিএনসিসির ২৮টি ওয়ার্ডে নিজস্ব ২ হাজার ১১৭ জন কর্মী কাজ করবেন। এছাড়া ২৬টি ওয়ার্ডে বেসরকারি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগে ২ হাজার ৯০০ জন থাকবেন এবং ৩৬টি ওয়ার্ডে পিডাব্লিউসিএসপির কর্মী কাজ করবেন ৪ হাজার ৫০০ জন। আর স্পেশাল ক্লিনার হিসেবে কাজ করবেন ১৫০ জন। এছাড়াও ঈদে ওয়ার্ডভিত্তিক বর্জ্য সংগ্রহ কাজে ভাড়ায় নিয়োজিত পিকআপের কর্মী থাকবে ৩২৪ জন। সেই সঙ্গে নিজস্ব যন্ত্রপাতির পাশাপাশি ডাম্প ট্রাক, খোলা ট্রাক ১৫০টি, ভারী যন্ত্রপাতি ৪৭টি ও ১০টি পানির গাড়ি থাকবে। আর ওয়ার্ডভিত্তিক বর্জ্য সংগ্রহ কাজে ভাড়ায় নিয়োজিত পিকআপ প্রথম দিনে থাকবে ১০৮টি ও দ্বিতীয় দিনে থাকবে ৫৪টি। সবমিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার কর্মী কোরবানির বর্জ্য অপসারণের কাজে নিয়োজিত থাকবে। এসব সরঞ্জাম ও জনবলের মাধ্যমে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। উত্তর সিটি করপোরেশনের সম্মানিত মেয়র এরই মধ্যে নগরবাসীর কাছে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণের বিষয়ে সহায়তা চেয়েছেন। অবৈধ পশুর হাট যেন না বসে, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে। পশু কোরবানির ক্ষেত্রে কোনোরকম সমস্যা যাতে না হয়, সেজন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে । এছাডাও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করা হবে। অধিদপ্তরের হটলাইন ১৬৩৫৮ চালু থাকবে। পশু পরিবহণে খামারিদের সমস্যা সমাধানে এ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ কাজ করবে।

আমাদের দেশ ধীরে ধীরে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে সব লেনদেন হবে স্মার্টলি। নগদ অর্থ ছাড়াই লেনদেন নিশ্চিত করতে উত্তরের আটটি কোরবানির হাটকে এবার ডিজিটাল পেমেন্টের আওতায় আনা হয়েছে। এই হাটগুলো হলো উত্তরা দিয়াবাড়ি হাট, ভাটারা (সাইদ নগর) হাট, কাওলা শিয়াল ডাঙ্গা হাট, আফতাবনগর হাট, মোহাম্মদপুর বছিলা হাট, মিরপুর গাবতলী গবাদিপশুর হাট, মিরপুর সেকশন-৬ হাট, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট হাট। তেমনি কোরবানির পশুর হাটে ক্যাশলেস লেনদেন করা যাবে। ইতোমধ্যে ১০ হাজার খামারির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে এই লেনদেনের জন্য।

কোরবানির পশু হাটে ডিজিটাল লেনদেন চালুকরণ এবং প্রান্তিক পশু বিক্রেতাদের ব্যক্তিক রিটেইল হিসাবের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল পেমেন্ট উদ্যোগের পাইলট কার্যক্রম গ্রহণ করে। সে সময় কোরবানির হাটে ৩৩ কোটি টাকা ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেন হয়। এবার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দেড় শ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগের আওতাধীন এই কার্যক্রমটিতে ২৬টি জেলার পশু বিক্রেতাদের ব্যক্তিক রিটেইল হিসাব খোলার বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে।

নগরবাসীকে সচেতন করতে প্রচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রচারপত্র মুদ্রণসহ সম্মানিত কাউন্সিলরদের সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক পশু জবেহ করার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। ৫৪টি ওয়ার্ডের মাংস ব্যবসায়ী নির্বাচন করে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং নগরবাসীর মধ্যে লিফলেট বিতরণ শুরু হয়েছে। অঞ্চলভিত্তিক সম্মানিত কাউন্সিলর, সহঃপ্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এবং পিডাব্লিউসিএসপি’র সঙ্গে সমন্বয়সভা করে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। জনসচেতনতামূলক শোভাযাত্রা, টেলিভিশন, রেডিও, পত্রিকা ও গাড়ির সাহায্যে জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য ব্যাপক কার্যক্রমসহ মসজিদে ইমামদের মাধ্যমে খুতবায় আলোচনার জন্য অনুরোধ করে পত্র পাঠানো হয়েছে। বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহকারী পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব ও লক্ষ্য বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওয়ার্ডভিত্তিক বর্জ্য অপসারণের লক্ষ্যে তদারকির জন্য মনিটরিং টিম গঠন ও কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে বর্জ্য রাখার ব্যাগ, ব্লিচিং পাউডার এবং স্যাভলন বিতরণ সম্পন্ন করা হবে। ঈদুল আজহার আগের দিন প্রত্যেক অঞ্চলে অতিরিক্ত যানবাহন বরাদ্দকরণ ও পশু জবেহ করার স্থানসহ ল্যান্ড ফিল প্রস্তুত করা হবে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ গণযোগাযোগ অধিদপ্তর ও তথ্য অধিদফতর এ প্রচার কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং সকল প্রিন্ট মিডিয়াতেও তা প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কোরবানির পর আমাদের সচেতনতাই পারে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ স্বাস্থ্যকর হিসাবে বজায় রাখতে। পাশাপাশি আমরা যেন শুধু পশু কোরবানির মাধ্যমেই ‘ত্যাগ’ শব্দটি সীমাবদ্ধ না রাখি। আমাদের ত্যাগ যেন সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের প্রতীক হয়- সেদিকেও আমরা নজর রাখতে হবে। কোরবানির মাধ্যমে শুধু আত্মত্যাগ নয়, আত্মসচেতনতার শিক্ষাও নিতে হবে। কারণ পশু জবাইয়ের ফলে সৃষ্ট বর্জ্য যদি পরিবেশ দূষণ করে তবে তা ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। প্রত্যেকের সচেতনতায় কোরবানিদাতার আত্মার শুদ্ধতার পাশাপাশি পরিবেশের শুদ্ধতাও নিশ্চিত হবে- এ প্রত্যাশা সকলের।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: