শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১৫ পূর্বাহ্ন

করোনাভাইরাস, কোয়ারেন্টাইন এবং শিশু সুরক্ষা

বৈশ্বিক এই সংকটের সময়ে কোয়ারেন্টাইন, লকডাউন ইত্যাদির মাঝেও শিশুদের সুরক্ষার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়াটাও অত্যন্ত জরুরি। দুর্যোগকালীন সময়ে শিশুদের প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। অভিভাবক বা দায়িত্ববাহকরা দুর্যোগের আতঙ্কের মাঝে থাকেন, জীবিকার ও জরুরি জীবন ধারণের বিষয়ে নিয়োজিত থাকেন। ফলে শিশুদের সুরক্ষার ব্যাপারে বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার বিষয়টা অনেকটা কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে যায়। এক কথায়, জীবন ও জীবিকা তখন মুখ্য হয়ে যায়, শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থার বলয় দুর্বল হয়ে পড়ে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং এর কারণে সৃষ্ট আর্থ-সামাজিক ভঙ্গুর অবস্থার মাঝেও শিশুদের সুরক্ষার ব্যাপারে তাই গুরুত্ব দেওয়া অনেক জরুরি।

অপ্রত্যাশিত এই সংকটের কারণে অভাব, আতঙ্ক, মানসিক চাপ সব মিলিয়ে মা-বাবার মাঝে মনো-সামাজিকভাবে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিশুদের পক্ষে সারাদিন বাড়িতে চুপচাপ হয়ে থাকাটা একদম কঠিন ব্যাপার। টানা ঘরে থাকা, বাইরে খেলতে না পারা ইত্যাদি কারণে একঘেয়েমি, অস্থিরতা বা মেজাজ খিটখিটে হতে পারে। ফলে শিশুরা জেদ বা মন্দ আচরণ করতে পারে। কিন্তু শিশুর অস্থির আচরণের কারণে বড়দের মাঝে বিরক্তি ও রাগের উদ্রেক হচ্ছে। বেকারত্ব, কর্মহীনতা, একাকিত্ব বা সঙ্গনিরোধ ইত্যাদি বড়দের আরও মানসিক চাপ ও মেজাজ রুক্ষ করে দিচ্ছে। এতে পারিবারিক পর্যায়ে মা-বাবা কিংবা অন্য অভিভাবকদের দ্বারাই শিশুরা শারীরিক ও মানসিক শাস্তি এবং অবহেলাজনিত নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকছে। যেসব শিশু আগে থেকেই সুরক্ষার ক্ষেত্রে একটা বিপদাপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়, দুর্বল বা নেতিবাচক প্যারেন্টিং চর্চার মাঝে ছিল, তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঝুঁকি আরও বেড়ে গেছে। বড়দের পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে শিশুরা বিভিন্নভাবে আঘাত বা ইনজুরির শিকার হতে পারে। ছোট শিশুদের মাঝে খেলার সামগ্রী বা অন্যন্য ধারালো জিনিস দিয়ে খেলতে গিয়ে আঘাত বা জখমের ঝুঁকিও কোনো অংশে কম নয়।

করোনাভাইরাসের কারণে শিশুদের যৌন সহিংসতার ঝুঁকিও অনেক বেশি। অধিকাংশ পরিবারের আয় কমে যাওয়া, দারিদ্র্যতা এবং অন্যের সহায়তা ও নির্ভরশীলতার ওপর খাদ্যের সংস্থান হওয়া এই ঝুঁকিটা অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেকেই অভাবের সুযোগ নিয়ে শিশুদের খাবার বা অন্যান্য সহযোগিতার প্রলোভন দেখিয়ে যৌন শোষণ করতে পারে, পাচার ও যৌনকাজে লিপ্ত করতে পারে। পাশাপাশি, পরিবারের অর্থনৈতিক কষ্ট লাঘবের নেতিবাচক উপায় হিসেবে অনেক মেয়ে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকছে; অনেক শিশুরই ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে সংযুক্তির আশঙ্কা অবশ্যই আছে। পরিবারের অর্থনৈতিক ঘাটতি বা সংকটের কারণে নির্যাতনকারীরা শিশুদের খুব সহজেই বাল্যবিয়ে, শিশুশ্রম ও গৃহকর্মী হিসেবে নিযুক্ত, পাচার এবং যৌন শোষণ ও সহিংসতার শিকার করার সুযোগের অপেক্ষায় তৎপর থাকে। করোনাভাইরাসের এই মহামারিতে সবার মনোযোগ যখন সংক্রমণ থেকে বেঁচে থাকা, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া, জীবনরক্ষাকারী দ্রব্যসামগ্রী নিশ্চিত করা, তখন নির্যাতনকারীদের এই তৎপরতা বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

স্বাভাবিক সময়েই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নির্যাতনের ঝুঁকির মাত্রা অন্য শিশুদের তুলনায় বেশি; সেখানে করোনার এই মহাদুর্যোগে তাদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার ঝুঁকি অনেক বেশি বেড়ে গেছে। নগরের ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এলাকার শিশু, রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাসকারী শিশুরা স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বস্তি বা ক্যাম্পগুলোতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা কিংবা শিশুদের বাড়ির পরিবেশে খেলার সুযোগ নেই। বাবা-মা খাবার ও আয়ের সন্ধানে বাড়ির বাইরে যাচ্ছে, যা শিশুদের তদারকিবিহীন অবস্থায় ফেলছে এবং তাদের অন্যান্য নির্যাতনের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। পথে-ঘাটে চলাফেরা, যেখানে সেখানে দলবদ্ধভাবে অবস্থান ও রাত যাপনের কারণে পথশিশুরাও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও এর বাহক হওয়ার ঝুঁকিতে আছে (কালের কণ্ঠ, ১২ এপ্রিল) বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। এর পাশাপাশি পথশিশুদের শোষণ ও নির্যাতনের ঝুঁকিও অনেক বেড়ে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে পথশিশুদের আয়ের সুযোগ থাকত, যা দিয়ে তারা নিজেদের মতো খাবার সংগ্রহ করতে পারত। কিন্তু এই লকডাউন অবস্থায় পথশিশুরা পুরোপুরি অন্যের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। এই সংকটের সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ যৌন নির্যাতন ও শোষণের কাজ করতে পারে, খাবার বা সাহায্য করার বিনিময়ে কেউবা তাদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগাতে পারে, যা তাদের সুরক্ষাকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে।

করোনা ও কোয়ারেন্টাইনকালে মানসিক স্বাস্থ্য এবং মনোসামাজিক ক্ষেত্রে নির্যাতনের ঝুঁকিও কম নয়। পরিবারের কোনো সদস্য কিংবা অভিভাবক যদি করোনা আক্রান্ত হয় কিংবা মারা যায়, সে ক্ষেত্রে সেই পরিবারের শিশুদের সুরক্ষার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে। কোয়ারেন্টাইন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আক্রান্ত বা সম্ভাব্য আক্রান্ত মা-বাবা বা প্রাথমিক অভিভাবক থেকে দূরে থাকা শিশুদের মাঝে ভয়ের সৃষ্টি করবে, তাদের আরও বেশি বিপদাপন্ন করে তুলবে। শিশুরাও আক্রান্ত হয়ে কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে থাকতে হতে পারে। এতে করে শিশুদের মনোসামাজিক জগতে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে, তারা এক ধরনের ট্রমার মধ্যে পতিত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে। কোনো ক্ষেত্রে আক্রান্ত পরিবারের প্রতি প্রতিবেশীদের নেতিবাচক অবস্থান, কলঙ্ক আরোপ করা তথা বৈষম্যমূলক আচরণও শিশু সুরক্ষার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় ঝুঁকি। অভিভাবকের করোনাভাইরাসজনিত মৃত্যু বা আক্রান্ত হওয়ার কারণে কোনো কোনো পরিবারে শিশুদের একা হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও অস্বাভাবিক হবে না।

শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিগত সময়গুলোতে বিশ্বব্যাপী অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, মানুষ অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। কভিড-১৯-এর অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে সে অর্জনগুলো যেন থমকে না যায়, এ লক্ষ্যে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। করোনাভাইরাসের এই মহাসংকটে লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা ইত্যাদির মাঝে বাড়িতে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনমুক্ত রাখতে সুস্থ প্যারেন্টিং চর্চা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুস্থ প্যারেন্টিং চর্চা এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের কিছু টিপস বা কৌশল পরামর্শ হিসেবে দিয়েছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও শিশুদের সঙ্গে করণীয়, করোনায় শিশুদের উপযোগী করে বার্তা প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ বা টিপস দিয়েছে, যা শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তির পরিবর্তে ইতিবাচক চর্চায় রাখার ক্ষেত্রে কার্যকর হবে। তাই স্বাস্থ্য বার্তার প্রদানের পাশাপাশি শিশু ও অভিভাবকদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য বার্তা ও মনোসামাজিক সেবাগুলোও কমিউনিটি বা জনসাধারণকে জানানো প্রয়োজন।

হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার, স্বাস্থ্য সচেতনতার বার্তাগুলো প্রদানের পাশাপাশি কভিড-১৯-এর ফলে শিশুদের বিপদাপন্নতা ও ঝুঁকি নিয়েও কমিউনিটি পর্যায়ে সমন্বিতভাবে বার্তা প্রদান করা যেতে পারে। সেবাপ্রদানকারীদের শিশু সুরক্ষাবিষয়ক ধারণা ও মূল বার্তা প্রদান করা যেতে পারে যাতে তার নির্যাতনের শিকার বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা শিশুকে চিহ্নিত করতে পারে। এতে শিশু সুরক্ষার ব্যাপারে একটি শক্তিশালী কেস ম্যানেজমেন্ট প্রক্রিয়া স্থাপন করা সহজতর হবে, ঝুঁকিপূর্ণ শিশু চিহ্নিতকরণ এবং তাদের প্রয়োজনীয় সেবাপ্রদান সহজতর হবে। করোনাভাইরাস ও কভিড-১৯ সচেতনতায় বিভিন্ন পোস্টার ও আচরণ পরিবর্তন উপকরণগুলো প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে শিশুবান্ধব উপকরণ তৈরির করলে শিশুদের আরও বেশি সচেতন ও সুরক্ষিত থাকতে সহায়তা করবে। সামাজিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত ও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা আবশ্যক। যদি এসব পরিবারের কোনো সদস্য আক্রান্ত হয়, শিশুরা অভিভাবক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তাহলে তাদের সমাজসেবার মাধ্যমে পর্যাপ্ত কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থায় রাখা, মনোসামাজিক সেবা প্রদান করা জরুরি। কোনো শিশু পিতামাতার মুত্যুর কারণে অভিভাবকহীন হয়ে পড়লে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক বা স্বজনদের কাছে বিকল্প সেবার আওতায় নিয়ে আসার ব্যাপারেও ভাবতে হবে।

দুর্যোগেও বিদ্যালয় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে শিশুদের শিক্ষার অধিকার যেন বিঘ্নিত না হয় সে লক্ষ্যে সরকারিভাবে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, টেলিভিশনের মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রম চলমান আছে। পাশাপাশি বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, সরকারের মুক্তপাঠ ইত্যাদির মাধ্যমেও শিশুরা শিখতে পারছে। এই মাধ্যমগুলোতেও শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের সুরক্ষা, সুস্থ ও ইতিবাচক প্যারেন্টিং টিপস বা কৌশল, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং মনোসামাজিক সেবা ও মানসিক স্বাস্থ্যের বার্তাগুলো প্রচার করা জরুরি। এতে করে বাড়িতে ও কমিউনিটি পর্যায়ে কভিড-১৯ মহামারির সময়েও শিশুদের সুরক্ষিত পরিবেশ প্রদানের ব্যাপারে সবাই সজাগ হবে বলে আশা করা যায়। পাশাপাশি শিশুরাও নিজেদের সুরক্ষার ব্যাপারে সচেতন হবে এবং সম্ভাব্য নির্যাতনের ঝুঁকি থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে ভূমিকা রাখতে পারবে।

ম্যানেজার, শিশু সুরক্ষা, শিশুদের জন্য কর্মসূচি, সেভ দ্য চিলড্রেন


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: