শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ১১:২৪ পূর্বাহ্ন

রোহিঙ্গাদের রেখে দেয়ার প্রস্তাব : স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ

বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কাছে সম্প্রতি যে ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’ শীর্ষক পলিসি পেপার পাঠানো হয়েছে, তা অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অগ্রহণযোগ্য। এই ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় ঋণ সুবিধা দেওয়ার নামে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, যা কেবল হাস্যকরই নয়; একইসঙ্গে ধৃষ্টতার শামিল। বস্তুত এর মাধ্যমে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপের অপচেষ্টা করা হয়েছে, যা কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না। ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, ইতঃপূর্বে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়েও বিশ্বব্যাংকের আচরণ ও কর্মকান্ড অগ্রহণযোগ্য এবং বিতর্কিত ছিল। সংস্থাটি দুরভিসন্ধিমূলকভাবে একতরফভাবে দুর্নীতির কাল্পনিক অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে আর্থিক ঋণ সুবিধা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন হওয়ার পথে এবং এ প্রকল্প এখন আমাদের গর্বের বিষয়। বস্তুত পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঔদ্ধত্যপনার সমুচিত জবাব দেওয়া হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। একইভাবে মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংকের ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’-এর জবাব দেওয়া জরুরি।

ইতিহাস অনুযায়ী, আরাকান (রাখাইন) বহু বছর আগে থেকেই স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য ছিল এবং সেখানকার শাসন ও বিচার ব্যবস্থায় মুসলমানরা বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধান কাজী ইত্যাদি বিভিন্ন পদে মুসলমানদের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মহাকবি আলাওলসহ অনেক কবি-সাহিত্যিক আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের মানবিক ধারার সূচনা করেছেন। মোগল আমলের আগে আরাকান চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং এ কারণে চট্টগ্রামের অনেকে সেখানে বসবাস শুরু করেন। সুতরাং, আরাকান তথা রাখাইন অঞ্চলে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলমানরা ঐতিহাসিকভাবেই সেখানকার নাগরিক; তারা অভিবাসী নন। এ ঐতিহাসিক সত্য সামনে রেখে বিশ্বব্যাংকের বরং এমন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যাতে মিয়ানমার চিরতরে হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়ন বন্ধ করে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সে দেশে ফেরত নিয়ে তাদের নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখার বিষয়ে যত্নবান হয়। আশ্চর্যজনক হলো, বিশ্বব্যাংক এদিকটায় মনোযোগ না দিয়ে ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানোর মতলব করেছে। বিশ্বব্যাংকের রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্কের পক্ষে মত দিলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের যে কোনো স্থানে অবাধ চলাচলই শুধু নয়; চাকরি অথবা ব্যবসাও করতে পারবে। এ ছাড়া নিবন্ধনের আওতায় এনে তাদের সামাজিক পরিচয়পত্রও দিতে হতে পারে। এমন কী, এর ফলে রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমে ফেরত পাঠানোর বদলে এদেশেই চিরতরে রেখে দিতে হতে পারে, যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। দেশে এমনিতেই পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের জন্য দেশের শ্রমবাজার উন্মুক্ত করে দিলে সর্বত্র এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে; উপরন্তু যেসব রোহিঙ্গা বর্তমানে মিয়ানমারে রয়েছে, তারাও এ দেশে আসতে উৎসাহী হবে, যা মোটেই কাম্য নয়। ২০০২ সালে যখন মাত্র ১৯-২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ছিল, তখন ইউএনএইচসিআরের পক্ষ থেকেও এ দেশে তাদের অবাধ চলাচলের পক্ষে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রস্তাবটি সে সময় প্রত্যাখ্যান করেছিল। এ ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবও কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আমরা এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: