বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১২:৪৭ পূর্বাহ্ন

মুনাফায় বড় চমক বেক্সিমকো-বিএসসি-বার্জারের, অধিকাংশের দুরবস্থা

নিউজ ডেস্ক :: চলমান হিসাব বছরে মুনাফায় বড় ধরনের চমক দেখিয়েছে তিন কোম্পানি। শেয়ারবাজারে আলোচিত প্রতিষ্ঠানের তালিকায়ও স্থান করে নিয়েছে তারা। বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি (বেক্সিমকো) ও বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) সঙ্গে বড় মুনাফা করেছে বহুজাতিক কোম্পানি বার্জার পেইন্টস। এই তিন প্রতিষ্ঠান ভালো ব্যবসা করলেও বিবিধ খাতের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান দুরবস্থায়।

দেশের বাজারে বছরের পর বছর ধরে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে বার্জার পেইন্টস। নিয়মিত মোটা অঙ্কের মুনাফা করার পাশাপাশি ভালো লভ্যাংশ দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের আস্থাও অর্জন করেছে। ফলস্বরূপ কোম্পানিটির শেয়ার দামের দিক থেকে অবস্থান করে নিয়েছে শীর্ষ পাঁচে।

নিয়মিত ভালো ব্যবসা করা কোম্পানিটি চলমান হিসাব বছরের প্রথম নয় মাসেও মোটা অঙ্কের মুনাফা করেছে। মার্চে হিসাব বছর সমাপ্ত করা প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৪৩ টাকা ১৮ পয়সা, যা আগের হিসাব বছরের একই সময়ে ছিল ৩৬ টাকা ৩ পয়সা। অর্থাৎ মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০ শতাংশ। মুনাফায় এমন প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কোম্পানিটির সম্পদমূল্যও বেড়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩৮ টাকা ৪৫ পয়সা, যা মার্চে ছিল ২৩২ টাকা ৭৮ পয়সা। অর্থাৎ নয় মাসে শেয়ারপ্রতি সম্পদ বেড়েছে ৫ টাকা ৪৭ পয়সা।

বার্জার পেইন্টসের মতো ধারাবাহিকতা না থাকলেও চলমান হিসাব বছরে বড় ধরনের চমক দেখিয়েছে বেক্সিমকো। প্রথম ছয় মাসের (২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বর) ব্যবসায় কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৮ টাকা ৬৭ পয়সা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে যা ছিল এক টাকা ৯২ পয়সা। অর্থাৎ মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫২ শতাংশ। এর আগে প্রতিষ্ঠানটি মুনাফায় এমন চমক আর দেখায়নি।

মুনাফায় বড় চমক দেখানো কোম্পানিটির সম্পদেও বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ৮৩ টাকা ৭২ পয়সা, যা জুনে ছিল ৭৮ টাকা ২৮ পয়সা। অর্থাৎ ছয় মাসে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য বেড়েছে ৫ টাকা ৪৪ পয়সা।

বেক্সিমকোর পাশাপাশি চলমান হিসাব বছরে বড় চমক দেখিয়েছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠানটি সবশেষ ২০২১ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, তিন মাসের ব্যবসায় কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৪ টাকা ৩৪ পয়সা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে যা ছিল ৫৮ পয়সা। অর্থাৎ মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬৪৮ শতাংশ।

মুনাফায় চমক দেখানো এই প্রতিষ্ঠানটির সম্পদমূল্যও বড় অঙ্কে বেড়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ৬৪ টাকা ৬২ পয়সা, যা জুনে ছিল ৬০ টাকা ২৮ পয়সা। অর্থাৎ তিন মাসে শেয়ারপ্রতি সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৪ টাকা ৩৪ পয়সা।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বিবিধ খাতের এই তিন কোম্পানি ব্যবসায় এমন চমক দেখালেও এ খাতের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে মুনাফার দেখা পাচ্ছে না একাধিক প্রতিষ্ঠান। এমনকি আট বছরেও মুনাফার দেখা পায়নি এমন প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

বর্তমানে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় জি কিউ বলপেন। চলমান হিসাব বছরের প্রথম ছয় মাসে এই প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে এক টাকা ৬৯ পয়সা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ৪ টাকা ৯৭ পয়সা। ২০১৮ সাল থেকেই প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে নিমজ্জিত।

লোকসানের ভারে ন্যুব্জ কোম্পানিটির সম্পদেও নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ১৩৭ টাকা ৪৯ পয়সা, যা ছয় মাস আগে অর্থাৎ জুনে ছিল ১৪০ টাকা।

এর পরের স্থানেই রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান উসমানিয়া গ্লাস শিট। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের ব্যবসায় কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে এক টাকা ৫৭ পয়সা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় তিন টাকা ৩৫ পয়সা। এ প্রতিষ্ঠানটিও বছরের পর বছর লোকসান করছে।

লোকসানে নিমজ্জিত হওয়া কোম্পানিটির সম্পদেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদ দাঁড়িয়েছে ৮৪ টাকা ২৮ পয়সা, যা জুনে ছিল ৮৫ টাকা ৮২ পয়সা।

লোকসানের মধ্যে পতিত হওয়ার এ তালিকায় রয়েছে খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ, মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ, ন্যাশনাল ফিড ও সাভার রিফ্রাক্টরিজ। এর মধ্যে খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ, মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ ও সাভার রিফ্রাক্টরিজের লোকসানের পাশাপাশি সম্পদমূল্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একই সঙ্গে দেখা দিয়েছে তারল্য সংকট।

খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ চলমান হিসাব বছরের ছয় মাসে শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ১২ পয়সা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ৯ পয়সা। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ১২ টাকা ১৪ পয়সা, যা জুনে ছিল ১২ টাকা ২৬ পয়সা। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৫ পয়সা।

মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে এক টাকা ২১ পয়সা। এরপর প্রতিষ্ঠানটি আর কোনো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিয়মিত মুনাফা করা প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে এসে লোকসানের মুখে পড়ে।

লোকসানে থাকা এ কোম্পানিটির সম্পদেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ২০২১ সালের মার্চ শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ দাঁড়িয়েছে ৩১ টাকা ১ পয়সা, যা ২০২০ সালের মার্চে ছিল ৩২ টাকা ৩১ পয়সা। একই সঙ্গে তারল্য সংকটেও পড়েছে কোম্পানিটি। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে শেয়ারপ্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৭৪ পয়সা।

আরেক প্রতিষ্ঠান সাভার রিফ্রাক্টরিজ ২০২১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ৫৩ পয়সা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ৪৪ পয়সা। লোকসানের পরিমাণ বাড়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের মূল্য কমে অর্ধেকের নিচে চলে এসেছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদ দাঁড়িয়েছে ৪১ পয়সা, যা জুনে ছিল ৯৪ পয়সা। শেয়ারপ্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক এক টাকা ৭৪ পয়সা।

চলমান হিসাব বছরে লোকসানের মধ্যে পতিত হওয়া আরেক কোম্পানি ন্যাশনাল ফিড। এ প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ১ পয়সা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ৫৫ পয়সা।

এদিকে মুনাফায় থাকলেও তিন প্রতিষ্ঠানের মুনাফা আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে। এর মধ্যে ইনডেক্স অ্যাগ্রো ২০২১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর এই ছয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ২ টাকা ৬৩ পয়সা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে যা ছিল ৩ টাকা ৩৬ পয়সা। সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারপ্রতি মুনাফা ৭৩ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ৫৮ পয়সা। এসকে ট্রিমস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারপ্রতি মুনাফা ৮৬ পয়সা থেকে কমে ৪৯ পয়সা হয়েছে।

অন্যদিকে বিবিধ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হওয়ার তালিকায় রয়েছে আমান ফিড ও আরামিট লিমিটেড। এর মধ্যে আমান ফিড ২০২১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর এই ছয় মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে এক টাকা ৮৫ পয়সা, যা আগের হিসাব বছরের একই সময়ে ছিল এক টাকা ৬৬ পয়সা। আরামিট ২০২১ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে এক টাকা ১৪ পয়সা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ৬৭ পয়সা।

যোগাযোগ করা হলে জি কিউ বলপেনের কোম্পানি সচিব উজ্জ্বল কুমার শাহ জাগো নিউজকে বলেন, করোনার কারণে আমাদের ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে। আমরা বলপেনের ব্যবসা করি। করোনার কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় আমাদের বিক্রি কমেছে। এ কারণে লোকসান হয়েছে।

তবে করোনার শুরু হওয়ার আগে ২০১৯ ও ২০১৮ সালেও জি কিউ বলপেন লোকসান করে। এর কারণ জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান উজ্জ্বল কুমার শাহ। তিনি বলেন, আমাদের সবকিছু বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা আছে। মূলত করোনার কারণেই আমাদের ব্যবসায় লোকসান হয়েছে।

বছরের পর বছর লোকসানে নিমজ্জিত থাকার কারণ হিসেবে সাভার রিফ্রাক্টরিজের কোম্পানি সচিব বেলায়েত হোসেন খান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের গ্যাসের সমস্যা আছে। কাঁচামাল এবং মাটিরও সমস্যা রয়েছে। এ কারণে ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে। ২০১৪ সালের আগে থেকেই আমরা এ সমস্যার মধ্যে পড়েছি।

আট বছরেও সমস্যার সমাধান না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। কিন্তু সমাধান হচ্ছে না। এখনো গ্যাসের সমস্যা রয়েছে। তাছাড়া আমাদের উৎপাদন খরচ ও বাইরের উৎপাদন খরচের মধ্যে অনেক পার্থক্য। আমাদের উৎপাদন খরচ বেশি।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: