রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ১১:৫৬ পূর্বাহ্ন
মফস্বল শহরের ডাক্তার বাবা আর কলেজ শিক্ষক মার একমাত্র সন্তান রূপা সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে মেডিক্যালে ভর্তির জন্য কোচিং শুরুর পরিকল্পনা করছে। একদিন মার সাথে শহরের বিভিন্ন মেডিক্যাল কোচিং সেন্টারগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলো, রূপা জানার চেষ্টা করল কোচিং সেন্টারগুলোতে মেডিক্যালে ভর্তির প্রস্তুতির জন্য কী কী সুযোগ সুবিধা আছে। এরকমই এক কোচিং সেন্টারে একজনের সাথে কথা হয় রূপার। কথা বলতে তেমন কিছুই না, ভর্তি সংক্রান্ত দুই একটি কথা। তখন পাশেই ছিল মা। দুপুর নাগাদ বাসায় এসে ফ্রেস হয়ে লাঞ্চ শেষে রেস্ট করলো। রাতে ল্যাপটপ অন করতেই দেখে তার ফেসবুকে কে যেন একটি ভিডিও ক্লিপিংস পাঠিয়েছে। ভিডিও ক্লিপিংস এ ক্লিক করতেই চমৎকার একটি গান স্কিনে ভেসে ওঠে ‘ প্রেমে পড়া বারন, কারণে অকারণ. ……। ‘ গানটি রূপারও খুব প্রিয়। দুই, তিন, চার… এভাবে কয়েক বার শুনার পর কে পাঠালো ভিডিওটি সেটা খুঁজে বের কারার চেষ্টা করলো। তবে পরিচিত কেউ না হওয়ায় এটা বাদ দিয়ে অন্য কাজে মন দিল। এভাবে কয়েক দিন চলল। তবে প্রতিদিনই কয়েকবার গানটি শোনে। গানটির প্রতি তার একধরনের মোহ দেখা দিল। দিন পাচেক পরে এক রাতে হঠাৎ রূপা অসুস্থ হয়ে পড়ে। দ্রুত তাকে তার বাবার ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তেমন কোনো সমস্যা না পাওয়ায় একদিন পরেই বাসায় নিয়ে আসা হয়।
রূপা খুব ক্লান্ত, তার চারপাশের সবকিছু ঘুরছে, বমিবমি ভাব কিছুই খেতে মন চায় না। সারাক্ষণ এক আতঙ্কের মধ্যে থাকে রূপা। মা-বাবা খুব চিন্তিত, কি হলো মেয়েটির? একদিনের মধ্যেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। নানা রকম কুচিন্তা তাদের পেয়ে বসেছে। মেয়েকে সময় না দেওয়া, খোঁজ খবর না রাখা ইত্যাদি অভিযোগ রূপার বাবার। ঠিক একই অভিযোগ রূপার মারও। নিজেদের মধ্যে ছোট্ট একটা ঝগড়াও হলো রূপাকে নিয়ে তার মা -বাবার মধ্যে। চিকিৎসা চলছে, কিন্তু কোনো উন্নতি নেই, বরং রূপার অসুস্থতা বেড়েই চলছে। এক কান দুই কান করে আত্নীয় স্বজনরা সবাই জেনে গেছে রূপার অসুস্থতার কথা। নানা জনের নানা রকম পরামর্শ, রূপার মার অভিযোগ মেয়ের কোনো চিকিৎসাই হচ্ছে না। সিদ্ধান্ত হলো রূপাকে ঢাকায় বড়ো হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর। দ্রুতই মা বাবাসহ ঢাকায় এলো রূপা, নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলো তাকে। নানা রকম পরীক্ষা নীরিক্ষা শেষে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সিদ্ধান্ত দিলেন রূপা সম্ভবত ভার্টিগো রোগে আক্রান্ত। ভার্টিগো হচ্ছে এক ধরনের শারীরিক অনুভূতি যেখানে রোগীর মনে হয় তার চারপাশে পৃথিবী ঘুরছে অথবা স্হির পৃথিবীর চারপাশে রোগী ঘুরছে। এছাড়াও এ রোগের লক্ষণ হলো বমিবমি ভাব, শ্রবণশক্তি হ্রাস, কানে অস্বাভাবিক শো শো শব্দ শুনা ইত্যাদি । এ রোগটি পুরুষের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এ রোগটি সম্পর্কে মানুষের ধারণা ও কম। তবে এটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার দরকার আছে। ডাক্তার কথা শেষ করার আগে রূপাকে একজন মনোবিজ্ঞানীর নিকট রেফার করে তার মতামত নেওয়ার জন্য লিখে দিলেন।
রূপার বাবা ভুলেই গেলেন তিনি একজন ডাক্তার। নানা রকম দুঃচিন্তা পেয়ে বসেছে রূপার মা-বাবার। পরদিন সকালেই রূপাকে দেখতে এলেন একজন ত্রিশ- পয়ত্রিশ বসর বয়সি মহিলা মনোবিজ্ঞানী। প্রাথমিক পরিচয় পর্ব শেষে রূপাকে নিয়ে গেলেন তার চেম্বারে। বাইরে অপেক্ষায় রূপার মা-বাবা। অপেক্ষা আর শেষ হয় না। প্রায় দেড় ঘন্টা পর চোখ মুছতে মুছতে বের হলো রূপা। দেখেই অজানা এক আতঙ্কে কেঁপে উঠলো রূপার মা-বাবা। বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে? কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে মা-বাবা। কেবিনে যেয়েই শুয়ে পড়লো রূপা, কারো সাথে কোন কথা বলল না। রূপার মা কে রূপার কাছে রেখে রূপার বাবা ছুটে গেলে ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার অভয় দিয়ে বললেন সমস্যা নেই, অপেক্ষা করেন সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। ঘন্টা দুই পরে রূপার ছোট ফুফু’র ফোন পেয়ে ভেঙে পড়েছে রূপার বাবা। কি করবে, কাকে বলবে, কার সাহায্য নিবে এ কঠিন বিপদের সময়? কিছুই মাথায় আসছে না। সৃষ্টিকর্তাকে বারবার ডাকছে আর মনেমনে বলছে রহম করো আল্লাহ, বাঁচাও আমাদের। স্বামীর অসহায় অবস্থা দেখে রূপার মা জানতে চায় কি হয়েছে? এক পর্যায়ে রূপার বাবা বাসায় সাদা পোশাকের পুলিশ আসা,বাসা থেকে রূপার ল্যাপটপ নিয়ে যাওয়া এবং তাদের সাথে কথা বলার জন্য মোবাইল নম্বর দেওয়ার কথা বলে। কথা শুনে রূপার মার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, মুহূর্তে নিস্তব্ধতা নেমে আসে তাদের মধ্যে।
কেউ কোন কথা বলছে না। রূপার ছোট মামা এসেছে রূপাকে দেখতে। রূপারা ঢাকায় এসে ওর ছোট মামার বাসায় উঠেছে। রূপার মামা সরকারি চাকরিজীবী। কেবিনে ঢুকতেই ধাক্কা খেল রূপার মামা, পিনপতন নিরবতা। বাইরে এসে সব শুনে পুলিশের দেওয়া মোবাইলে কথা বললো রূপার মামা। প্রায় পনের মিনিট কথা হলো। ডিবি পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর রূপার ল্যাপটপটি তারা পরীক্ষা করে সাইবার ক্রাইমের অভিযোগ পেয়েছে। ল্যাবটপটির ফরসেনিক পরীক্ষার জন্য বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে এবং অভিযুক্তকে শনাক্ত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তাকে পাশের জেলা ধরা হয়েছে এবং জিজ্ঞাসাবাদকরা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে অভিযুক্ত রূপাকে কখনো দেখেনি, তবে সে আইটি স্কেপার্ট। যদিও এ বিষয়ে তার প্রাতিষ্ঠানিক কোন ডিগ্রি নেই। সোসাল মিডিয়ার ডু মারতে যেয়ে কৌতুহলবসত রূপার প্রফাইলে ঢুকে তার সম্পর্কে ধারণা নেয় এবং দুটি বিশেষ সফটওয়্যার।
-২-
রূপার একটি প্রিয় গানের সাথে ট্যাক করে ওর ল্যাপটপে পাঠিয়ে দেয়। রূপা কৌতুহলবসত: গানটি শুনতে ক্লিক করতেই গোপন সফটওয়্যারগুলো সচল হয়ে যায়। এ সফটওয়্যারগুলো ল্যাপটপ বন্ধ থাকা অবস্থায়ও ভিডিও ধারণ করতে সক্ষম। এভাবেই রূপার কিছু অসচেতন মূহুর্তের ব্যক্তিগত ছবি যা রূপা নিজে তুলেনি এবং জানেও না এগুলো অভিযুক্তের কাছে চলে যায়। আর এটা নিয়ে রূপাকে ব্লাক মেইল করার চেষ্টা করে সে। রূপা ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এখন আর ভয়ের কারণ নেই, সব কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখছে। এক মাস পর, জেলা পুলিশের আয়োজনে শতাধিক স্কুল- কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, অবিভাবক ও সুধিজনের উপস্থিতিতে এক অবহিতকরণ সভায় বক্তব্য রাখছেন জেলা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি প্রথমেই রূপার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ননা দিলেন।
রূপার মা-বাবা কী কী ভুল তারা এসময়ে করেছেন তারও বর্ননা দিলেন। তারা সমাজের সচেতন ও উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির মানুষ। অথচ বিপদের সময় তারাও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। এর কারণ হলো তারা ঠান্ডা মাথায় সমস্যাটি বিশ্লেষণ করতে পারেননি, ঘটনার আকর্ষিতায় তারা পাজেল হয়ে পড়েছিলেন । এরপর তিনি বল্লেন ডিজিটাল অপরাধ সংগঠিত হওয়ার কারন হিসেবে সম্ভব্য ঝুঁকিহীনতা ও অপরাধীর ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম এবং লাভ বেশি। এ ধরনের অপরাধীদের থেকে সর্তক থাকতে হবে অর্থাৎ ডিজিটাল ডিভাইসগুলোতে এরা নানারকম লোভনীয় বা আর্কষণীয় কন্টেন্ট পাঠায় এগুলোতে ক্লিক করা, লাইক দেওয়া বা কমেন্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত কারো পোস্টে লাইক, কমেন্ট করার আগে একাধিক বার ভাবতে হবে, বন্ধু নির্বাচনে সর্তক থাকতে হবে। এরপর তিনি ডিজিটাল অপরাধের শিকার হলে ভুক্তভোগী, মা -বাবা, অবিভাবক, সহপাঠী বন্ধু – বান্ধব এবং শিক্ষক – শিক্ষিকার করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করলেন। এর মূল কথা হলো ভয় পাওয়া এবং একে অপরকে মিথ্যা দোষারোপ না করে ঠান্ডা মাথায় সমস্যাটি মোকাবিলা করতে হবে। বিষয়টি কাল বিলম্ব না করে মা -বাবা, অবিভাবক বা শিক্ষক – শিক্ষিকাদের সাথে শেয়ার করে দ্রুত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে হবে। কোনভাবেই অপরাধীর ফাঁদে পড়া যাবে না। মনে রাখতে হবে এটাই নিজেকে রক্ষার প্রথম পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। কোথায় কিভাবে জানাতে হবে সেটা তিনি উল্লেখ করেন। সবচেয়ে সহজ হলো ৯৯৯ এ জানানো,পুলিশকে ৯৩৪২৯৮৯, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ০১৭১৩৩৯৮৩১১, রেপিড একশান ব্যাটেলিয়ন( RAB)কে ০১৭৭৭৭২০০২৯, বিটিআরসিকে ০১৭৬৬৬৭৮৮৮৮ এ ফোন করে অভিযোগ দেওয়া যাবে। এ সব ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী গুরুত্বের সাথে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।
অনলাইনে হয়রানি থেকে সুরক্ষার উপায়গুলো ও তিনি বলে দেন, এগুলো হলো ব্যবহৃরিত ডিজিটাল ডিভাইসগুলোতে ভাইরাস গার্ড রাখতে হবে, পাসওয়ার্ড শক্তিশালী রাখতে হবে, কারো সাথে পাসওয়ার্ড শেয়ার করা যাবে না। সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করতে হবে। ই-মেইলে কেউ লটারি, টাকা বা কোন ধরনের পুরস্কার জেতার কথা বললে বিশ্বাস করা যাবে না। অনলাইনে হয়রানির বা নির্যাতনের প্রমানের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের হার্ড কপি, URL সহ স্ক্রিন শটের প্রিন্ট ও ওয়েব অ্যাড্রেস, ফেসবুক আইডি, ই-মেইল আইডি ও তারিখ প্রয়োজন হয়, তাই এগুলো ডিলিট না করে সংরক্ষণ করতে হবে। সবশেষে সামাজিক কিছু ট্যাবো বা ভ্রান্ত ধারণা তিনি উল্লেখ করেন, এগুলো হলো নির্যাতনের কথা প্রকাশ করা লজ্জার ব্যাপার, শুধু অল্পবয়সি মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হয়, নির্যাতন মারাত্মক না হলে খুব একটা ক্ষতির কিছু নেই, শিশুরা অপরিচিত বা অনাত্মীয়র দ্বারা বেশি নির্যাতনের শিকার হয়, একই লিঙ্গভুক্ত শিশুদের মধ্যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটার আশঙ্কা নেই।
সবশেষে সকলের কাছে ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সচেতনতা বিষয়ক একটি ছোট পুস্তিকা ‘ কন্যা কথা’, যা ইতিমধ্যে সকলকে দেওয়া হয়েছে, সেটা মনোযোগের সাথে পড়ার জন্য অনুরোধ করলেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল যেমন আমরা সকলে ভোগ করছি, তেমনি এর চ্যালেঞ্জগুলোও আমাদের সকলের মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে।যে কোন সমস্যায় বাংলাদেশ পুলিশ শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও আপনার পাশে আছে ও ভবিষ্যতে থাকবে। আপনারা পুলিশের সাহায্য নিন, নিরাপদে থাকুন – এ আহবান জানিয়ে এবং সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন।