শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৫০ পূর্বাহ্ন

ডিজিটাল টাকা ওড়ে – মুস্তাফা মাসুদ

করিম সাহেব দুদিন ধরে ভারি দুশ্চিন্তায় আছেন। একটি সমস্যার কোনো কূলকিনারা একা একা করতে পারছেন না। স্ত্রী সুফিয়া বেগম বাতের ব্যথায় কোঁ কোঁ করছেন, তার সাথেও আলাপ করা যাচ্ছে না। টানা বৃষ্টির কারণে বাড়ি থেকে বেরোনো যাচ্ছে না, তাই সবজান্তা নকিব সাহেবের সাথে আলাপ করে সমস্যাটার সমাধানও করতে পারছেন না। ওদিকে রোজকার মতো নকিব সাহেবও আসছেন না তাও ওই বৃষ্টির কারণেই। এজন্য খুব টেনশন করছেন করিম সাহেব।

তার সমস্যাটা কী? করিম সাহেব একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। আড়াই বছর আগে তিনি গ্রামের বাড়ি চলে এসেছেন সস্ত্রীক। সিদ্ধান্ত আগেই ছিলো গ্রামেই সেটেলড হবেন। ছেলে-মেয়েরা ঢাকাতেই আছে আর তারা থাকবেন গ্রামে। শুধু মাঝে মাঝে তাদের ওখানে বেড়াতে যাবেন।

গ্রামে এসে ভালোই কাটছিল দিনকাল। কিন্তু করোনা মহামারি সব গুবলেট করে দিল। করিম সাহেবের ব্যাংক একাউন্ট, পেনশনার সঞ্চয়পত্রের একাউন্ট সবই ঢাকার ব্যাংকে। আগে মাস ছয়েক পর পর ঢাকায় যেতেন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তুলতে। তাতে ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতিনিদের সাথে এবং বন্ধুদের সাথে দেখা হতো, আবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তোলার কাজও হতো। কিন্তু এখন করোনার মহামারিকালে ঢাকায় যাওয়া অসুবিধা বলে পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তোলা যাচ্ছে না। বৃদ্ধ বয়সে ঢাকায় যাওয়ার ঝুঁকি নিতেও সাহস পাচ্ছেন না তিনি। ব্যাংক একাউন্টে অবশ্য সমস্যা নেই, উপজেলা সদরের ব্যাংক থেকে অনলাইনে টাকা তোলা যায়। সমস্যা হয়েছে তিনমাস অন্তর পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফা অর্থাৎ তার মূল রুটিরুজির টাকা তোলার ক্ষেত্রে। বর্তমানে অবশ্য এটিও অনলাইনে চলে গেছে, কিন্তু করিম সাহেবের একাউন্ট পুরোনো (২০১৮ সালের) বলে তার পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না; কারণ, ম্যাচিউর্ড না-হওয়া পর্যন্ত (২০২৩) এই স্কিমের জন্য নতুন একাউন্ট খোলা যাচ্ছে না; ফলে তা অনলাইনেও যেতে পারবে না। এখন সশরীরে ব্যাংকে হাজির হয়ে কিংবা অথোরাইজড পারসন দিয়ে সরাসরি ব্যাংক থেকে মুনাফার টাকা তোলার বিকল্প নেই।

সুতরাং বুঝেই দেখুন, করিম সাহেবের দুশ্চিন্তা কোথায়। প্রথম দিকে করোনার সংক্রমণ কম থাকায় দুবার ঢাকায় গিয়েছেন টাকা তুলতে। কিন্তু সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় গত একবছর নট নড়নচড়ন একবারও ঢাকায় যাননি। এদিকে স্ত্রীর একার পেনশনে কত আর চলে! তাই বাধ্য হয়েই ‘পুঁটির তেলে পুঁটি ভাজার মতো করে সংসার চালাতে হচ্ছে। ফলে টেনশন আর মেজাজ খারাপ এখন সহজেই হচ্ছে তার। আজ সেটি সুপারলেটিভ ডিগ্রিতে পৌঁছে গেছে।

এই ‘সুপারলেটিভ’ অবস্থায় করিম সাহেব দারুণ অস্বস্তিতে বারান্দায় পায়চারি করছেন। হঠাৎ দেখেন ‘সবজান্তা’ নকিব সাহেব আসছেন ছাতা মাথায় দিয়ে। পরনে হাঁটার পোশাক, পায়ে কেডস। তিনিও অবসরপ্রাপ্ত, করিম সাহেবের প্রায় সমবয়সি। কিন্তু তার হাবভাব, বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ আর তেজি চলাফেরা দেখলে বয়স অনেক কম বলেই মনে হয়। তিনি এসেই হাসতে হাসতে বলেন: করিম ভাই, আজ একটা অন্যরকম কবিতা লিখেছি, শুনবেন? বলেই শুরু করেন কবিতা:
নকিব সাহেবের কবিতা শেষ হতে পারে না। তিরিক্ষি মেজাজে করিম সাহেব বলেন: রাখুন আপনার ‘হাওয়ায় ওড়ে টাকা’! কোথায় টাকা উড়ছে? দেখান আমাকে, আমি লাফিয়ে লাফিয়ে ধরি আর ট্যাঁকের মধ্যে ভরি! আমি মরছি আমার জ্বালায় আর উনি করিম সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে নকিব সাহেব বলেন: কী ব্যাপার, করিম ভাই? এনি প্রবলেম? স্যরি, ভেরি স্যরি। আমি আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারিনি। কী হয়েছে, ভাই? নো চিন্তা, আমি তো আছি নাকী! করিম সাহেব সব খুলে বলেন নকিব সাহেবের কাছে। নকিব সাহেব বলেন: পুরোনো একাউন্টে পেনশনার স্কিমের মুনাফার টাকা তোলা যাচ্ছে না, ঠিকই। এই সাময়িক অসুবিধা মেনে নিয়ে কাউকে অথোরাইজ করে ঢাকায় পাঠানো যাবে, টাকাও তোলা যাবে। সেই সমস্যা সিঙ্গেল এবং সমাধানযোগ্যও। কিন্তু অন্য অঢেল সুবিধার দিকে একবার তাকান, দেখবেন টাকা সত্যিই উড়ছে! আমার কবিতার ‘টাকা ওড়া’টা অবশ্য শ্লেষার্থক, ব্যাঙ্গার্থক বা কদর্থক; সেটা ধান্ধাবাজ অসৎ লোকদের উদ্দেশে লেখা। কিন্তু আমি যে ‘টাকা ওড়ার কথা এখন বলছি তা বর্তমান সরকারের ডিজিটাল অগ্রগতির এক সফল ও প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত। ই-প্রযুক্তির কারণে এখন টাকা শুধু ওড়েই না; ভাসে, ছোটে দ্রুত এক স্থান থেকে অন্যত্র ভ্রমণ করে দেশে কিংবা বিদেশে; কিন্তু মানুষ তার অবস্থানেই থাকে। কোথাও দৌড়াদৌড়ির ভোগান্তি পোহাতে হয় না। সব তেলেসমাতি দুআঙ্গুলের টোকায় কম্পিউটার নামের এক আশ্চর্য বাক্সের মধ্যেই সব ‘জাদুর মূল; আর তা ঘটাচ্ছে বাংলাদেশের এক্সপার্ট পার্সনরা; আর তার নেপথ্যের মূল শক্তি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈপ্লবিক ডিজিটাল কর্মসূচি তথা তাঁর তথ্য উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের তীক্ষ্ণ মেধা, নিরলস প্রচেষ্টা এবং অদম্য সদিচ্ছা। কী অবাক কাণ্ড, তাই না? আপনার টাকা যেখানে যে ব্যাংকেই জমা থাকুক-না কেন, কোনো সমস্যা নেই। আপনি সেই ব্যাংকের স্থানীয় অর্থাৎ আপনার কাছাকাছি শাখায় যান।

-২-

এবং চেক কেটে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা তুলে নিন। নগদ টাকা জমাও দিতে পারেন এভাবে। তা ছাড়া বেশ ক’বছর থেকে মাসিক পেনশনের টাকাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হয়ে যাচ্ছে পেনশনধারীর ব্যাংক একাউন্টে সেই ব্যাংকের অবস্থান যেখানেই হোক-না কেন। সেখান থেকে পেনশনধারীরা অনায়াশে টাকা তুলতে পারছেন। কিছুদিন থেকে পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকাও অনলাইনে তোলা যাচ্ছে কী মজা তাই না? আপনারটাও ম্যাচিউর্ড হয়ে গেলে আর চিন্তার কিছু থাকবে না।

নকিব সাহেবের দীর্ঘ লেকচারের মাঝে এতক্ষণ ডুবে ছিলেন করিম সাহেব। আগের সেই রাগ, সেই টেনশনের ছিঁটেফোঁটাও আর নেই তার চোখেমুখে। তিনি স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন নকিব সাহেবের মুখের দিকে। তা দেখে নকিব সাহেবেরও খুব ভালো লাগে। তিনি পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে আবার বলেন: ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যায় কোথায় পৌঁছে গেছি আমরা! দেখুন করোনাকালে বাইরে বেরোনো, সমাবেশে যোগদান কিংবা বড়ো কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন সশরীরে করা ঝুঁকিপূর্ণ; সরকারিভাবে নিষিদ্ধও তা। কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে সেসব করাও সম্ভব হচ্ছে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমেই তা সম্পন্ন হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষের মতো একটা বিশাল কর্মসূচি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেই সম্পন্ন হচ্ছে এ তো আমার চোখের সামনেই ঘটছে!

করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকলেও আজ অনেক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে, পরীক্ষা নিচ্ছে এবং প্রমোশনও দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের; অবশ্য সব প্রতিষ্ঠানে এই সুযোগ নেই; তবে অদূর-ভবিষ্যতে এই ই-লার্নিং কার্যক্রম প্রয়োজনে যে সারাদেশের মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে তা অনুমান করা কী খুব কঠিন? আরও দেখুন এই প্রযুক্তি এখন নানা প্রয়োজনে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে; যার সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত কোভিড-১৯র ভ্যাকসিন নিবন্ধন, টিকাকার্ড ও টিকাসনদ সবই সম্ভব হচ্ছে এই ডিজিটাল বিস্ময়ের কারণে। ১০/১২ বছর আগের বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশের অবস্থার কী বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে ই-কমার্স, ই-ব্যাংকিং, ই-লার্নিং, ভিডিও কনফারেন্সিং, নানারকম বিল পরিশোধ, অনলাইন কেনাকাটাসহ অন্যান্য ই-কর্মসূচির দিকে তাকালে তা অনুধাবন করা যায়। টেকসই ভৌত অবকাঠামো এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি এই আইটি সেক্টরের বিস্ময়কর অগ্রগতি নিকট-ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে শামিল করতে কার্যকর অবদান রাখবে এ আশা আমরা করতেই পারি। আর তখনই সফল হবে বঙ্গবন্ধুর আজন্মলালিত ‘সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। তিনি সফল হোন, সার্থক হোন এই আমাদের আন্তরিক কামনা।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অনুবাদক ও প্রাক্তন সাংবাদিক।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: