শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৩৩ পূর্বাহ্ন

শ্রদ্ধাঞ্জলি : কমরেড আইউব রেজা চৌধুরী ইমাম গাজ্জালী

কমরেড আইউব রেজা চৌধুরী বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট তাত্ত্বিক, বুদ্ধিজীবী ও সংগঠক। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, ঘটনা প্রবাহ দেখেছেন খুব কাছ থেকে। নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনে তিনি প্রথমে রুশপন্থী ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সে সময় তার নেতা ছিলেন মণি সিংহ, খোকা রায়, অনিল মুখার্জি, বারিণ দত্ত প্রমুখ। সে সময় তার গুরুত্বপূর্ণ সক্রিয় সহকর্মী ছিলেন আবদুল হালিম, মহিউদ্দিন আহমেদ,আবদুর রহিম আজাদ, হায়দার আকবর খান রণো, রাশে খান মেনন, সাইফুদ্দিন আহমেদ খান মানিক, রেজা আলী, আনিসুর রহমান, মর্তুজা খান, শ্যামাপ্রাসাদ রায় ও ওয়ালিউর ইসলাম। তাদের মধ্যে নেতা ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ ও কাজী জাফর আহমেদ।

এরপর পার্টি বিভক্ত হওয়ার পর তিনি চীনপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। সে সময় এই অংশে তার নেতাছিলেন সুখেন্দু দস্তিদার, মোহাম্মদ তোয়াহা, আব্দুল হক ও অজয় ভট্টাচার্য। তখন তার গুরুত্বপূর্ণ সক্রিয় সহকর্মীছিলেন হায়দার আকবর খান রণো, রাশেদ খান মেনন, আবুল কাসেম ফজলুল হক, শামসুজ্জোহা মানিক, বদিউজ্জামান বড় লস্কর, আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া, আমজাদ হোসেন,আনিসুর রহমান, আব্দুল মতিন, নূর মোহাম্মাদ,মোফাখখর চৌধুরী, অহিদুর রহমান, খালেদুর রহমান টিটো, টিপু বিশ্বাস, মোজাম্মেল হক, গোলাম মোস্তফা ও মাহবুবউল্লাহ প্রমুখ। তাদের মধ্যে নেতা ছিলেন কাজী জাফর আহমেদ।

তিনি আরো অনেকের মত প্রথমে রুশপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হন, আরো পরে একই ভাবে চীনপন্থী রাজনীতির প্রভাব থেকেও মুক্ত হন। এভাবে পন্থি রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের তত্ত্বগত পূর্ণগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। একটি তত্তগত লাইন বিনির্মানে নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন তিনি। কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রগতি ও ঐতিহ্যকে তিনি ধারণ করতেন এবং একই সঙ্গে তার সকল বিচ্যুতি ও ভুলভ্রান্তি স্বীকার করতেন। অগ্রগতিকে ধারণ ও ভ্রান্তিকে ঝেড়ে ফেলাই তার রাজনৈতিক তত্ত্বগত লাইন বিনির্মানের মর্মকথা। তিনি বলতেন, ‘পন্থী রাজনীতি মূলত বাইরে থেকে আরোপিত এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিকাশের অন্তরায়।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘পাকিস্তান আমলের শেষ পর্যায়ে আমি আরও অনেকের মত চীনপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতি থেকে মুক্ত হই। বিশেষতঃ আমি পাকিস্তান বুর্জোয়া রাষ্ট্রের জাতিগত নিপীড়নবিরোধী অগ্রসর রাজনীতি এবং পূর্ববাঙলার বাঙালী জাতির জনসাধারণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রসর রাজনীতির স্বপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করি। আমি পাকিস্তান আমলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে প্রগতিশীল ধারার স্বপক্ষে দাঁড়াই।’

১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের শিক্ষা আন্দোলনের প্রথম সারির অন্যতম ছাত্রনেতা ছিলেন কমরেড আইউব রেজা চৌধুরী। ওই আন্দোলনে শহীদ হন ছাত্র নেতা বাবুল,ওয়াজিউল্লাহ। এর পরই স্বৈরশাসক আইউব খানের রোষানলে পড়েন ছাত্র যুবনেতারা। ১৯৬৪ সালে হুলিয়া জারি হয় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের ৯ জন ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে। এরা হলেন, সিরাজুল আলম খান, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রণো, কেএম ওবায়েদুর রহমান, বদরুল হায়দার চৌধুরী (সাবেক প্রধান বিচারপতি), শাহ মোয়াজ্জেম,রেজা আলী, গিয়াস কামাল চৌধুরী এবং আইউব রেজা চৌধুরী। ভাঙনের আগে সর্বশেষ অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নের সাংগাঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ছাত্র আন্দোলনের এই পর্বে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি থাকলেও,পরবর্তিতে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকেন।

বিশেষত: ছিষট্টিতে রুশ-চীন মহাবিতর্কে পার্টির বিভাজন, জাতীয় সংগ্রাম ও শ্রেণি সংগ্রামের প্রশ্নে পার্টির অবস্থান ইত্যাদি প্রশ্নে সন্তষ্ট থাকতে পারেননি। রাজনৈতিক মতাদর্শিক প্রশ্নে তিনি খুঁজতে থাকেন সঠিক লাইন। সেই ষাটের দশক থেকেই। ১৯৭০ সালের ১০ মে, চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে ন্যাপের জনসভায় স্বাধীনতার জন্য সরাসরি লড়াই শুরু করার আহ্বান জানিয়ে সেই সময়ের ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের রোষানলে পড়েন। সভা শেষে ওই দিনই রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। দেশ স্বাধীন হওয়া অব্দি কারাগারেই অন্তরীন থাকতে হয় তাকে। তিনি কোনো চিন্তার দাসত্ব করতেন না। কোনো দেশের কিংবা পার্টির ডেস্ক থেকে আসা ধার করা তত্ত্ব অনুকরণ করতেন না।

তার যাপিত জীবনের সঙ্গে রাজনৈতিক চিন্তার কোনো বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়নি। ভোগ বিলাসের কাছে আত্মসমর্পন করেন নি। অতি সাধারণ জীবনই যাপন করে গেছেন। শোষক লুটেরা শ্রেণির কেউ তার নিকট আত্মীয় হলেও তাদের সঙ্গ সচেতনভাবে পরিত্যাগ করতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের বুঝের ওপর দাঁড়িয়ে থেকেছেন। বিত্ত বৈভব আর জনপ্রিয় হওয়ার খায়েসে আত্মসমর্পিত হননি। দাঁড়িয়ে থেকেছেন শত প্রতিক‚লতা উপেক্ষা করে। নিজের স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতি চোখের মনির মত রক্ষা করে গেছেন। এদের কারণেই আজ ষাটের দশক ক্ষীণ ধারা হলেও বাংলাদেশে বহমান। এদের অর্জনকে বিবেচনার বাইরে রেখে বাংলাদেশে আরেকটি উত্থান কখনোই সম্ভব নয়। এই আকালে এমন উদাহরণ আমাদের ঋজু হয়ে দাঁড়াতে সাহসী করে তোলে। আজ আইউব রেজা চৌধুরীর ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। ইমাম গাজ্জালী, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: