শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৩৫ পূর্বাহ্ন

দুঃসময়ে ভরসার সুবাতাস – মুস্তাফা মাসুদ

ভাই, আপনার আর ভাবির আইডি কার্ড ও চার কপি করে ছবি লাগবে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবু সাঈদের এমন অনুরোধে চমৎকৃত হন মতিন সাহেব। খুলে কও তো, ভাইডি? বয়স্ক ভাতা। সরকার দিচ্ছে। বৃদ্ধকালে সরকারের দেওয়া আর্থিক সহায়তা। মতিন সাহেব হেসে বলেন: সরকারের পক্ষে তুমি বাড়ি বয়ে এসে কিছু দিতে চাইছো, এতে আমি ভারি খুশি হয়েছি। তবে আমাদের হবে না… কেন হবে না… প্রথমেই তোমার ভাবির কথা বলি। তিনি সরকারি কর্মচারী ছিলেন, এখন মাসিক পেনশন পান। সরকার থেকে/অন্য কোনো উৎস থেকে কোনো প্রকার নিয়মিত ভাতা বা অনুদান পেলে তিনি অন্য কোনো সরকারি/বেসরকারি ভাতা পাওয়ার অযোগ্য তাই তিনি পাবেন না। আমিও পাবো না পেনশন হোল্ডার না-হলেও। কারণ, আমি জানি যাদের বার্ষিক আয় সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা, তেমন বয়স্ক ব্যক্তিরাই কেবল এই ভাতা পাওয়ার যোগ্য। আমার বার্ষিক আয় ওর চেয়ে অনেক বেশি বলে ডিসকোয়ালিফাইড।
সাঈদ চলে যাওয়ার পর মতিন সাহেব এসে বসেন কম্পিউটার টেবিলে। প্রত্যন্ত গ্রাম হলেও সরকারের ‘ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সুবাদে তাদের বাড়িতেও বিদ্যুৎ আছে. ইন্টারনেট-ওয়াইফাই আছে। এই সুবাদে এক বয়স্ক ভাতার প্রসঙ্গটি তার মনে অনেক বিষয়ে বিস্তারিত জানার আগ্রহ জাগিয়ে দেয়। যেসব বিষয়ে তিনি ভাসা-ভাসা জানতেন, সেসবের গভীরে প্রবেশের জন্য তিনি গুগলে সার্চ দেওয়া শুরু করেন এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতে সরকারের আন্তরিক সচেতনতা আর দূরদর্শিতা তাকে রীতিমতো মুগ্ধ ও আপ্লুত করে। তিনি সন্তোষের সাথে লক্ষ করেন সামাজিক সুরক্ষা খাতের গুরুত্বপূর্ণ সবগুলো খাতই জননেত্রী শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০২১-এর সরকার এবং তাঁরই নেতৃত্বাধীন পরবর্তী সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত। তাঁর সরকার সাধারণ মানুষের কল্যাণে নব নব উপলক্ষ্য সৃজন করেছে এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতকে যথার্থ উপযোগিতাপূর্ণ করে বৃহত্তর উপকারভোগী জনগোষ্ঠীকে সেসব খাতের সুফল তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আজীবনের স্বপ্ন ছিলো দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। এসব কর্মসূচির সুফল ভোগকারীদের মাধ্যমে সেই হাসির প্রাণোচ্ছল প্রতিচ্ছায়া ভেসে ওঠে মতিন সাহেবের চোখের সামনে।

দেশের দুস্থ ও স্বল্প উপার্জনক্ষম কিংবা আয় উপার্জনে অক্ষম বয়স্ক ব্যক্তিদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধান এবং পরিবার ও সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে ‘বয়স্ক ভাতা’ নামক এক যুগান্তকারী সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করে। বয়স্ক বলতে মহিলাদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়স ৬২ আর পুরুষদের ক্ষেত্রে ৬৫। শুরুতে দেশের সব ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে ১০জনকে (৫জন পুরুষ, ৫জন মহিলা) প্রতি মাসে একশত টাকা হারে ভাতা দেওয়া হয় (পরবর্তীতে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোও এর আওতায় আসে)। এরপর বছর-বছর বেড়েছে ভাতাভোগীর সংখ্যা এবং ভাতার পরিমাণও। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ভাতার পরিমাণ করা হয় প্রতিজন প্রতি মাসে পাঁচশত টাকা; ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ভাতার পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকলেও ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ছে ১১ লাখ। ‘এ লক্ষ্যে আরও ১০০ উপজেলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। নতুন ১১ লাখসহ মোট উপকারভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৮ লাখ। এতে সরকারের ব্যয় বাড়বে ৫০০ কোটি টাকা।

বিধবা ও স্বামী-নিগৃহীতা মহিলা ভাতা অত্যন্ত যুগোপযোগী ও দুস্থবান্ধব এই কর্মসূচিটি শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে চালু হয় এবং এখনও অব্যাহত রয়েছে। আঠারো বছরের ঊর্ধ্বের বিধবা ও স্বামী-নিগৃহীতা মহিলাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের মহতী লক্ষ্যেই এই কর্মসূচি প্রবর্তিত হয়। এর ভাতাভোগীর সংখ্যা যেমন বছর-বছর বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ভাতার পরিমাণও। এই কর্মসূচির আওতায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৪ লক্ষ ৭৫ হাজার ভুক্তভোগী মহিলাকে জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়া হচ্ছে; যা বিধবা ও স্বামী-নিগৃহীতা মহিলাদের দুঃসময়ের বন্ধু হিসেবে বেঁচে থাকার শক্তি যোগাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রদানে বদ্ধপরিকর। ২০০১ সালে প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন প্রণয়ন করা হয়, যা অবহেলিত ও অসহায় প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষায় এক অনন্য দলিল। এতে রাষ্ট্রের অন্য নাগরিকদের সাথে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমান সুযোগ ও অধিকার প্রদান করা হয়েছে। শুরুতে জনপ্রতি ২০০ টাকা করে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হলেও এখন ২০ লাখ ৮ হাজার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে দেওয়া হচ্ছে মাথাপিছু ৭৫০ টাকা করে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ভাতা জনপ্রতি ১০০ টাকা বাড়িয়ে মাসে ৮৫০ টাকা করা হয়েছে। নতুন উপকারভোগীর সংখ্যা ২৩ লাখ ৬৫ হাজার।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার বিগত ১৩ বছর ধরে কাজ করছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২১-২২ অর্থবছরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে ৬ হাজার ৩শত ৪৩ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। বীর মুক্তিয়োদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সম্বলিত Management Information System প্রস্তুত করে G2P প্রক্রিয়ায় সকল বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ও অন্যান্য ভাতা বাংলাদেশ ব্যাংক হতে সরাসরি ভাতাভোগীর ব্যাংক হিসাবে প্রদান কাযক্রম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিগত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে উদ্বোধন করেছেন। বর্তমানে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, মৃত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের সম্মানীভাতা অন-লাইনের মাধ্যমে তাঁদের নিজস্ব হিসাব নম্বরে প্রেরণ করা হচ্ছে। এছাড়া মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের জন্য নিরাপদ আবাসন নিশ্চিত করতে ৪ হাজার ১ শত ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০ হাজার ‘বীর নিবাস’ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। ‘বীর নিবাস’ নামের এই নান্দনিক ঘরগুলো দেশে ৮ টি বিভাগ ও ৬৪ জেলায় নির্মিত হচ্ছে। পাশাপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশেরর প্রতিটি জেলা- উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

বর্তমান সরকার ২০০৯ সাল হতে পর্যায়ক্রমে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতার হার মাসিক ৯০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে মাসিক ২০ হাজার টাকায় উন্নীত করেছে এবং উৎসব ভাতা প্রদান করেছে। বিভিন্ন শ্রেণির সর্বমোট ৭ হাজার ৮শ ৩৮ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, মৃত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, শহিদ পরিবার ও বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ পরিবারের মাসিক রাষ্ট্রীয় ভাতার পরিমাণ ও বৃদ্ধি করে প্রদান করা হচ্ছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী (বর্তমান লক্ষ্মীপুর) জেলার রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গ্রামে ভূমিহীন-গৃহহীন অসহায় ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তীকালে ওই জনবান্ধব কর্মসূচিটি বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম সরকার ১৯৯৭ সালে সেন্টমার্টিনে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত-ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের মাধ্যমে এই কার্যক্রম পুনরায় শুরু করে। একই বছর সারা দেশের ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে শুরু হয় ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’।
‘মুজিববর্ষে একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। আমরা সবার জন্য ঠিকানা করে দেব, সবাইকে ঘর করে দেব’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ঘোষণা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীনদের ঘর করে দেওয়ার লক্ষ্যে এ পর্যন্ত দেশের প্রায় ৯ লাখ ভুক্তভোগী পরিবারকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। চলমান কর্মসূচির প্রথম ধাপে সারা দেশে ৬৯ হাজার ৯০৪টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে বিনামূল্যে বসবাসের জন্য দুই কক্ষের পাকা ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে শেখ হাসিনার জনবান্ধব সরকার, যা বিশ্বে অনন্য নজির। একইসাথে ২১ জেলার ৩৬টি উপজেলায় ৪৪ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩ হাজার ৭১৫ পরিবারকে ব্যারাকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। দুস্থ ও গৃহহীন মানুষদের কল্যাণে গৃহীত এ প্রকল্পটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ গৃহায়ণ প্রকল্পগুলোর অন্যতম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায়: ‘আমি জানি না, পৃথিবীর কোনো দেশে অথবা আমাদের দেশে কোনো সরকার এত দ্রুত এতগুলো ঘর করেছে।… বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যেন সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারে সেটাই আমার লক্ষ্য। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে মোট ৭,০৮,০০৩ টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে এবং উপকারভোগির সংখ্যা হলো ৩৫,৪০,০১৫ জন। এ কর্মসূচিকে প্রাধান্য দিতে গত বছরের উপকারভোগীর সংখ্যা ১০ লাখ ৪৫ হাজার থেকে ২লাখ ৯ হাজার বাড়িয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ লাখ ৫৪ হাজার করা হচ্ছে; বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা। [সূত্র: অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেট ২০২২-২৩]
‘২০২২-২৩ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে বরাদ্দ ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এ খাতে নতুন অর্থবছরে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা বাজেটের ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।’ সরকারের এ ধরনের দূরদর্শী ও যুগোপযোগী আরও কিছু দরিদ্রবান্ধব, দুস্থসহায়ক কার্যক্রম রয়েছে, যে-সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পর মতিন সাহেবের বুকের গহিন থেকে বেরিয়ে আসে আনন্দময় প্রগাঢ় আশীর্বাণী: আলহামদুলিল্লাহ! সফল হোন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আপনার হাত ধরেই জাতি পৌঁছে যাক সাফল্য ও গৌরবের স্বর্ণশিখরে। মহান আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন!


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: