শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১০:০৮ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম
চৌদ্দগ্রামে বৃষ্টির প্রার্থনায় ইসতিসকার নামাজ, প্রখর রোদে মুসল্লিদের কান্না হাতিয়ায় সৈকতে দেখা মিলল ‘ইয়েলো বেলিড সি স্নেক’ ফসলি জমি কেটে মাটির ব্যবসা: ভ্রাম্যমাণ আদালতে দুই লাখ টাকা জরিমানা মাটি ব্যবসায়ীর লাখ টাকা জরিমানা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ব্যবস্থাপনা পর্ষদে কুমিল্লার মফিজুর রহমান বাবলু সিনেমা হলে দেখা যাবে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জয়ের গল্প দেশে পৌঁছেছেন টাইগারদের নতুন কোচ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এশিয়া : ডাব্লিউএমও নয়াপল্টনে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল জাতি হিসেবে আমাদের সকল প্রাপ্তির দ্বার উন্মোচন করে গেছে মুজিবনগর সরকার-ধর্মমন্ত্রী

নিত্যপণ্যের বিক্রি কম, পোশাক-জুতার মার্কেট ফাঁকা

# নিত্যপণ্যের কেনাবেচায় ভাটা
# অর্ধেকে নেমেছে মনিহারি পণ্যের বিক্রি
# কাপড়-জুতার মার্কেট ফাঁকা
# বিলাসীপণ্যে আগ্রহ নেই মানুষের

নিউজ ডেস্ক :: জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। এতে গত একমাসে সংসার খরচ বেড়েছে ১৫-২০ শতাংশ। তবে এসময়ে বাড়েনি চাকরিজীবীদের আয়। বাধ্য হয়েই তারা খরচ কাটছাঁট করে চলছেন। এর প্রভাব পড়েছে বাজারেও। কমে গেছে বেচাকেনা। অস্বস্তিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, সংসার খরচ বেড়ে যাওয়ায় মানুষ কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছে। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু কিনছেন। অনেকে টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছেন। বিলাসীপণ্যের বিক্রি নেই বললেই চলে।

চকবাজারে আগে দিনে শতকোটি টাকার কেনাবেচা হতো। এখন তা ২০-৩০ শতাংশ কমে ৭০-৮০ কোটিতে নেমেছে। পাইকাররা যারা বাজারে আসছেন, তারাও পণ্য কেনার পরিমাণ আগের থেকে কমিয়ে দিয়েছেন

রাজধানীর প্রধান কয়েকটি পাইকারি বাজার ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা যায়। পাশাপাশি শপিংমলের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রেতা ও পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও জানিয়েছে একই তথ্য।

নিত্যপণ্যের কেনাবেচায় ভাটা

পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার। এটি রাজধানীর সবচেয়ে বড় নিত্যপণ্যের বাজার। মৌলভীবাজার ও বেগমবাজারের কিছু অংশ মিলে বড় বড় ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। ভোজ্যতেল, আটা, ময়দা, চিনি, ডাল, মসলা, গুঁড়া দুধসহ সব ধরনের পণ্যের কেনাবেচা হয় এখানে।

প্রতিদিন এ বাজারে ঠিক কত টাকার কেনাবেচা হয়, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে ব্যবসায়ী নেতাদের ধারণা, আগে এখানে দিনে শতকোটি টাকার কেনাবেচা হতো, যা এখন কমে ৭০-৮০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে।

ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা বলছেন, দুই কারণে কেনাবেচা কমেছে। এক- দাম দ্রুত ওঠানামা করছে। এ কারণে কেউ বাড়তি দামে পণ্য কিনে লোকসানের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। দ্বিতীয় কারণটি হলো- দাম বাড়ায় ব্যবসায়ীদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। একই খরচায় আগের থেকে অনেক কম পণ্য কেনা যাচ্ছে

মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সৈয়দ মো. বশির উদ্দিন। তার ধারণা বাজার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হওয়ায় মৌলভীবাজারে নিত্যপণ্যের কেনাবেচা আগের চেয়ে ২০-৩০ শতাংশ কমে গেছে।

বশির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা এখানে আসেন। বর্তমানে বাজার চরম অস্থিতিশীল। এজন্য ক্রেতাও অনেক কমে গেছে। আগে দিনে এ বাজারে শতকোটি টাকার কেনাবেচা হতো। এখন ২০-৩০ শতাংশ কমেছে। পাইকার যারা আসছেন, তারা পণ্য কেনার পরিমাণ আগের চেয়ে কমিয়ে দিয়েছেন।’

মানুষ এমন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে যে, বেঁচে থাকার জন্য যা লাগে তার বাইরে কিছু কিনছেন না। জীবনযাপনের বাড়তি ব্যয়ভার নিতে পারছেন না। এটি বিপণনের জন্য চরম দুঃসময়। ব্যবসা পরিচালনায় এখন বিনিয়োগ বেড়েছে, ঝুঁকি বেড়েছে। কিন্তু কমে গেছে মুনাফা

দুই কারণে কেনাবেচা কমেছে বলে ধারণা বশিরের। প্রথমত দাম দ্রুত ওঠা-নামা করছে। এ কারণে কেউ বাড়তি দামে পণ্য কিনে লোকসানের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। দ্বিতীয় কারণটি হলো- দাম বাড়ায় ব্যবসায়ীদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। একই খরচায় আগের চেয়ে অনেক কম পণ্য কেনা যাচ্ছে বলে জানান বশির উদ্দিন।

মৌলভীবাজারের বড় ব্যবসায়ী গোলাম মওলা। তিনি বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি। গোলাম মওলা জাগো নিউজকে বলেন, ‘পণ্যের দাম বাড়লে ক্রেতাদের মতো বিক্রেতাদেরও স্বস্তি থাকে না। মানুষ মনে করে বিক্রেতাদের হয়তো লাভ বেড়েছে। প্রকৃতপক্ষে সেটা হয় না। দাম বাড়ার কারণে বিক্রেতাদেরও বিক্রি কমে যায়। তখন পুঁজি বেশি খাটাতে হয়। লোকসানের ঝুঁকিও বাড়ে। গত একমাস ধরে আমরা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি রয়েছি।’

মনিহারি পণ্যের বেচাকেনা অর্ধেকে নেমেছে
পুরান ঢাকায় মৌলভীবাজারের পাশেই চকবাজার। প্লাস্টিকপণ্য, প্রসাধনী, ইমিটেশনের গহনা, শিশুদের খেলনা, ব্যাগসহ বিভিন্ন মনিহারি পণ্যের সমাহার এখানে। পাইকারি দরে এ বাজার থেকে দেশের অধিকাংশ খুচরা বিক্রেতারা পণ্য কেনেন। অথচ চকবাজারে এখন ক্রেতাদের আনাগোনা কমেছে। বিক্রি নেমেছে অর্ধেকে।

চকবাজারের ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতি’। চকবাজারে প্রায় পাঁচ হাজার দোকানি এ সংগঠনের সদস্য। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দোকান রয়েছে।

মনিহারি বণিক সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি হাজী মোহাম্মদ নাসের জাগো নিউজকে বলেন, ‘মনিহারিপণ্য প্রয়োজনীয় হলেও এটি তো নিত্যপণ্য নয়। এ কারণে দাম বাড়লে চাহিদা কমে যায়। ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। অথচ আমরা দাম সমন্বয় (বাড়ানো) করতে পারছি না। এমনিতেই বেচাকেনা কম, দাম সমন্বয় করলে আরও বিপাকে পড়তে হবে। ব্যবসায়ীদের লোকসানের পর লোকসান গুনতে হচ্ছে।’

চকবাজারের এস এস এন্টারপ্রাইজ। এ দোকানে স্কুলব্যাগ, ট্রাভেলব্যাগ, মানিব্যাগ, লেডিসব্যাগ, ফটো অ্যালবাম ও ছবির ফ্রেম পাইকারি ও খুচরা দরে বিক্রি হয়। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার শিমুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘অবস্থা খুবই খারাপ। বিক্রি একদম নেই। চড়া দামে পণ্য আমদানি করে পথে বসেছি। মানুষের হাতে টাকা নেই। কেউ বাড়তি পণ্য কিনছে না। আগে প্রতিদিন গ্রামগঞ্জ থেকে অনেক অর্ডার আসতো। সেটা অনেক কমেছে। মুনাফা তো দূরের কথা, নিজের ও কর্মচারীদের খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছি।’

বিক্রি কমেছে কাপড়-জুতারও
ঢাকায় জুতার সবচেয়ে বড় মার্কেট ফুলবাড়িয়া। আর ইসলামপুর বিখ্যাত কাপড় বিক্রির জন্য। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে ক্রেতারা আসেন এ দুই মার্কেটে। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলতো কেনাকাটা। তবে এ দুটি মার্কেটে ঘুরেও তেমন ক্রেতা চোখে পড়েনি। অথচ আগে এসব মার্কেট দিনরাত বিক্রেতা, হকার, কুলি, ভ্যানচালকদের হাঁকডাকে মুখরিত থাকতো। মানুষের ভিড়ে ঠেলে চলাচল করাই কঠিন ছিল।

ইসলামপুরের করিম ম্যানশনের থ্রি স্টার ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপক বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘কোনো কোনো দিন দুপুর পর্যন্ত এক টাকারও বেচাকেনা হচ্ছে না। অন্যান্য বছর এসময়ে শীতের পোশাকের আগাম অর্ডার আসতো। এবছর কোনো সাড়াই নেই। বসে বসে কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘এখন আগের দামে কাপড় বিক্রি করলে লোকসান হবে। দাম অনেক বেড়েছে। তবে চাহিদা কমায় বাড়তি দাম চাইতেও সাহস হচ্ছে না। এখন দোকান চালানোর খরচ, কর্মচারীদের বেতন কোনটিই উঠছে না। পুরোটাই এখন লস।’

ফুলবাড়িয়া জুতার মার্কেটের ব্যবসায়ী মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমাদের বেশি কাস্টমার দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা। তারা পাইকারি দরে এখান থেকে কিনে নিয়ে যান। আগে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫-৬ জন বড় পাইকারি ক্রেতা মফস্বল থেকে আসতেন। তারা একবারে অনেক টাকার মালামাল কিনতেন। এখন সপ্তাহে এক-দুজন আসছেন। তবে আগের মতো বেশি টাকার পণ্য কিনছেন না। সংকটের কথা জানাচ্ছেন।’

‘বেচাকেনা হচ্ছে না বলে পাইকারদের কাছে বকেয়া টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

বিলাসীপণ্যে আগ্রহ কম মানুষের
মোবাইল ফোনের বেচাকেনা তলানিতে। কসমেটিকস, পারফিউম, সাবানের দাম বেড়েছে, বিক্রিও কমেছে। স্বর্ণের বাজারও অস্থিতিশীল। ইলেকট্রনিক পণ্যসহ বিলাসী সব পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। রিকন্ডিশনড প্রাইভেটকার, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) বিক্রি নেই বললেই চলে। শুধু আমদানিনির্ভর বিলাসীপণ্য নয়, দেশে উৎপাদিত বিলাসীপণ্য বিক্রিতে বড় ধাক্কা।

বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের বিলাসীপণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কোম্পানি ব্র্যান্ড চালাতে পারছে না। আমদানি খরচ বাড়ায় দাম বাড়ানো হয়। এরপর বিক্রি একদম কমে গেছে। এরই মধ্যে প্রতিটি শো-রুমের কর্মী কমানো হয়েছে। খরচ কমাতে বেতন কমানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’

বাংলাদেশ রিকন্ডিশনড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সাবেক সভাপতি আব্দুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের গাড়ি বিক্রি ৪০ শতাংশ কমেছে। মানুষ গাড়ি কিনছেন না। সবাই একটি ক্রাইসিসের মধ্যে রয়েছে। উচ্চ-মধ্যবিত্তরাও এখন টাকা খরচ করতে ভয় পাচ্ছেন। তাদেরও নৈমিত্তিক খরচ বেড়েছে। সবাই দেখছে, পরিস্থিতি কোনদিকে গড়ায়।’

বিপণন কোম্পানির চরম দুঃসময়
বিক্রি কমায় দেশের বিপণন কোম্পানিগুলোও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে ছোট কোম্পানিগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে নেমেছে। মন্দাভাব কাটছেই না অধিকাংশ কোম্পানির ব্যবসায়।

জানা গেছে, বেশকিছু বিলাসীপণ্যের সরবরাহকারী কোম্পানি তাদের পণ্য আমদানি বন্ধ রেখেছেন। দেশে বিলাসীপণ্যের উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোও এখন খরচ তুলতেই হিমশিম খাচ্ছেন। লোকসান দিয়ে টিকিয়ে রেখেছেন ব্যবসা।

দেশের অন্যতম বিপণন ব্যক্তিত্ব আকিজ ভেঞ্চার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ আলমগীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানুষ এমন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে যে, বেঁচে থাকার জন্য যা লাগে তার বাইরে কিছু কিনছেই না। তারা জীবনযাপনের বাড়তি ব্যয়ভার নিতে পারছে না। এটি বিপণনের জন্য চরম দুঃসময়। ব্যবসা পরিচালনায় এখন বিনিয়োগ বেড়েছে, ঝুঁকি বেড়েছে। কিন্তু কমে গেছে মুনাফা।’

তিনি বলেন, ‘কয়েক মাসে আমদানি খরচ ও ডলারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এতে কেউ সাশ্রয়ী খরচে পণ্য উৎপাদন বা আমদানি করতে পারছেন না। সব পণ্যের ক্ষেত্রে দাম সমন্বয় (বাড়ানো) করলে মানুষ কিনতেই পারবে না। উৎপাদনকারী ও বিক্রেতারা পড়েছে উভয় সংকটে।’


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: