রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৩৮ অপরাহ্ন

করোনা দুর্যোগে যেভাবে কাটছে জবি শিক্ষকদের অবসর সময়

সারাবিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। বাদ যায়নি বাংলাদেশও। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। তারপর থেকে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অবসর সময় কাটাচ্ছে। ব্যতিক্রম হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকরা এই করোনার অবসরে বিভিন্নভাবে সময় পার করছেন। কলাম লিখে, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, পরিবারের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছেন শিক্ষকরা। করোনা দূর্যোগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কিভাবে অবসর সময় অতিবাহিত করছেন তার কিছু খণ্ড চিত্র পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।
মিল্টন বিশ্বাস
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ

লকডাউনে গৃহবন্দি হওয়ায় একদিকে মানসিক চাপ যেমন বেড়েছে তেমনি বৈশ্বিক দুর্যোগে ‘কলাম লেখক’ হিসেবে কিছু দায়িত্ব পালনের তাগিদও এসেছে। আমি যেহেতু শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে গত ১২ বছর যাবৎ কলাম লিখছি। সেজন্য দেশের দুর্যোগে সরকারের পক্ষে কাজ করার তাগিদটা বেশি। আর একারণেই যতদূর সম্ভব কলাম লেখে সংকট উত্তরণে সরকারের পক্ষে থাকার চেষ্টা করছি।

গত দুমাসে শেখ হাসিনার করোনা মোকাবেলার দিনপঞ্জির ওপর একাধিক কলাম লিখেছি। মহামারি নিয়ে প্রবন্ধও লিখেছি। ব্যাধির ভয়কে জয় করার জন্য ফ্রন্টলাইনে যারা আছেন বিশেষত সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ডাক্তার এবং অন্যান্য ব্যক্তিবৃন্দ- তাদের পক্ষে থাকা এবং কলাম লেখা আমার মূল কাজ। অর্থাৎ লকডাউনে সময় কাটছে কলাম লেখে আর বিশ্ব সাহিত্যের বিখ্যাত সব বই পড়ে।

 

সিত্তুল মুনা হাসান
সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ

করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বে অর্থনীতির চাকা মন্থর। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সবক্ষেত্রেই অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় বিভিন্ন ধরনের সংকট দেখা দিবে সামনে। সেই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আমরা স্ব স্ব ক্ষেত্র থেকে উদ্যোগ নিতে পারলে এগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবো।

করোনায় প্রায় ঘরবন্দী অবস্থায় আছি। বই পড়ে, টিভি দেখে, স্যোসাল মিডিয়া ব্যবহার করে মূলত সময় কাটছে। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাদের সচেতন করার কাজ করছি। নতুন বই পড়ছি। গবেষণা করছি। বই পড়া আর গবেষণা করার এখনই সুযোগ। সময়কে কাজে লাগাতে হবে।

এরকম দুর্যোগ পরিস্থিতি আগে কখনো কেউ মোকাবেলা করেছে কিনা জানিনা। এ পরিস্থিতিতে নিজেকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। আমি সেটাই করছি। পরিকল্পনা করে সময়কে কাজে লাগাচ্ছি। কিছু সময় পড়ছি। পরিবারকে সময় দিচ্ছি। বাড়িতে আত্মীয় স্বজনদের ফোন করে সচেতন করছি। সবাই মিলে নিয়মকানুন মেনে চললে শীঘ্রই সব ঠিক হয়ে যাবে।

মিঠুন মিয়া
সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা

করোনা ভাইরাসের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করার পরের দিনই আমি পরিবারসহ যথেষ্ট সুরক্ষারসহিত গ্রাম চলে আসি। এই দুঃসময়ে  আমার পক্ষে গ্রামে আসাই উত্তম মনে হয়েছে। কারণ গ্রামের বাড়িতে  পরিবার পরিজন নিয়ে ঘরে  অনায়াসে সময় কেটে যাবে। কিন্তু গ্রামে এসে দেখি উল্টো চিত্র। করোনা ভাইরাস সম্পর্কে কেউ সচেতন নয়, সবাই স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। এ অবস্থায় মনে হলো কিছু করা দরকার। এই বিপর্যয়ে ঘরে বসে থাকলে চলবে না।

গ্রামে এসেই ঢাকাস্থ শিবগঞ্জ উপজেলা কল্যাণ সমিতির পক্ষে করোনা থেকে সুরক্ষা সামগ্রী উপজেলা নির্বাহী কর্মকতার নিকট হস্তান্তর করি। তখন ইউএনও কে অবহিত করলাম করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কাজে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতে চাই। এরপর ঢাকাস্থ শিবগঞ্জ উপজেলা কল্যাণ সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী কল্যাণ পরিষদের সদস্যদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী টিম গঠন করি। আমাকে টিমের উপদেষ্টা করা হয়।

এরপর  গ্রামের মানুষের ঘরে ঘরে করোনা প্রতিরোধে সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছি। সারাদিন গ্রাম হাট বাজারে সময় কাটাচ্ছি মানুষকে সচেতন করা কাজে। রাতে টেলিভিশন দেখে সময় কাটছে। আর মাঝে  মাঝে বই পড়া হয়। ফসলের মাঠে যাওয়া হয়। তবে পরিবার পরিজন নিয়ে দুঃসময়ে মাঝেও সুসময় কাটানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

তাসলিমা আতিক
সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ

“অবসর” শব্দটা সামনে আসলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে এমন কিছু সময়ের স্মৃতি যেখানে নেই কোন রুটিনমাফিক কাজ,কিংবা সংসারের ঝুট-ঝামেলা। অবসর হলো এমন একটা সময় যা শুধুই উপভোগের কিন্তু বিগত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে এ আমরা কেমন অবসর কাটাচ্ছি?

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে এই অবসর যাকে আমি ‘ কোভিড অবসর’ বলতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করি।  উপস্থাপিত হয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা নিয়ে।অস্থিরতা আর অনিয়শ্চয়তার মধ্যে কাটানো এই সময়ে যদিও আমাকে দৈনিক ক্লাস লেকচারের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে না তবুও প্রস্তুত হতে হচ্ছে এক লড়াইয়ের জন্য।

লড়াই শব্দটা যতটা ভীতিকর এই লড়াই ঠিক ততটাই সহজ, শুধু মেনে চলতে হবে কিছু নিয়ম।কারণ এই লড়াই শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার আর সামাজিক মমত্ত জোড়দার করার লড়াই আর তাই তো ঘরে বসেই করছি শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগের চেষ্টা। করোনার এই ক্রান্তিকাল আমাকে সুযোগ করে দিয়েছে আমার সেই শিক্ষার্থীদের খোঁজ নিতে একশো শিক্ষার্থীর ভীড়ে যে ছিলো হয়তো চোখের আড়ালে কারণ দূরত্বটা শারীরিক মানসিক নয়।
বলতে দিধা নেই ‘কোভিড অবসর’ আমাকে আমার পরিবারের স্বাস্থ্য সম্পর্কে করে তুলেছে আগের থেকে অধিক সচেতন। তাই তো এই অবসরে খাদ্যের হাইজিন নিয়ে যেমন হয়েছি কঠোর তেমনি পুষ্টিগুন নিয়ে করছি ততই চুলচেরা বিশ্লেষণ। কিন্তু এ অবসর আমাকে এটাও ভাবিয়ে তোলে যে আমি যখন প্রোটিনের হিসেব কষছি তখন অনেকের কাছে কার্বোহাইড্রেটই মূখ্য।

ঐতিহাসিকভাবেই জনসাস্থ্যের মত জনগুরুত্বপূর্ণ অথচ অবহেলিত একটি বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাববার রাস্তা খুলে দিয়েছে আমাকে এই সময়। অদৃশ্য এই ভাইরাস মোকাবিলায় শুধু ব্যাক্তিক ইম্যুনো সিস্টেম নয় বরং সামাজিক ইম্যুনো সিস্টেম ঠিক করা এখন সময়ের দাবী।

‘কভিড অবসর’ আমাকে আপনজনের সাথে কাটানোর জন্য যেমন দিয়েছে অফুরান সময় যেখানে আমি কিংবা আপনি সবাই করতে পারি আমাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ যা আবার হতে পারে আমাদের মানসিক শক্তি তৈরির একটি মাধ্যম  ঠিক তেমনই ব্যাক্তি হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের যে দায়বদ্ধতা আছে তা নতুন করে উপলব্ধি করিয়েছে এই অবসর। তাই আতংকিত না হয়ে চলুন এ সময় নিয়ম মেনে চলি সুন্দর আগামীর জন্য নিজেকে ও সমাজকে প্রস্তুত করি।

মোফাজ্জল হোসেন জয়
সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ

এমন সংকটময় অবসর কোন ভাবেই কাম্য নয়। এমতাবস্থায় করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বাসাতেই অবস্থান করছি। নিকটাত্মীয়, সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের নিয়মিত খোঁজ রাখছি। তুলনামূলক আর্থিকভাবে অসচ্ছলদের ব্যাক্তি উদ্যোগে কিছুটা সহযোগিতার চেষ্টা করছি। এমন সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সমাজের বিত্তশালীদের প্রতি আমার অনুরোধ তাঁরা যেন অসচ্ছলদের পাশে দাঁড়ান।

সর্বোপরি মানসিক আতঙ্কের মধ্যে দিনগুলো চলে যাচ্ছে। একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে চলছে গোটা বিশ্ব। গত কয়েক দশকে এমন সংকটে পড়েনি সাড়া বিশ্ব। আমি আশা করি খুব দ্রুতই মানবসভ্যতা এ সংকট কাটিয়ে উঠবে। আমরা আবার একসাথে বিজয়োৎসব করব। সৃষ্টিকর্তার কাছে আপাতত এমনটাই প্রার্থনা।

মারজিয়া রহমান
প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

করোনা থেকে নিজেকে এবং নিজের সমাজকে রক্ষার জন্য নিজের ঘরে অবস্থান করছি আজ প্রায় ১ মাসেরও বেশী সময় ধরে। কি করলাম বা কি করছি এই সময়ে? সর্বপ্রথম যেটা করেছি আর তা হলো পরিবারের সকল সদস্যকে সময় দেয়া। দীর্ঘদিন যেহেতু বাসার বাহিরে কেউ যেতে পারছি না তাই পরিবারের সবাই সবাইকে সঙ্গ দিচ্ছি। বাসা বাড়ি জীবানুমুক্ত রাখাটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সবাই মিলেই চেষ্টা করছি যতটা পারা যায় জীবানুমুক্ত রাখার। পরিবারের বাহিরেও প্রতিবেশী থাকেন। খেয়াল রাখছি কোন প্রতিবেশী কোন সমস্যায় আছে কিনা। যদিও আমার সাধ্য সীমিত।

অনলাইনে আমার অনেক ছাত্র-ছাত্রীরাই অনেক ব্যক্তিগত সমস্যার কথা শেয়ার করেন। সাধ্যমত চেষ্টা করছি মানসিকভাবে তাদের পাশে থাকার জন্য। এর পাশাপাশি আমার সময়ের একটি বড় অংশ কেটে যাচ্ছে সাহিত্যপাঠে। এখন পড়ছি বিভূতিভূষণ। এছাড়াও বাছাই করা কিছু সিনেমা দেখা হচ্ছে। সত্যজিতের ক্লাসিক “অপুর সংসার” থেকে শুরু করে নেটফ্লিক্সের “মেসিয়াহ” অনেক কিছুই দেখার তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। এখন পবিত্র রামাদান মাস। সিয়াম সাধনার পাশাপাশি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছি যাতে এই মহামারীর দ্রুত সমাধান হয়ে যায়।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: