শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১১:১৩ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম
চৌদ্দগ্রামে বৃষ্টির প্রার্থনায় ইসতিসকার নামাজ, প্রখর রোদে মুসল্লিদের কান্না হাতিয়ায় সৈকতে দেখা মিলল ‘ইয়েলো বেলিড সি স্নেক’ ফসলি জমি কেটে মাটির ব্যবসা: ভ্রাম্যমাণ আদালতে দুই লাখ টাকা জরিমানা মাটি ব্যবসায়ীর লাখ টাকা জরিমানা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ব্যবস্থাপনা পর্ষদে কুমিল্লার মফিজুর রহমান বাবলু সিনেমা হলে দেখা যাবে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জয়ের গল্প দেশে পৌঁছেছেন টাইগারদের নতুন কোচ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এশিয়া : ডাব্লিউএমও নয়াপল্টনে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল জাতি হিসেবে আমাদের সকল প্রাপ্তির দ্বার উন্মোচন করে গেছে মুজিবনগর সরকার-ধর্মমন্ত্রী

৭১ এর ২৬ মার্চ সকাল ও একজন আ ফ ম মাহবুবুল হকের কথা : রায়হান ফিরদাউস

আগুন ঝরা এক একটা দিন পার করছিলো তখন পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের আপামর মানুষ।বস্তুত একাত্তরের ৭ই মার্চ স্বাধীনতার বানী ঘোষনার পর বাংলা নামের এই জনপদ চলছিলো তার অবিসংবাদি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে। ৭ই মার্চ-পরবর্তি প্রতিটি দিনই ছিলো বাঙালী জাতির ঐতিহাসিক গণজাগরনের এক একটি মূর্ত রূপ। প্রতিটি দিন সাধারন মানুষ রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচনা করে চলেছিলেন। এর ঠিক আঠারো দিনের মাথায় এলো ইতিহাসের এক বর্বর পশু শক্তির মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ। সংঘটিত হলো নিরপরাধ স্বাধীনতাকামী মানুষের উপর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক হামলা।

মনে পড়ে যায়,রাত তখনো গভীর হয়নি। আমরা তখন ইকবাল হল ক্যাফেটেরির সামনে আলাপরত প্রতিদিনের মতই। ইকবাল হল ছাত্র সংসদ কক্ষটি তখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হেডকোয়ার্টা। সারা দেশের আন্দোলন সংক্রান্ত সমস্ত খবরাখবর, বিশেষ করে নিরাপত্তাবাহিনীর আক্রমনের সংবাদ ওখানেই পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা ছিলো। বিকেল থেকেই ছাত্রলীগের নেতা সংগঠক কর্মীর ভীড় লেগে থাকতো, সাধারণ ছাত্ররাও হাজির হতো ইকবাল হলে। পুরো এলাকাটা হয়ে উঠেছিলো মিলন কেন্দ্রে। সবার মধ্যে টানটান উত্তেজনা, কি হয় না হয় এ নিয়ে নানা রকম কথাবার্তা, বিচার বিশ্লেষণ। কি হবে এরপর? বঙ্গবন্ধু কি ভুল করছেন?
সেদিন ২৫ শে মার্চ, রাত গভীর হতে তখনও ঢের বাকি। আনুমানিক সাড়ে দশটার সময় যুবনেতা আবদুর রাজ্জাক এসে উপস্থিত হন ইকবাল হলে।

আমরা সবাই তার কাছে ছুটে গেলাম সর্বশেষ সংবাদ শোনার জন্যে। তিনি যা জানালেন তাতে এক ধরনের বিপন্ন বোধই করেছিলেন অনেকে। তিনি স্পষ্টভাবেই বললেন, আজ মিলিটারী হামলা করতে পারে, তোরা সবাই এখান থেকে চলে গিয়ে নিরাপদ কোন অবস্থানে চলে যা। এই ম্যাসেজ দিয়েই প্রস্থান করেন যুবনেতা আবদুর রাজ্জাক।

মনে পড়ে যায়,খবরটা সবাইকে জানিয়ে আ ফ ম মাহবুবুল হক আর আমি ইকবাল হলের মাঠ পেরিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাসের দিকে যাত্রা করি। এবং বকশীবাজারের একটি বাসায় আমরা উপস্থিত হই।

বকশীবাজারের ওই বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ কানে এসে লাগতে শুরু করলো। বুঝতে পারি, রাজ্জাক ভাইয়ের ম্যাসেজের সঠিকতা। পাক হানাদার বাহিনী তার সমস্ত হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। অথচ প্রকৃতই কি হচ্ছে তা জানার কোন উপায় নেই। অথচ গোলাগুলির শব্দ থামছেইনা। রাত্রির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ট্যাংকের গর্জন, মর্টার শেলিংয়ের বিকট শব্দ আর গুলিবর্ষনের আওয়াজই শোনা যাচ্ছে কেবল। জানালার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে দেখেছি সার্চলাইটের আলোকে সারা আকাশ আলোময়, তারপরই মুহূর্মুহু গোলাগুলির কর্কশ শব্দ। অজানা আশংকায়, উদবেগে কেটে যাচ্ছে সময়, অস্বস্তিকর সময়। আমাদের নেতা কর্মীদের কার কি অবস্থা, কে কোথায় অবস্থান নিয়েছে, কিছুই জানা নেই আমাদের। এর মধ্যে ঘড়িতে দেখলাম ভোর পাঁচটা বাজে।

মাহবুব ভাই হঠাৎ করে বললেন, চলো। আমি কোথায় জিজ্ঞেস করতেই বললেন, কোথায় মানে? চলো বাইরে গিয়ে দেখি কি অবস্থা। শুনেতো আমি ভয়ে কাঠ। বাইরে তখনও প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ। আমাকে পাত্তা না দিয়েই তিনি বেরিয়ে গেলেন। অগত্যা আমিও তাঁর পিছু নিলাম।

দূরু দূরে বক্ষে তারঁ সংগে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের সামনে দিয়ে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল ইসলাম হল, আহসানুল্লাহ হল অতিক্রম করে তিতুমীর হলের পাশ দিয়ে পৌছে গেলাম পলাশীর মোড়ে। পলাশীর ঐ মোড়ে তখন দমকল বাহিনীর একটা স্টেশন ছিলো। ভিতরে ঢুকে চোখ ফেলেই যা দেখলাম, তার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। কয়েক সারি লাশ আর লাশ। রক্তের নহর বেরিয়েছে যেন! ফায়ার ব্রিগেডের যারাই সেদিন অবস্থান করছিলেন, তাদের কেঊ আর জীবিত ছিলেন না। আমার আজো ভোজবাজির মতো মনে হয়, কোত্থেকে একটা মিনি ট্রাক এসে হাজির হলো ত্বড়িত বেগে। ট্রাক থামতে দেখে মাহবুব ভাই বললেন, লাশগুলো ট্রাকে তুলতে হবে, চলো।

আমরা এখানে অবস্থান কালেই কয়েকটা মিলিটারী জীপ এস এম হলের সামনে দিয়ে চলে গেলো, দেখতে পেলাম। আমি ভয়ে তটস্থ অবস্থায় মাহবুব ভাইকে বললান, ভাই চলেন এখান থেকে সরে পড়ি; মিলিটারী ভ্যান মুভ করছে কিন্তু। কে শোনে কার কথা! তিনি ড্রাইভারের সহায়তায় লাশ একটা টেনে তোলেন ট্রাকে। আমাকে ধমকেও কোন কাজ হলোনা কারণ আমি সম্পূর্ণ নির্বিকার, ভীত সন্ত্রস্ত।

এর কিছু পর তিনি নিজেও হাঁপিয়ে উঠলেন। আমি কিছুটা প্রাণ ফিরে পেলাম। বললা, ভাই চলেন জলদি। এ স্থান নিরাপদ নয়। অবশেষে ফিরে চললাম দু’জন। কিন্তু হায়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে আবার গোঁ ধরলেন তিনি। বললেন, চলো এই বিল্ডিং এর ছাদে যাই। ওখান থেকে সব দেখা যাবে। আপত্তি করলে শুনবেনা, তাই অগত্যা ঢুকলাম ভবনে তার পিছুপিছু। আস্তে আস্তে সিড়ি বেয়ে প্রশাসনিক ভবনের ছাদে অবস্থান নিলাম আমরা। ওখানে উঠে চারপাশে তাকালাম, সব স্পষ্ট মোটামুটি। আরো তাকাতে গিয়ে আমাদের চোখ আটকে গেলো জগন্নাথ হলের মাঠে। ওখানে লোকজনের চলাফেরা লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো। কিন্তু প্রকৃতই কি হচ্ছিলো তা বুঝতে পারছিলাম না। পরবর্তী সময়ে তো আমরা জেনেছি কি নারকীয় হত্যাকান্ড চালানো হয়েছিলো ঐ জগন্নাথ হলে। কয়েকজনকে না মেরে তাদেরকে দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে ওদেরকে সহ সব্বাইকে মাটিচাপা দেয়া হয়। ওই গনকবর এখনতো ইতিহাস।

তখনও আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির প্রশাসনিক ভবনের ছাদে। সামনের সড়ক দিয়ে সাঁই সাঁই করে মাঝে মাঝে ধাবমান মিলিটারী জীপ। তখনও হঠাৎ করে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। আর আমি ভাবছিলাম, এই উন্মুক্ত ছাদে মিলিটারী যদি আমাদের দেখতে পায়, তাইলেতো তারা এদিকে আসবেই। আর যদি আসেই, তাইলেতো রক্ষা নেই। মনের এই কথাটাই অবশেষে বললাম মাহবুব ভাইকে। তিনি শুনলেন, গান্ধারা শিল্পের বুদ্ধ মূর্তির মতো নির্বাক রইলেন, বললেন না কিছুই। আমি দোয়া ইউনুস পড়ছি বারবার। যদি ঐশ্বরিক কোন সাহায্য পাওয়া যায়! মাথার উপর দিয়ে সামরিক হেলিকপ্টার চক্কর মারছে। এই কপ্টারগুলো উড়তে দেখলেই ভয়ে তটস্থ হয়ে যাচ্ছি আমি। প্রায় ঘন্টা তিনেক বাদে মনে হলো মাহবুব ভাই সম্বিত ফিরে পেয়েছেন, ফিরে এসেছেন কঠিন বাস্তবে। বললেন, চলো এবার যাই। অতি সন্তর্পণে বিড়ালসদৃশ সতর্কতার সাথে নীচে নেমে এলাম। না কোথাও কেঊ নেই।

চারপাশ দেখে শুনে প্রত্যাবর্তন করলাম সেই পথ ধরে, যে পথে আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম সেই প্রত্যুষে। ফেরত যাত্রায় বকশীবাজারের যে ঘরে রাত কাটিয়েছিলান, সে ঘরে গেলাম না। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম বুড়িগঙ্গার তীরে। উদ্দেশ্য নদী পাড় হয়ে জিঞ্জিরায় যাওয়া……।

আজ এতগুলো বছর পরেও সেই রাত্রির কথা, সেই প্রত্যুষের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায়, ইতিহাসের এক বর্বর পশুশক্তি-পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংস আক্রমনের কথা। আরো মনে পড়ে যায়, আ ফ ম মাহবুবুল হক নামের এক অদম্য, অকুতোভয় ছাত্রযুব নেতার কথা। যিনি ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে, শত্রæর আক্রমণের মুখে আমরা যখন নিজের নিজের জীবন বাঁচাতে ততপর, তখন তিনি মৃত স্বদেশবাসীর মৃতদেহের মর্যাদা দিতে জীবন বাজী রেখেছিলেন পলাশীর মোড়ে।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: